সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে তুরস্ক। অভিযানে তুর্কি বাহিনীর মূল লক্ষ্য, ওই অঞ্চল কুর্দি নেতৃত্বাধীন মিলিশিয়ামুক্ত করা। এ ছাড়া তুরস্কে অবস্থানরত ৩৬ লাখ শরণার্থীর জন্য বাসস্থান নির্মাণ করা। এই অভিযানের সমালোচনা করছে ইউরোপীয় দেশগুলো। যুক্তরাষ্ট্র এই অভিযানে সবুজ সংকেত দিয়ে এখন তুরস্কের সমালোচনা করছে। রাশিয়া নীরব ভুমিকা পালন করছে। আজ আমরা তুরস্কের এই অভিযান ও কুর্দি সঙ্কটের দিক নিয়ে আলোচনা করব।
কুর্দি সম্প্রদায় মধ্যপ্রাচ্যর চতুর্থ বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী। মেসোপটেমিয়ান সমতল ভূমি ও পাহাড়ি অঞ্চলের একটি নৃতাত্বিক গোষ্ঠী এই কুর্দিরা। বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্ক, উত্তর-পূর্ব সিরিয়া, উত্তর ইরাক, উত্তর-পশ্চিম ইরান এবং দক্ষিণ-পশ্চিম আর্মেনিয়া অঞ্চলে তারা ছড়িয়ে রয়েছে। সংখ্যায় বড় হলেও তাদের বেশির ভাগই রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী হিসেবে বসবাস করছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ও উসমানি সালতানাতের পতন ঘটার পর কুর্দিরা একটি স্বাধীন কুর্দি-রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানায়। বিংশ শতকের শুরুর দিকে কুর্দিদের অনেকে নিজেদের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা করে - যেটি কুর্দিস্তান হিসেবে পরিচিত হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে জয়ী পশ্চিমা জোট ১৯২০ সালের সেভর চুক্তি অনুযায়ী কুর্দিদের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠনের আশ্বাস দেয়। কিন্তু তিন বছর পরই ঐ সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যায় যখন লুজান চুক্তি অনুসারে আধুনিক তুরস্কের সীমানা নির্ধারিত হয় এবং কুর্দিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হয়নি।
পরের ৮০ বছরে নিজেদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনের জন্য কুর্দিরা নানা ভাবে চেষ্টা করে। এরমধ্যে সশস্ত্র আন্দোলনের পথ বেছে নেয়া হয়। ১৯৭৮ সালে কুর্দি নেতা আবদুল্লাহ ওজালান কুর্দিস্থান ওয়াকার্স পার্টি বা পিকেকে গঠন করেন। যাদের প্রধান দাবি ছিল তুরস্কের মধ্যে স্বাধীন একটি রাষ্ট্র গঠন কার। দলটি গঠন করার ছয় বছর পর সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত ৪০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। ২০১৩ সালে তুরস্ক সরকারের সাথে আলোচনার পর যুদ্ধবিরতিতে আসে পিকেকে। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে যুদ্ধবিরতি অকার্যকর হয়ে পড়ে। এরপর নতুন করে তুরস্কের সেনাবাহিনী ও পুলিশের ওপর হামলা চালায়। এর ধারাবাহিকতায় তুরস্কের সরকার পিকেকের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। যা এখনও অব্যাহত আছে।
সিরিয়ায় আসাদ সরকারে উৎখাতে তুরস্ক, সৌদি আরব ও পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট অনেকগুরো সশস্ত্র সংগঠন লড়াই শুরু করে। সিরিয়ার বেশ কিছু এলাকা আইএসের নিয়ন্ত্রনে যায়। কুর্দি সশস্ত্র সংগঠনগুলো এ সময় তুরস্কের সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থান করে। যা ছিলো তুরস্কের জন্য বড় ধরনের নিরাপত্তার হুমকি। এমন পরিস্থিতিতে তুরস্ক এই এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আশ্রয় নেয়া সিরিয়ান শরনার্থীদের জন্য নিরাপদ এলাকা বা সেফ জোন গঠনের প্রস্তাব করেন। কিন্তু তাতে পশ্চিমা বিশ্বের সাড়া পায়নি তুরস্ক। ফলে তুরস্ক সামরিক অভিযান শুরু করে।
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই পশ্চিমা সমর্থন নিয়ে কুর্দি সংগঠনগুলো সংগঠিত হতে থাকে। সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অভিযানে মার্কিন সেনাদের সাথে যৌথভাবে কাজ করে কুর্দি যোদ্ধারা। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে বেশ কিছু এলাকা নিয়ে তুরস্ক সীমান্তের কাছাকাছি স্বাধীন অঞ্চল প্রতিষ্টা করে কুর্দিরা। তারা এই উপত্যকার নাম দিয়েছিল রোজাভা। ধীরে ধীরে অন্যান্য কুর্দি সশস্ত্র আঞ্চলিক দলও তাদের সাথে যোগ দেয় । এক পর্যায়ে সিরিয়ান ডেমোক্রাটিক ফোর্স বা এসডিএফ গঠিত হয়। তুরস্কের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পিকেকে বা ওয়াইপিজির মতো সংগঠনগুলো এই জোটে যুক্ত হয়। যা তুরস্কের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাড়ায়।
এমন পরিস্থিতিতে ২০১৬ সালের আগস্টে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে সেনা উপস্থিতি বাড়াতে থাকে তুরস্ক। সেসময় সীমান্তের ওপারে সেনাসদস্য ও ট্যাঙ্ক পাঠিয়ে ঐ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান শহর জারাবান্টুস দখল করে তুর্কি বাহিনী। এর ফলে কুর্দি বিদ্রোহী বাহিনী ওয়াইপিজির নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্স ঐ অঞ্চলের দখল নিতে ব্যর্থ হয় এবং আফরিন শহরের কুর্দি ঘাঁটির সাথে যুক্ত হয়।
২০১৮ সালে তুরস্কের বাহিনী এবং তাদের সাথে থাকা সিরিয়ান বিদ্রোহীরা আফরিন থেকে কুর্দি মিলিশিয়া বাহিনী ওয়াাইপিজি'র যোদ্ধাদের উৎখাত করে। তুরস্কের অভিযোগ ওয়াইপিজি এবং পিওয়াইডি পিকেকে'র সাথে সম্পৃক্ত সংস্থা এবং তারা সশস্ত্র তৎপরতার মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই পিকেকে’কে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে ঘোষণা করেছে। অপর দিকে সীমান্তের ওপারে সিরিয়ায় ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠে ওয়াইপিজি ও তাদের সহযোগী কুর্দি মিলিশিয়ারা। ২০০৪ সাল থেকেই সেখানে সক্রিয় রয়েছে এই মিলিশিয়ারা।
সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে তুরস্কের সেনাবাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পর ইউরোপীয় দেশগুলো তুরস্কের কঠোর সমালোচনা করছে। কয়েকটি দেশ তুরস্কের কাছে অস্ত্র বিক্রি করতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। আরব দেশগুলো তুরস্কের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ইসরাইলও কুর্দিদের পক্ষে জোরালো সমর্থন প্রকাশ করেছে। রাশিয়া নীরব রয়েছে। বিভিন্ন দেশের এমন অবস্থানের কারন কী?
কুর্দিদের বিরুদ্ধে তুরস্কের অভিযানে দুই পক্ষের মধ্যে আটকে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। তুরস্ক ও কুর্দি নেতৃত্বাধীন মিলিশিয়া উভয়পক্ষই যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হিসেবে পরিচিত। অভিযান শুরুর কয়েক দিন আগে ট্রাম্পের সাথে ফোনালাপ করেন এরদোগান। এর পরপরই সিরীয় অঞ্চলটি থেকে মার্কিন সেনাদের প্রত্যাহার করে নেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি চাইছেন না আমেরিকান সৈন্যরা দেশের বাইরে কোন 'অন্তহীন' অপ্রয়োজনীয়' যুদ্ধে জড়িত থাকুক।
কুর্দি নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনী সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্স বা এসডিএফ ট্রাম্পের সেনা প্রত্যাহারকে ‘পেছন থেকে ছুরি মারা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। সমালোচনার মুখে ট্রাম্প তুরস্ককে হুমকি দিয়েছেন, কুর্দিদের বিরুদ্ধে অভিযানে সীমা ছাড়ালে তুরস্কের অর্থনীতি ধ্বংস করে দেবে যুক্তরাষ্ট্র। অভিযান শুরুর পরে অবশ্য দুই পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছেন ট্রাম্প।
কুর্দিদের স্বাধীন রাষ্ট্রের সমর্থন করে না ইরান। তবে ইরানের মিত্র সিরিয়ার ভূখন্ড তুরস্কের নিয়ন্ত্রনে থাকুক তাও ইরানের কাম্য নয়। সে কারনে তুরস্কের অভিযানের তেহরান সমালোচনা করলেও তা জোরালো নয়। রাশিয়া অনেকটা নীরব অবস্থানে রয়েছে। কারন সিরিয়ার ওপর রাশিয়ার পূর্ন নিয়ন্ত্রন রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহারের পর এ অঞ্চলে রাশিয়ার কর্তৃত্ব আরো বেড়েছে। আবার তুরস্কের সাথে রাশিয়ার সর্ম্পক ঘনিষ্ট হচ্ছে। তুরস্কের এই অভিযানে একটি মাত্রা পর্যন্ত রাশিয়ার সমর্থন থাকবে। তবে তুরস্কের এই অভিযানের কঠোর সমালোচনা করেছে ইসরাইল। কারন কুর্দিদের পেছনে দীর্ঘদিন থেকে ইসরাইলের সমর্থন আছে। ইরাক, তুরস্ক ও ইরানের ভূখন্ড নিয়ে স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্রের ধারনা সব সময় ইসরাইল গোপনে ও প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে আসছে। একাধিক কুর্দি সংগঠনের রয়েছে ইসরাইলের সমর্থন।
ইউরোপী দেশগুলো এই অভিযানের বিরোধিতা করছে। কারন কুর্দি যোদ্ধাদের মাধ্যমে তুরস্কের ওপর নানা ভাবে চাপ সৃষ্টি করতে পারে ইউরোপীয় দেশগুলো। একই নীতি নিয়েছে সৌদি আরবসহ আরব দেশগুলো। অথচ এক সময় কুর্দি যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ছিলো আরব দেশগুলো। এই সংঘাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন দেশ সিরিয়া কুর্দিদের সাথে আলোচনার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছে। আবার তুরস্কের সেনা অভিযানের বিরোধিতা করছে।
সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে এই অভিযানের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট এরদোগান বড় ধরনের ঝুকি নিয়েছেন। আর্ন্তজাতিক নানা শক্তি এখন এই খেলায় জড়িয়ে পড়তে পারে। যাতে তুরস্ক বড় ধরনের ঝুকির মুখে পড়তে পারে। কিন্তু তারপরও কেন তিনি এই ঝুকি নিলেন?
এই অভিযানে তুরস্কের প্রকাশ্য ঘোষিত লক্ষ্য হলো উত্তর-পূর্ব সিরিয়া থেকে কুর্দি যোদ্ধাদের তাড়ানো এবং সেখানে একটা 'নিরাপদ এলাকা' প্রতিষ্টা। যেখানে বাস্তুচ্যুত সিরিয়ানদের বসতি প্রতিষ্টা করা যায়। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেজেপ তাইয়েপ এরদোয়ান চাইছেন, সীমান্ত থেকে সিরিয়ার ভেতরে ২০ মাইল পর্যন্ত এলাকায় এই বসতি স্থাপন। যদি সত্যি ২০ লাখ সিরিয়ান শরণার্থীকে এখানে বসতি স্থাপন করাতে সক্ষম হন - তাহলে এই এলাকার পরিস্থিতি বদলে যাবে। সিরিয়ানরা নিজ আবাস ভুমিতে চলে যাবে। একই সাথে তুরস্কের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। সীমান্তে সিরিয়ান কুর্দি ওয়াইপিজি সংগঠনের যে মিলিশিয়ারা আছে তাদের দূরে ঠেলে দেয়া সম্ভব হবে। তুরস্কের বিশাল সশস্ত্রবাহিনীর মোকাবিলা করার মতো ভারী মেশিনগান, বিমান-বিধ্বংসী কামান বা ট্যাংক ধ্বংসকারী অস্ত্র তাদের নেই।
এই অভিযানের পেছনে তুরস্কের আভ্যন্তরিন রাজনীতি একটি গুরুত্বপূর্ন ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করছে। সম্প্রতি মেয়র নির্বাচনে অধিকাংশ শহরে একে পার্টি হেরেছে। এর অন্যতম কারন সিরিয়ার শরনার্থী সমস্যা। অনেক তুর্কি মনে করেন সিরিয়ান শরনার্থীরা তাদের জন্য বোঝা হয়ে দেখা দিচ্ছে। এরদোগান সরকার তাদের আশ্রয় দিলেও এখন ফেরত পাঠাতে পারছে না। শরনার্থীদের ফেরত পাঠানোর জন্য এমন একটি সামরিক অভিযানকে তুরস্কের প্রায় সব রাজনৈতিক দল সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এরদোগান যদি এই অভিযানে সফল হন তাহলে তার জনপ্রিয়তা বাড়বে। আরেকবার একে পার্টির ক্ষমতায় ফিরে আসার পথ প্রশস্ত হবে।