সিরিয়ার ইদলিবের নিয়ন্ত্রন নিয়ে ভূরাজনৈতিক জটিলতা নতুন রুপ নিয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বেশ চাপের মুখে পড়েছেন। ইদলিবে কার্যত তুরস্ক, রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে প্রক্সি যুদ্ধ চলছে। সমাঝোতা না হলে এই ছায়া যুদ্ধ মুখোমুখি রুপ নিতে পারে। ফলে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে ন্যাটো। একই সাথে এরদোয়ানের ক্ষমতার ভিত্তি ধ্বসে পড়তে পারে।
সিরিয়ায় ২০১১ সালে শুরু হওয়া সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে নিহত হয়েছে কয়েক লাখ মানুষ। আর ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়েছে দেশটির অর্ধেকেরও বেশি নাগরিক। তাদের বেশিরভাগই আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশি দেশ তুরস্কের আশ্রয় শিবিরে। তুরস্ক ইতোমধ্যেই ৪০ লাখের বেশি সিরিয়ান শরনার্থী আশ্রয় দিয়েছে। ইদলিবে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর আরো ১০ লাখ লোক তুরস্কের দিকে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আঙ্কারা সিরীয় নাগরিকদের তাদের নিজ দেশে ফেরাতে চায়। অন্যদিকে রাশিয়ার সহায়তায় যে কোনও মূল্যে দেশজুড়ে আধিপত্য প্রতিষ্টাতায় মরিয়া আসাদ বাহিনী। ফলে ইদলিবে তুর্কি বাহিনীর সঙ্গে দফায় দফায় সংঘাতে জড়িয়েছে আসাদের অনুগত সেনারা। এমন পরিস্থিতিতে রাশিয়ার সঙ্গেও তুরস্কের সম্পর্কে টানাপড়েন তৈরি হয়েছে।
তুরস্ক সমর্থিত যোদ্ধারা ইদলিবের নিয়ন্ত্রন হারালে শুধু যে শরনার্থীর ঢল নামবে তা নয়, আফরিন থেকে রাস আল আইন পর্যন্ত যে করিডোর প্রতিষ্টা করেছে তা হুমকির মুখে পড়বে। ইদলিবের নিয়ন্ত্রন সিরিয়ার হাতে পুরোপুরি ভাবে চলে গেলে রুশ সমর্থন নিয়ে আসাদ বাহিনী এসব এলাকাতে হামলা চালাবে। এর সাথে নানা প্রক্রিয়ায় কুর্দি যোদ্ধারাও যুক্ত হতে পারে। ফলে তুরস্কের নিরাপত্তা বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়তে পারে।
সিরিয়ান শরনার্থী নিয়ে এরদোয়ান সরকার যথেষ্ট চাপের মুখে রয়েছে। যদি আরো ২০ লাখ শরনার্থী তুরস্কে আশ্রয় নেয় তাহলে দেশটির জনসংখ্যার বিন্যাস পাল্টে যেতে পারে। সিরিয়ানদের সংখ্যা তুরস্কের মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশে পৌছাবে। এই বিপুল সংখ্যক শরনার্থীর বোঝা বহন করা তুরস্কের পক্ষে সম্ভব হবে না। যা আগমি নির্বাচনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। তুরস্কের নিরাপত্তা ও আভ্যন্তরিন রাজনীতির কারনে ইদলিবের নিয়ন্ত্রন তুর্কি সমর্থিত যোদ্ধাদের হাতে রাখতে মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তুরস্ক। ইতোমধ্যে ইদলিবে সৈন্য পাঠিয়েছে আংকারা। যুদ্ধে ১৯ জন তুর্কি সেনা মারা গেছে। ফলে তুরস্কের জনমত ধরে রাখার জন্য ইদলিবের নিয়ন্ত্রন জরুরি।
ইদলিবের নিয়ন্ত্রন নিয়ে তুরস্কের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজ নয়। কারন সিরিয়ান সৈন্যদের সমর্থন দিচ্ছে রাশিয়ার যুদ্ধ বিমান। ফলে রাশিয়ার সাথে তুরস্কের মুখোমুখি অবস্থান তৈরি হচ্ছে। এর ফলে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে যে কৌশলগত সর্ম্পক গড়ে উঠেছে তা হুমকির মুখে পড়েছে। আবার তুরস্কের সাথে রাশিয়ার যে কোনো সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে ন্যাটো। ফলে ইদলিবকে ঘিরে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠতে পারে।
সিরিয়ার আসাদ সরকারকে কূটনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে সমর্থন দিয়ে আসছে রাশিয়া। সিরিয়ার লাটকিয়া বন্দরে আছে রাশিয়ার যুদ্ধ জাহাজ। যা ভূমধ্যসাগরে রাশিয়ার প্রভাব বহুগুন বাড়িয়েছে। এছাড়া সিরিয়ায় রুশ উপস্থিতির কারনে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে রাশিয়া এখন গুরুত্বপূর্ন ফ্যাক্টর হয়ে দাড়িয়েছে। এই বাস্তবতা তুরস্ক খুব ভালো ভাবে উপলদ্ধি করতে পেরেছে। এ কারনে রাশিয়ার সাথে তুরস্ক কৌশলগত সামরিক সর্ম্পক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা উপেক্ষা করে রাশিয়া থেকে এস-৪০০ ক্ষেপনাস্ত্র ব্যবস্থা কিনেছে। সিরিয়া সীমান্তে রুশ ও তুর্কি সৈন্যরা একসাথে টহল কার্যক্রম চালিয়েছে। তুরস্কের সাথে রাশিয়ার এক ধরনের বোঝাপড়া তৈরি হয়েছিলো। দুদেশের মধ্যে বানিজ্য সর্ম্পক বেড়েছে। কিন্তু ইদলিবে বিদ্রোহীদের হটিয়ে আসাদ বাহিনীর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্টার চেষ্টার পর থেকে এই সর্ম্পকে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে। যদিও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রাখতে এরদোয়ানের সাথে কথা বলেছেন পুতিন। দুদেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মধ্যে কথা হয়েছে। এখন ইদলিব নিয়ে এরদোয়ান পুতিন আগামি মাসের প্রথম সপ্তাহে বৈঠক করবেন। এই বৈঠকের ওপর রুশ-তুর্কি সর্ম্পকের গতি প্রকৃতি অনেকখানি নির্ভর করবে। যদিও পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে কোনো সময় বড় আকারের সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে তুরস্কের সামনে একটি পথ খোলা আছে ন্যাটোর সাহায্য নেয়া। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাটিয়ট ক্ষেপনাস্ত্র মোতায়েনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে তুরস্ক। ইউরোপের দেশগুলোকে তুরস্কের পাশে দাড়াতে শরনার্থী কৌশল গ্রহন করতে পারে আংকারা। সিরিয়ার শরনার্থীদের জন্য সীমান্ত ও সাগরপথে ইউরোপে পাঠাতে পারে তুরস্ক। এতে ইউরোপে সিরিয়ান শরনার্থীর ঢল নামতে পারে। যা কোনো ভাবেই চাইবে না ইউরোপ। এ কারনে ইদলিব নিয়ে জার্মান চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেল ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখো কথা বলেছেন পুতিনের সাথে। কিন্তু এর প্রতিটি পদক্ষেপ এরদোয়ানের জন্য হয়ে উঠেছে ঝুকিপূর্ন। কারন জার্মানী ও ফ্রান্সের মতো দেশগুলো এরদোয়ানের বন্ধু নয়। আবার সৌদি আরব ও আরব আমিরাত এরদোয়ানকে সরাতে নানা ভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আসাদ সরকারকে আরব লীগের সদস্য করা হয়েছে। ফলে এরদোয়ানকে নানা পক্ষকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন রুশ-তুরস্ক সর্ম্পকের টানাপড়েনের পেছনে কলকাঠি নাড়ছে ইরান। সিরিয়া যুদ্ধে ইরান শুরু থেকে গুরুত্বপূর্ন খেলোয়াড়। যেখানে শিয়া-সুন্নি বিভাজন মুল ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করছে। সিরিয়া সীমান্তে তুরস্কের সামরিক উপস্থিতি কোনো ভাবেই মেনে নিতে রাজি নয় ইরান। এছাড়া ইদলিবে তুরস্কের নিয়ন্ত্রন ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে বড় বাধা।
ইদলিবের নিয়ন্ত্রন তুর্কি সমর্থিত বিদ্রোহীদের হাতে থাক, তা কোনো ভাবেই চায় না ইরান। এর প্রধান কারন ইদলিবের কৌশলগত অবস্থান। এই এলাকার পাশ দিয়ে গেছে সিরিয়ার দুটি মহাসড়ক এম-৪ ও এম-৫। এরমধ্যে এম-৪ লাটকিয়া বন্দর থেকে ইদলিব হয়ে আলোপ্পো পৌছেছে। এম-৫ মহাসড়ক হামা থেকে ইদলিব হয়ে আলোপ্পতে গেছে। এই দুই মহাসড়ক শুধু সিরিয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থার লাইফ লাইন নয়, এ অঞ্চলে ইরানের প্রভাব বিস্তারের সংযোগ মাধ্যম। কারন এই সড়ক দিয়ে সিরিয়া হয়ে লেবানন পর্যন্ত ও ইরাক সীমান্ত পর্যন্ত যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। এই সড়ক ও সিরিয়ার সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে হিজবুল্লাহর কাছে অস্ত্র সরবরাহ করে ইরান। ইরাক থেকে লেবানন পর্যন্ত এ অঞ্চলে শিয়া মিলিশিয়া গোষ্টীগুলোর কাছে অস্ত্র সরবরাহের জন্য এই মহাসড়ক ব্যবহার করা হয়। দুটি মহাসড়ক চলে গেছে ইদলিব হয়ে। ফলে এই কৌশলগত অবস্থানে তুরস্কের কর্তৃত্ব ইরান কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছে না। ফলে ইদলিবে সিরিয়ার নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্টায় ইরান যথেষ্ট তৎপর রয়েছে। তুরস্ক মনে করে এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার চেয়ে ইরানের আগ্রহ বেশি।
সিরিয়ার যুদ্ধে শুরু থেকে শিয়া-সুন্নি ফ্যাক্টর কাজ করছে। সিরিয়ার ভুমি দখলের জন্য ইরান ও আসাদ সরকার তুরস্ককে দায়ি করছে। কিন্তু সিরিয়ার অভ্যন্তরে হাজার হাজার নারী শিশু ও নিরীহ মানুষ হত্যার সাথে শিয়া মিলিশিয়া গোষ্টীগুলো জড়িত ছিলো। ইরানের রেভ্যুলিশনারি গার্ড বাহিনীর প্রধান কাসেম সোলায়মানি ছিলেন এর অন্যতম রুপকার। তুরস্কের কাছে সিরিয়ার ভুমি দখলের চেয়ে গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠছে দেশটির নিরাপত্তা ও শরনার্থী সমস্যা।
পরিস্থিতি যাই হোক না কেন ইদলিবে তুর্কি সৈন্য নিহত হওয়ার পর এরদোয়ানের আর পিছু হটার কোনো সুযোগ নেই। যদিও এ ক্ষেত্রে তুরস্ককে মোকাবিলা করতে হচ্ছে ইরান ও রাশিয়াকে। আবার ন্যাটোর অবিশ্বস্ত ইউরোপীয় সদস্যদের ওপর পুরো নির্ভর করতে পারছে না আংকারা।
ইদলিব সংকট নিরসনের ওপর নির্ভর করছে এরদোয়ানের ভবিষ্যত রাজনীতি। এমনকি এই পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে তুরস্ক জড়িয়ে পড়তে পারে বড় ধরনের সংঘাতে। যদিও রাশিয়া বা তুরস্ক কোনো পক্ষই যুদ্ধ করার মতো অর্থনৈতিক অবস্থা নেই। কিন্তু ইরান এ ক্ষেত্রে ছায়া যুদ্ধের জন্য বেশি আগ্রহী তাতে কোনো সন্দেহ নেই।