যুক্তরাষ্ট্র ইরান কী সমঝোতার পথে হাটছে

ইরান-যুক্তরাষ্ট্র বিরোধ - সংগৃহীত

  • আলফাজ আনাম
  • ১০ জানুয়ারি ২০২০, ১৫:৪৯


ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর কুদস ফোর্সের কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলায়মানি যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় নিহত হওয়ার পর ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের সর্ম্পকে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিলো তা অনেকটা কমে এসেছে। ইরাকে দুটি মার্কিন ঘাটিতে মিসাইল হামলার পরও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পাল্টা কোনো ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেননি। বরং তিনি বলেছেন ইরান পরমানু অস্ত্র বানানোর পরিকল্পনা বাদ দিলে দেশটির সাথে আলোচনায় বসতে তিনি প্রস্তুত। প্রশ্ন হলো যুক্তরাষ্ট্র কী ইরানের সাথে সমঝোতার পথে হাটছে? 


ইরাকে আল আসাদ ও ইরবিল বিমান ঘাটি লক্ষ্য করে ইরানের ক্ষেপনাস্ত্র ছোড়ার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প টুইটারে প্রথম যে প্রতিক্রিয়া দেন তা ছিলো সব কিছু ঠিক আছে। কী ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার মুল্যায়ন করা হচ্ছে। আমাদের আছে বিশ্বের সেরা সেনাবাহিনী ও আধুনিক প্রযুক্তি। বিশ্বের যে কোনো জায়গায় আমরা আঘাত হানতে পারি। ইরান এই হামলার পর দাবি করে ৮০ জন সৈন্য মারা গেছে। কিন্তু নিরপেক্ষ কোনো সূত্র থেকে এই দাবির কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। আর্ন্তজাতিক গনমাধ্যমগুলো ঘটনাস্থলের যে বিবরন প্রকাশ করে তাতে দেখা যায় মার্কিন ঘাটি থেকে বেশ দূরে ক্ষেপনাস্ত্রগুলো আঘাত হেনেছে।


এরমধ্যে ইরাকের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী আদেল আব্দুল মাহদি জানান, এই হামলার আগে ইরানের পক্ষ থেকে মৌখিকভাবে তাকে অবহিত করা হয়েছিলো। ইরাকি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ইরানের হামলা সর্ম্পকে আগেই যুক্তরাষ্ট্র জেনে থাকতে পারে। সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ট্রাম্প প্রশাসনের অনেকে মনে করেন ইরান ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষেপনাস্ত্র এমন ভাবে ছুড়েছে যাতে কোনো সৈন্য হতাহত না হয়। তাদের ধারনা এই ক্ষেপনাস্ত্র ছোড়ার মধ্যদিয়ে ইরান একটি বার্তা দিতে চেয়েছে। যদিও একজন জেনারেল ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তাদের এ মতের সাথে একমত হননি। তার মতে ইরাকে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা পর্যাপ্ত প্রতিরোধ মুলক ব্যবস্থা নেয়ার কারনে ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো গেছে।


ইরানের এই হামলার দীর্ঘ সময় পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে বিবৃতি দেন তাতে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ইরানের হামলায় কোনো সৈন্য নিহত হয়নি। শুধু তাই নয়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আরো বলেছেন ইরান যদি পারমানবিক কর্মসূচী পরিত্যাগ করে তাহলে তিনি দেশটির সাথে বসতে প্রস্তুত আছেন। তিনি প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় কখনোই ইরানকে পারমানবিক অস্ত্রের অধিকারী হতে দেবেন না। এর আগে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তারা সংঘাত চান না। নতুন করে আর কোনো হামলা চালানো হবে না।
ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র কোনো পক্ষই যুদ্ধই চায় না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বার বার বলে আসছেন তিনি যুদ্ধ বা অন্য কোনো দেশে রেজিম চেঞ্জের বিরোধী। ইরানের ক্ষেত্রেও তিনি অবরোধ আরোপের মাধ্যমে দেশটিকে নতি স্বীকার করাতে চান সামরিক উপায়ে নয়। এমন কথা আগেও বলেছেন। কিন্তু এরপরও ইরানি জেনারেলকে কেন হত্যা করা হয়েছিলো তা একটি বড় প্রশ্ন। কারন এই জেনারেলকে হত্যার পর পরিস্থিতি যে জটিল হবে তা অনুধাবন করা খুব সহজ বিষয়। এখানে কী তৃতীয় কোনো পক্ষের ভুমিকা আছে? আসুন জেনে নেই এ নিয়ে ভিন্নমত কিভাবে উঠে এসেছে


জেনারেল কাসেম সুলায়মানি নিহত হওয়ার পর ইরাকের পার্লামেন্টে দেয়া ভাষনে দেশটির প্রধানমন্ত্রী আদেল আল মাহদি বলেছেন তার সাথে সুলায়মানির সকাল আটটায় বৈঠকের সময় নির্ধারন করা ছিলো। সুলায়মানি ভোরে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় নিহত হন। বৈঠকের বিষয়বস্তু সর্ম্পকে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি সৌদি আরবের সাধে ইরানের বিরোধ নিস্পত্তির মধ্যস্থতা করছিলেন। সুলায়মানি ইরানের সব্বোচ  ধর্মীয় নেতার একটি বার্তা নিয়ে এসেছিলেন। অনেকে মনে করেন ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে পেছনের দরজা দিয়ে আলোচনার পথ বন্ধ করতে তৃতীয় কোনো পক্ষ তাকে হত্যার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রকে প্ররোচিত করেছে। এই পক্ষটি হতে পারে ইসরাইল কিংবা আরব আমিরাত। ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের দুতাবাসে হামলার সময় একজন কন্ট্রাক্টর নিহত হয়। এতে যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্র শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা ক্ষুদ্ধ হন। তাদের দিক থেকেও ট্রাম্প প্রশাসনের ওপর চাপ ছিলো।


কাসেম সুলায়মানির হত্যাকান্ডের পর ইরানে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় তা নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়। বেশির ভাগ আইন প্রনেতা মনে করেন এ ধরনের সিদ্ধান্ত ছিলো হঠকারিতা ও আর্ন্তজাতিক আইনের লঙ্ঘন। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক আইন প্রনেতা শঙ্কা প্রকাশ করেন যে এতে মধ্যপ্রাচ্যে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা আরো বেশি অনিরাপদ হয়ে উঠতে পারে। ইরানের একজন সাবেক কূটনীতিকের বরাত দিয়ে তুরস্কের সরকার ঘনিষ্ট ডেইলি সাবাহর খবরে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র একটি আরব দেশের মাধ্যমে ইরানের কাছে বার্তা পাঠায় , প্রতিশোধমুলক ব্যবস্থা না নিলে ইরানের অবরোধ প্রত্যাহারসহ অর্থনৈতিক ব্যাপারে ইরানকে ছাড় দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন ইরানের আভ্যন্তরিন চাপের কারনে সীমিত আকারের পদক্ষেপের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সবুজ সংকেত ছিলো। এরপর ইরান সর্তকতার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের স্থাপনায় হামলা করেছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন তারা সীমিত আকারে আঘাত করেছেন। তুরস্ক ও রাশিয়া পর্দার আড়ালের এই সমঝোতা নিয়ে সম্ভবত আগেই অবহিত ছিলো। দেশ দুটি ছিলো অনেকটা নির্লিপ্ত। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন পূর্ব নির্ধারিত সফরে তুরস্ক আসেন। এর আগে তিনি সিরিয়া সফর করেন।


দীর্ঘদিন থেকে অবরোধের কারনে ইরানের পক্ষে বড় আকারের যুদ্ধ করা সক্ষম নয়। অপরদিকে ট্রাম্প প্রশাসনও এখন পর্যন্ত বড় আকারের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েনি। আফগানিস্তানসহ বিদেশে সৈন্য সংখ্যা কমিয়ে আনার ব্যাপারে নানা ভাবে উদ্যেগ নিয়েছে। এরপরও ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধে কোন পক্ষ লাভবান হলো?
কাসেম সুলায়মানি হত্যার পর ইরানের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো ইরাকের পার্লামেন্টে সব বিদেশি সৈন্য না রাখার ব্যাপারে প্রস্তাব পাস হওয়া। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের ইরাকে অবস্থানের বৈধতার সঙ্কট তৈরি হয়েছে। ইরাকে ভবিষ্যতে যারা সরকার গঠন করুক না কেন তাদের ওপর ইরানের ব্যাপক প্রভাব থাকবে। ইতোমধ্যে ইরাকের প্রভাবাশালী শিয়া নেতা মুকতাদা আল সদর শিয়া মিলিশিয়া গ্রুপ গুলোকে নতুন করে হামলা না করে ইরাকে সরকার গঠনের দিকে মনোযোগি হওয়ার আহবান জানিয়েছেন। ইরাক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহার করা হলে, দেশটির ওপর ইরানের নিয়ন্ত্রন আরো বেড়ে যাবে। এ কারনে ইরানের কৌশল হচ্ছে কিভাবে ইরাক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহার কার যায়। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন এই নীতি থেকে ইরান সরে আসবে না। চাপ প্রয়োগের জন্য ইরাকে প্রক্্ির যুদ্ধ অব্যাহত রাখবে ইরান। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের ইরাকে থাকা আগের চেয়ে কঠিন হবে।


প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুরু থেকেই বিদেশে সৈন্য রেখে বিপুল অর্থ খরচের বিরুদ্ধে। তিনি বলেছেন মধ্যপ্রাচ্যের তেলের কোনো প্রয়োজন আমেরিকার নেই। কারন তাদের নিজ দেশে বিপুল তেলের মজুদ রয়েছে।' তিনি মধ্যপ্রাচ্যে অধিকতর ভূমিকা নেওয়ার জন্য নেটো জোটকে বলবেন বলে জানেিয়ছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দীর্ঘদিন থেকে জার্মানীনসহ ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর সামরিক ব্যয় বাড়ানোর জন্য চাপ দিয়ে আসছেন। এখন মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ন্যাটোর ভুমিকা বাড়ানোর দিকে তিনি মনোযোগি হবেন।
কাসেম সুলায়মানির মৃত্যুর পর ইরানের ক্ষমতাসীন মহল আভ্যন্তরিন রাজনীতিতে সুবিধা পেয়েছে। ইরানে বেশ কিছুদিন থেকে বেকারত্ব, তেলসহ অন্যান্য পন্যর দাম বেড়ে যাওয়ার কারনে যে বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিলো তার মোড় ঘুড়ে গেছে। ইরানের মানুষ এ অবস্থার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধকে দায়ী করছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইরানিদের পুরানো ক্ষোভ নতুন করে প্রকাশ পেয়েছে। কাসেম সুলায়মানির মৃত্যু ইরানি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে।  প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের ওপর আরো অবরোধ আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। অপরদিকে ইরান পারমানবিক চুক্তি না মানার ঘোষণা দিয়েছে। আগামি দিনে ইরানের পরমানু কর্মসূচী নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয় কিনা তার ওপর নির্ভর করবে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সর্ম্পকের গতিপথ।