সৌদি আরবকে বদলে ফেলতে নানা উদ্যেগ নিয়েছেন ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। তেল নির্ভর অর্থনীতি থেকে বেড়িয়ে আসতে সৌদি আরবকে একটি পর্যটন নগরী হিসাবে গড়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। লোহিত সাগরের তীরে সব ধরনের আধুনিক সুবিধা দিয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে আধুনিক নগরী। দুবাইয়ের মতো করে তিনি গড়ে তুলতে চান জেদ্দাকে। যেখানে থাকবে নাইট ক্লাব, বার ও বিদেশি শিল্পীদের কনসার্টের আয়োজন। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স ইতোমধ্যে দেশটির আভ্যন্তরিন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনছেন। নারীদের সিনেমা দেখা, গাড়ি চালানো এবং স্টেডিয়ামে পুরুষ সঙ্গীর সাথে খেলা দেখার অনুমতি দেয়া হয়েছে। আসুন আমরা জেনে নেই আর কী ধরনের পরিবর্তন আসছে সৌদি আরবে।
বিদেশি পর্যটক টানতে লোহিত সাগরের সৈকতে আর্ন্তজাতিক মানের অনেকগুলো বিলাসবহুল রিসোর্ট তৈরি করতে যাচ্ছে সৌদি আরব। লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সৌদি আরবে যে বিচ রিসোর্টের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে সেখানে নারীদের বিকিনি পরার সুযোগ দিতে বিশেষ আইন প্রনয়ন করা হবে।
‘রেড সি প্রজেক্ট’ নামে এই পরিকল্পনার মুল লক্ষ হলো তেলের উপর নির্ভরতা কমিয়ে পর্যটন থেকে আয় বাড়ানো। পর্যটনের উন্নয়নে বৃহৎ এই প্রকল্পের অধীনে ২০২২ সালের মধ্যে সৌদি আরবের শহর আমলাজ ও আল-জাওয়াহের মধ্যবর্তী লোহিত সাগরের উপকূলঘেঁষে প্রায় ৫০টি দ্বীপে রিসোর্ট তৈরি করা হবে। সেখানে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য উপভোগ, কোরাল রিফে ডাইভিং ও ঐতিহাসিক স্থানগুলো পরিদর্শনের সুযোগ থাকবে।
২০১৯ সালের মধ্যে কাজ শুরু করে প্রথম ধাপে বিমানবন্দরের উন্নয়ন, বিলাসবহুল হোটেল ও আবাসন নির্মাণের কাজ শেষ হবে। সৌদি কর্মকর্তারা বলছেন মুসলমানদের পবিত্র ভূমি হিসেবে পরিচিত মক্কা ও মদিনায় প্রতি বছর হজ ও কাজের সূত্রে লাখ লাখ পর্যটক সৌদি আরব গেলেও দেশটি পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারেনি। এ কারনে এসব পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
সৌদি যুবরাজ দেশটিতে পর্যটন টানতে জর্ডান ও মিসর সীমান্তে একটি আধুনিক নগরী গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছেন। যার নাম দেয়া হয়েছে নিয়ম। ইতোমধ্যে এর কাজ শুরু হয়েছে। এই নগরী হবে একদিকে বিনোদন কেন্দ্র অপরদিকে শিক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ন হাব। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বড় বড় কোম্পানিগুলোকে ইতোমধ্যে এই নগরীতে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রধান পরামর্শদাতা হচ্ছে আবুধাবির শাসক মোম্মমদ বিন জায়েদ। তিনি অনুপ্রানিত করছেন সৌদি আরবকে পর্যটন নগরীতে পরিনত করার।
জর্ডান এবং মিসর সীমান্তে নিয়ম নামের মেগা সিটি তৈরির পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সৌদি আরব। সৌদি আরবের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের প্রায় ২৬ হাজার ৫ শ বর্গ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে নির্মিতব্য এই শহরকে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ‘স্বপ্নের শহর’ বলে অভিহিত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক শহর থেকেও প্রায় ৩৩ গুণ বড় হবে নিয়ম ।
এই মেগাসিটিতে থাকবে না কোনো পানির সঙ্কট। এই নগরের বিদ্যুত ব্যবস্থা হবে সৌরবিদ্যুত নির্ভর। নিয়ম হবে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ কেন্দ্র। বিমান, স্থল ও জলপথে বিশ্বের নানা প্রান্তে যাতায়াতের জন্য ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার হবে এই লোহিত সাগরের তীরবর্তী শহর। মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও কোম্পানিগুলোর জন্যও নিয়ম হবে এক কাঙ্খিত ঠিকানা।
বিশ্বের সেরা সেরা স্টুডিও নির্মিত হবে সেখানে। হলিউড থেকে শুরু করে দুনিয়াজোড়া সেরা পরিচালকরা তাদের ফিল্মের কাজ করতে ছুটে আসবেন নিয়মে। সাধারণ মানুষের বিনোদনের জন্য থাকবে নজিরবিহীন সব ব্যবস্থা। সমুদ্র উপকূল এ জন্য হবে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। এছাড়া পৃথিবীর সেরা থিয়েটার, শপিং মল ইত্যাদি তো থাকবেই। প্রযুক্তির সর্বশেষ নানা বিষয় নিয়ে গবেষণার জন্য উপযোগী ল্যাব ও প্রতিষ্ঠান থাকবে সেখানে। আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স, ভার্চুয়াল রিয়ালিটি ইত্যাদির ওপর উচ্চতর গবেষণার মাধ্যমে কিভাবে দৈনন্দিন জীবনকে সহজ করা যায় তা নিয়ে কাজ করবেন গবেষকরা।
আগামী দশ বছরে বিনোদন খাতে ৬৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছেন সৌদি ক্রাউন প্রিন্স। এরই মধ্যে হলিউডের প্রভাবশালী প্রযোজকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন তিনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে লস এঞ্জেলসে মিডিয়া মোগল রুপার্ট মার্ডক থেকে শুরু করে ওয়াল্ট ডিজনির প্রধান বব ইগার, ইউনিভার্সাল ফিল্মড এন্টারটেইনমেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান জেফ শেল, ওয়ার্নার ব্রাদার্সের প্রধান নির্বাহী কেভিন সুজিহারা, টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফক্সের প্রেসিডেন্ট পিটার রাইস এবং এনবিসি ইউনিভার্সালের ভাইস চেয়ারম্যান রন মেয়ারের সাথে বৈঠক করেন। বিশ্বব্যাপী এরা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি নিয়ন্ত্রণ করেন। অ্যাকশনধর্মী সায়েন্স ফিকশন মুভি ‘ব্ল্যাক প্যানথার’ দেখানোর মধ্যদিয়ে গত বছরের এপ্রিলে সিনেমা হল চালু করা হয় সৌদি আরবে।
সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান দেশটিতে পশ্চিমা ধাচের এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি নাগরিকদের মন বদলানোর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাকে দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে নানা ধরনের বৈরি পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। রাজ পরিবারে যেমন তার প্রতিদ্বন্দ্বি রয়েছে তেমনি আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে তার ইমেজ মোটেও ভালো নয়। এরমধ্যে সৌদি নাগরিকদের মধ্যে এ ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ক্ষোভ ও ভিন্নমত আছে। তবে দেশটির তরুন ও নারীদের কাছে জনপ্রিয় হতে চান ক্রাউন প্রিন্স। তাদের জন্য বিনোদনের অবারিত সুযোগ দিতে চান। এ কারনে দেশটিতে বিদেশি সিনেমা দেখা ও কনসার্টের আয়োজন করতে উৎসাহিত করছেন তিনি। এ ধরনের এক কনসার্ট নিয়ে এখন তুমুল আলোচনা চলছে সোশাল মিডিয়ায়।
সৌদি আরবে এক অনুষ্টানে পারফর্ম করার কথা ছিলো মার্কিন র্যাপ সঙ্গীত নিকি মিনাজের৷ 'খোলামেলা' গানের কথা ও মিউজিক ভিডিওর জন্য তিনি পরিচিত। জেদ্দায় অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক উৎসবের অংশ হিসেবে নিকি মিনাজকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো। ব্যাপক বির্তকের মুখে শেষ পর্যন্ত নিকি মিনাজ নিজেই অনুষ্টানটি বাতিল করেন।
সৌদি আরবের দুর্দান্ত প্রতাপশালী ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান, সংক্ষেপে যাকে বলা হয় এমবিএস। কাগজে কলমে ক্রাউন প্রিন্স হলেও সৌদি আরবের সবচেয়ে ক্ষমতার ব্যক্তি এখন তিনিই। ‘ভিশন ২০৩০’ নামে ক্রাউন প্রিন্স একটি সংস্কার কর্মসূচি শুরু করেছেন। এর আওতায় তিনি দেশকে শুধু নয় দেশের মানুষের মন বদলে ফেলার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। দেশটিতে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ২২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে মোট জনশক্তির এক-তৃতীয়াংশ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
ক্রাউন প্রিন্স সৌদি আরবকে একটি ‘মধ্যপন্থি ও খোলা’ সৌদি আরব গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছেন। আর এজন্যই চলছে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। যার বড় অংশ ব্যয় হবে বিনোদন ও পর্যটন খাতে। তরুন এই যুবরাজ সৌদি আরবকে বদলে দেয়ার কাজে কতটা সফল হোন তা দেখার বিষয়। তবে একথাও সত্য পবিত্র দুই মসজিদের খাদেমের খোলামেলা এমন কর্মসূচী শুধু সৌদি নাগরিক নয় বিশে^র বহু মানুষকেও আহত করছে।