আর্ন্তজাতিক রাজনীতিতে স্থায়ী শত্রু-মিত্র বলে কিছু নেই। জাতীয় স্বার্থে নির্ভর করে অন্য দেশের সাথে বন্ধুত্বের সর্ম্পক। আজ যে দেশ বন্ধুর ভুমিকায় থাকে কাল সে দেশ হতে পারে শত্রু। এর বড় উদহারন তুরস্ক -রাশিয়া ঘনিষ্ট সর্ম্পক। ন্যাটো সদস্য ভুক্ত দেশ তুরস্ক এখন রাশিয়ার ঘনিষ্ট মিত্র। অথচ দুদেশের ঐতিহাসিক সর্ম্পক মোটেও সুখকর ছিলো না। ওসমানীয় শাসনামলে তুরস্কের সাথে রাশিয়ার একাধিক যুদ্ধ হয়েছে। স্নায়ু যুদ্ধের সময়ে ন্যাটোর প্রভাবশালী দেশে পরিনত হয় তুরস্ক। কিন্তু তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েব এরদোগান আর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পরস্পরের বন্ধু। এই বন্ধুত্ব দৃশ্যমান। যা ইউরোপের দেশগুলোর জন্য হয়ে উঠেছে উদ্বেগজনক। এরদোগান ও পুতিনের এই বন্ধুত্বের রসায়ন আমরা বোঝার চেষ্টা করবো।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোগান এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে এখন প্রায়ই টেলিফোনে কথা হয়। এমনকি সুযোগ পেলে দুনেতার মধ্যে দেখা সাক্ষাত হয়। যেমন ২৭ আগস্ট হঠাৎ করে এরদোগান চলে গেলেন মস্কো। রাশিয়ার এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ এর প্রদর্শনী ঘুরে দেখলেন। বেশ কিছু রাশিয়ার যুদ্ধ বিমান কেনার বিষয় নিয়ে আলোচনা হলো। রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ ক্ষেপনাস্ত্র ব্যবস্থা কেনার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোভুক্ত ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথে তুরস্কের সর্ম্পক এখন শীতল। যুক্তরাষ্ট্র এফ-৩৫ স্টেলথ ফাইটার না দেয়ার কারনে যে রাশিয়ার দিকে ঝুকে পড়ছে তুরস্ক।
শুধু সমরাস্ত্র কেনার বিষয়ে যে দুনেতার মধ্যে আলোচনা হচ্ছে তা নয়। সিরিয়া সঙ্কট ও মধ্যপ্রাচ্যের নানা ইস্যুতে দুনেতা কথা বলছেন। পুতিনের সাথে এরদোগানের বন্ধুত্বের মুলে ভূরাজনৈতিক সর্ম্পকের নানা যোগ বিয়োগ রয়েছে। কারন মধ্যপ্রাচ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প খেলোয়াড়ের আসন থেকে ছিটকে এখন নিছকই অস্ত্রব্যবসায়ীর ভুমিকায়। আর কেজিবির এজেন্ট পুতিন হয়ে উঠেছেন মধ্যপ্রাচ্যের মুখ্য খেলোয়াড়।
সিরিয়ার বিপুল সংখ্যক শরনার্থীর আশ্রয় দিয়েছে তুরস্ক। এদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো এখন এরদোগানের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ কারনে তুরস্ক চাইছে সিরিয়ার সীমান্তের সেফ জোন প্রতিষ্টা করতে। তুরস্কের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দরকার পুতিনের সমর্থন। কারন আসাদ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে সবচেয়ে বড় ভুমিকা রেখেছে পুতিন। আসলে সিরিয়ার সাথে একটি বোঝাপড়ায় আসতে রাশিয়ার ভুমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। এরদোগান জানেন সীমান্ত সুরক্ষিত করতে পুতিনের সাথে তাকে বোঝাপড়ায় আসতে হবে।
পশ্চিমা গনমাধ্যমে বেশ কিছুদিন থেকে এরদোগানকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে তুলনা করা হচ্ছে। এই সর্ম্পক কতটা গভীর তার একটি উদহারন হচ্ছে, এরদোগান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর অভিনন্দন জানিয়ে প্রথম টেলিফোনটি আসে প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাছ থেকে। ২০১৬ সালে তুরস্কে যে ব্যর্থ অভ্যুন্থানের পর পুতিন কথা বলেন এরদোগানের সাথে। এই অভ্যুন্থানের পেছনে পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পৃক্ততার বেশ কিছু তথ্য রাশিয়ার কাছ থেকে তুরস্ক পেয়েছে বলে মনে করা হয়।
পশ্চিমা বিশ্ব এরদোগানকে এক ধরনের উপেক্ষার দৃষ্টিতে দেখতে চায়। এই উপেক্ষার নীতি এখন ইউরোপের নিরাপত্তা ঝুকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। ন্যাটোভুক্ত ২৯ দেশের মধ্যে তুরস্কের সেনাবাহিনী দ্বিতীয় বৃহত্তম। সোভিয়েত ইউনিয়ন আমলে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার স্বার্থে ন্যাটো জোট গঠন করা হয়। এখন রাশিয়ার সাথে তুরস্কের ঘনিষ্টতায় যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ইউরোপীয় দেশগুলো এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়েছে।
ন্যাটোর সদস্য দেশ তুরস্ক এখন রাশিয়ার অস্ত্র ক্রেতা দেশগুলোর একটিতে পরিনত হয়েছে। পুতিনের জন্য এর চেয়ে সুখের খবর আর কী হতে পারে! আর এরদোগান ইউরোপকে চাপে রাখতে পুতিন কার্ড খেলছেন। ইউরোপে রাশিয়ার যে কোনো হস্তক্ষেপে বাফার হিসাবে কাজ করবে তুরস্ক। ক্রাইমিয়া দ্বীপ দখল আর ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যদিয়ে পুতিন ইউরোপকে বার্তা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রতার সীমা তিনি কতটুকু মেনে নেবেন।
আসলে কৃষঞ সাগর ও বলকান অঞ্চলে রাশিয়া যদি প্রভাব বাড়াতে চায় তাহলে তুরস্ককে দরকার। এই সুযোগে পূর্ব ইউরোপের অটোম্যান সাম্র্যাজ্যর অধীনে থাকা দেশগুলোতে প্রভাব বাড়াচ্ছে আঙ্কারা। কসোভো, আলবেনিয়া আর বসনিয়ায় এরদোগান আপন মানুষ।
ইউরোপের এখন যে নিরাপত্তার শঙ্কা তার মুুলে রয়েছে ন্যাটোর দূর্বল অবস্থান। যার ভিত্তি তৈরি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। আর ইউরোপের দেশগুলোরে বিভক্তি এবং উগ্র ডানপন্থীদের উন্থান ঐক্যবদ্ধ ইউরোপের চেতনায় ধ্বস নামিয়েছে। পুতিনের সাথে ঘনিষ্টতায় ইউরোপের চোখে এরদোগান ভিলেন। কিন্তু এরদোগান খুব ভালো ভাবে উপলদ্ধি করতে পারছেন যে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের জন্য ইউরোপের দেশগুলোর চেয়ে রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্ব অনেক বেশি কার্যকর।
পুতিনের সাথে এরদোগানের এই বন্ধুত্ব এরদোগানের জন্য বড় ধরনের ঝুকির কারন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে পড়ার পুতিন যেমন রাশিয়াকে বিশ্ব রাজনীতির রঙ্গ মঞ্চে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে হাজির করেছেন। তেমনি এরদোগানও উসামানীয় খিলাফতের সুলতানদের মতো মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির প্রধান নিয়ন্ত্রকের ভুমিকা পালন করেছেন। কিন্তু আঞ্চলিক ইস্যুতে দুনেতার বোঝাপড়ার মধ্যে সমরাস্ত্র বানিজ্য গুরুত্বপূর্ন ইস্যু হয়ে দেখা দিয়েছে।
তুরস্কের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সর্ম্পকের টানাপড়েন সৃষ্টি হয় রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ কেনাকে কেন্দ্র করে। ইতোমধ্যে রাশিয়ার এই আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তুরস্কের হাতে এসে পৌছেছে। ন্যাটো কোনো সদস্য দেশের রাশিয়ার সমরাস্ত্রের সাথে সম্পৃক্ততার উদ্যেগ অকল্পনীয় ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি দেখছে, ইউরোপসহ এ অঞ্চলে কৌশলগত মিত্রতার বন্ধনে থাকা দেশগুলোর ওপর রাশিয়ার আঘাত হিসাবে। এস-৪০০ কেনা থেকে তুরস্ককে বিরত রাখার জন্য নানা ভাবে চাপপ্রয়োগ করছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু প্রেসিডেন্ট এরদোগান রাশিয়ার সাথে করা চুক্তি থেকে সরে আসতে অপরাগতার কথা জানিয়ে দেন। এরপর প্রতিরক্ষা সহযোগিতার আরো নানা দিক নিয়ে রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্টতা বাড়াতে থাকে তুরস্ক।
এরপর যুক্তরাষ্ট্র এফ-৩৫ সরবরাহ বন্ধ করার ঘোষণা দেয়। এমনকি অবরোধ আরোপের হুমকি দেয়। এখন এফ-৩৫ বিকল্প কেনার চিন্তা করছে তুরস্ক। এরদোগানের মস্কো সফরে সুখোই সু-৫৭ স্টেলথ ফাইটার জেট ও সু-৩৫ কেনার ব্যাপারে আগ্রহী তুরস্ক। ন্যাটোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে রাশিয়ার সমরাস্ত্র এ অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যবস্থার চিত্র বদলে দিতে যাচ্ছে।
ভূরাজনৈতিক নানা হিসাবে পুতিন এখন এরদোগানের বন্ধু। এই বন্ধুত্বের পেছনে দুজনের একনায়কতান্ত্রিক মানসিকতা কাজ করছে বলে অনেকে মনে করেন। অবশ্য পুতিনের ক্ষমতায় টিকে থাকার কৌশল আর এরদোগানের রাজনৈতিক কৌশল এক নয়। ভ্লাদিমির পুতিন তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে জেলে ভরে, রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে, ডান্ডা দিয়ে পিটিয়ে রাজনীতির মাঠ আগে পরিস্কার করেছেন। অপরদিকে এরদোগান পশ্চিমা গনতন্ত্রের পথ বেয়ে ক্ষমতার মগডালে গেছেন। ভোটের রাজনীতির মাধ্যমে তিনি ক্ষমতা সংহত করেছেন। পুতিনের মতো নির্বাচন তাকে করতে হয়নি। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে দুজনের বিরুদ্ধে রয়েছে সমান অভিযোগ।
বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তির একজন নাম ভ্লাদিমির পুতিন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়াকে আবার বিশ্বের প্রভাবশালী দেশে পরিনত করেছেন পুতিন। যিনি ২০ বছর ধরে দেশটির ক্ষমতায় আছেন। নিজ দেশে লৌহমানব হিসেবে পরিচিত হলেও অনেকে মনে করেন তিনি একজন নিকৃষ্ট স্বৈরাচার। হিলারি ক্লিনটনের ভাষায় পুতিন পাতলা চামড়ার শক্ত নেতা।
১৯৫২ সালের ৭ অক্টোবর এক শ্রমিক পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন ভ্লাদিমির পুতিন। ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পুতিন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে রুশ প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বরিস ইয়েলৎসিন আকস্মিকভাবে পদত্যাগ করার প্রেক্ষাপটেই তার এই দায়িত্বভার গ্রহণ। ২০০০ সালের ২৬ মার্চ তিনি রাশিয়ান ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ২০০৪ সালের ১৫ মার্চ তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কিন্তু সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতাজনিত কারণে পুতিন ধারাবাহিকভাবে তৃতীয় মেয়াদের জন্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। পরে ২০০৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তার উত্তরসূরি হিসেবে দিমিত্রি মেদভেদেভ জয়লাভ করেন। এতে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেয়ার মাত্র দুই ঘণ্টার মাথায় মেদভেদেভ রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভøাদিমির পুতিনকে মনোনীত করেন। ২০০৮ সালের ৮ মে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দাফতরিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন পুতিন। ২০১২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি তৃতীয় মেয়াদে জয়লাভ করেন। তার এ মেয়াদকাল ছয় বছর। ভ্লাদিমির পুতির লেখাপড়া করেছেন আইন বিষয়ে। চাকরি করেছেন গোয়েন্দা সংস্থায়। তিনি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির একজন দুর্ধষ এজেন্ট ছিলেন।
অপরদিকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোগান রাজনীতির মধ্যদিয়ে ক্ষমতার শীর্ষে এসেছেন। জন্ম ১৯৫৪ সালে। ছাত্র অবস্থায় ইসলামপন্থী রাজনীতির সাথে ছিলেন সম্পৃক্ত। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন ইস্তাম্বুলের মেয়র। ২০০২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর সংবিধান সংশোধন করে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বাড়িয়ে হয়েছেন প্রেসিডেন্ট। তিনি ১৭ বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন। পুতিনের মতো নিষ্টুর ভাবে না হলেও তিনিও বিরোধী দলগুলোকে কোনঠাসা করে রেখেছেন। একনায়কতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারনে দল থেকে চলে গেছেন অনেক সিনিয়র নেতা। অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষক মনে করেন পুতিনের সাথে এরদোগানের এই মিল দুজনের বন্ধুত্বকে আরো জোরালো করেছে।