পাকিস্তানের সাথে ভারতের বৈরিতা যেমন আজন্ম, তেমনি আরব দুনিয়ার সাথে ভারতের বন্ধুত্বও সুবিদিত। ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিম সরকারের বৈরী আচরণ, বিশেষ করে গুজরাটে মুসলিম হত্যাযজ্ঞের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইহুদিবান্ধব দেশও যখন 'গুজরাটের কসাই' নামে চিহ্নিত নরেন্দ্র মোদীকে আমেরিকায় 'অবাঞ্ছিত' ঘোষণা করে, তখনও আরব বিশ্বের সাথে ভারতের সম্পর্কের তেমন হেলদোল লক্ষ্য করা যায়নি। মনে হচ্ছিল, কোথাও কিছু ঘটেনি, সব ঠিক হ্যায়। কিন্তু ভারতের কট্টর মৌলবাদী সরকার ও এর সমর্থকদের বাড়াবাড়ি বুঝি আর মেনে নিতে পারছে না আরব দুনিয়ার কেউ-কেউ। সেখান থেকে শোনা যাচ্ছে তাড়িত বিবেকের মৃদু গুঞ্জনধ্বনি।
সংযুক্ত আরব আমীরাতে কর্মরত কিছু ভারতীয় নাগরিকের ইসলামবিদ্বেষী মন্তব্য বুঝি ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিয়েছে সেদেশের কিছু বিশিষ্ট নাগরিকের। তেমনই একজন হলেন প্রিন্সের হেন্দ আল ক্বাসিমী। মুসলিম দেশ আমীরাতে বসে ইসলাম ও মুসলিমবিরোধী প্রচারনা চালানো দেখে ক্ষুব্ধ না হয়ে পারেননি আমীরাতের রাজপরিবারের সদস্যা এ রাজকুমারী। ভারত-আমীরাত সম্পর্ক এবং ইসলামবিদ্বেষী প্রচারনা প্রসঙ্গ তুলে তিনি টুইটারে লিখেছেন, ''আমীরাতের শাসক পরিবার ভারতীয়দের প্রতি বন্ধুত্বপরায়ণ। কিন্তু রাজপরিবারের একজন সদস্যা হিসেবে আমি আপনাদের ধৃষ্টতা মেনে নিতে পারছি না।''
প্রবাসী ভারতীয়দের ইসলামবিদ্বেষী মনোভাব ও আচরণে সংযুক্ত আরব আমীরাতে কতোটা ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে তা ফুটে ওঠে প্রিন্সেসের এ কথায়। তিনি লিখেছেন, ''এ দেশে যারাই কাজ করছে তাদের সবাইকে বেতন দেয়া হয়, কাউকে বিনা পয়সায় কাজ করানো হয় না। আপনারা আপনাদের রুটি ও মাখনের সংস্থান এ দেশ থেকেই করছেন আর এ দেশকে করছেন অবজ্ঞা। ভাববেন না যে আমাদের নিয়ে আপনাদের ঠাট্টা-তামাশা আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়।''
আমীরাতে কমর্রত এক ভারতীয় নাগরিকের ইসলামবিদ্বেষী মন্তব্যের জবাবে প্রিন্সে হেন্দ এ কথা বলেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ওই ভারতীয় নাগরিকটি ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষী কিছু মন্তব্য করেছিল। প্রিন্সেস তাঁর টুইটে ভারতের ক্রমপরিবর্তনশীল সমাজবাস্তবতা নিয়েও কথা বলেন। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিতে সংখ্যাগুরুরা সংখ্যালঘু মুসলিমদের দলন-পীড়নে নেমে পড়েছে এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে।
আরব দেশগুলোতে ৭০ লাখ ভারতীয় অভিবাসী আছে। এরমধ্যে আরব আমিরাতে আছে ৩০ লাখের বেশি। ২০১৮ সালে ভারতে বিভিন্ন দেশ থেকে ৬৯ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছে। এরমধ্যে আরব আমিরাত থেকে এসেছে ১৭ বিলিয়ন ডলার। সংযুক্ত আরব আমিরাতকে বলা হয় মিনি ইনডিয়া। দেশটির ব্যবসায় বানিজ্য এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে ভারতীয়দের একছত্র প্রভাব। ভারতীয়দের পরে আছে পাকিস্তানি ও বাংলাদেশি অভিবাসী। যারা ভারতীয়দের চেয়ে অনেক কম সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকে।
সংযুক্ত আরব আমীরাত থেকে সউদি আরব ও অন্যান্য দেশ মিলিয়ে পুরো উপসাগরীয় এলাকায় কয়েক মিলিয়ন প্রবাসী ভারতীয় কর্মরত রয়েছে। এদের কেউ-কেউ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এসব দেশে বসেই সোশ্যাল মিডিয়ায় দিব্যি ইসলাম ও মুসলিমবিরোধী পোস্ট দিতে থাকে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে এলে সাম্প্রতিক কয়েক সপ্তাহে বেশ ক'জন ভারতীয়কে চাকরি থেকে ছাঁটাই করে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এ নিয়ে ভারতের গনমাধ্যমেও চলছে নানামুখী আলোচনা। আরব আমিরাত এমন সিদ্ধান্ত তা ছিলো অনেকটা অকল্পনীয়।
সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ভারত এই দুই বন্ধু দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ রকম ঘটনা বেশ কৌতুহলোদ্দীপক বটে! কেন কৌতুহলোদ্দীপক, বুঝতে হলে মনে করতে পারেন গত বছরের আগস্ট মাসের কথা। সে সময় ভারতের প্রধাননমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আমীরাত সফরে গেলে তাকে সে-দেশের সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করা হয়। অথচ এর মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই এই মোদীর সরকারই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নিয়ে একে ভারতভুক্ত করে নেয়।
তারপর থেকে ভারত মহাসাগর ও পারস্য উপসাগরে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। ভারতের মোদী সরকার সে-দেশে পাস করেছে এক বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন, যে আইনের প্যাঁচে ফেলে বংশানুক্রমে বসবাস করে আসা মুসলিমদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, বলা হচ্ছে, প্রতিবেশী বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ''নির্যাতনের শিকার'' হয়ে কোনো হিন্দু ভারতে আশ্রয় নিলে তাকে ভারতের নাগরিকত্ব দেয়া হবে। এ অপ-আইনের বিরুদ্ধে ভারতের মুসলিম এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠী তীব্র প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আসে। তাদের সমর্থন দেয় বিবেকবান নাগরিক সমাজ। প্রানঘাতী করোনার কারণে ভারতজুড়ে লকডাউন ঘোষণার আগ পর্যন্ত এ বিক্ষোভ চলছিল। এ বিক্ষোভ দমনে সবরকম নির্দয় পন্থা অবলম্বন করতে ভারত বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি।
ভারতের ক্ষমতাসী বিজেপি-র নেতারা সোশ্যাল মিডিয়ায় যথেচ্ছভাবে মুসলিমবিদ্বেষ ছড়িয়ে চলেছে। এদের একজন হলো অমিত মাল্ভিয়া। সে বিজেপি-র আইটি সেলের প্রধান। দিল্লির শাহীনবাগে নাগরিকসমাজের বিক্ষোভ এবং শাহী জামে মসজিদে তাবলিগ জামায়াতের মুসল্লিদের অবস্থান প্রসঙ্গে ১ এপ্রিল সে টুইটারে লিখেন যে এতে নাকি ''দিল্লির তলপেট ফেটে যাচ্ছে। এর একটা সুরাহা হওয়া দরকার।'' ৬ এপ্রিল বিজেপির আরেক এমপি শোভা কারান্দলাজে অভিযোগ করে, ''কর্ণাটকের হাসপাতাল ও হোটেলে অবস্থানকারী তাবলিগ জামায়াতের মুসল্লিরা হোটেল ও হাসপাতাল-কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে।'' বিজেপি এমপি-র এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন। কিন্তু এমন জলজ্যান্ত মিথ্যাচারের জন্য ওই এমপি-র বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি মৌলবাদী দলটি। একইভাবে হিমাচল রাজ্য বিজেপি-র প্রধান রাজিব বিন্দাল ৪ এপ্রিল এবং মহারাষ্ট্রের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপি-র সিনিয়র নেতা দেবেন্দ্র ফড়নবিস ৯ এপ্রিল পৃথক টুইট বার্তায় ''করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাবলিগ জামায়াতের মুসল্লিরা 'মানব বোমা' হিসেবে কাজ করছে'' বলে অভিযোগ করে।
ভারত নামের দেশটিতে মুসলিমবিরোধী ঘৃণা অভিযানের এ সবই নমুনামাত্র, বাস্তবতা আরো অনেক ব্যাপক। এমন পরিস্থিতিতে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। ভারতে মুসলিমদের যখন এ অবস্থা, তখন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সংযুক্ত আরব আমীরাতে বসেই কিছু প্রবাসী ভারতীয় সোশ্যাল মিডিয়ায় লাগামহীনভাবে মুসলিমবিরোধী প্রপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে, যার কারণে ওই দেশের নাগরিকরা ভারতের সাথে তাদের দেশের সর্ম্পকের বিষয়টি নতুন করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন। ইতিমধ্যে এমন আভাস পাওয়া গেছে যে আরব দুনিয়ার বিশিষ্টজনদের কেউ-কেউ ভারতের মুসলিমবিরোধী আগ্রাসী কর্মকান্ডকে চ্যালেঞ্জ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এমনই একজন মেজবেল আল শারিকা। তিনি একজন প্রবীন আইনজীবী এবং ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস-এর পরিচালক। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন যে ভারতীয় মুসলিমদের বিষয়টি তিনি নিজ উদ্যোগে জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে পেশ করবেন। তিনি ভারতীয় মুসলিমদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন যেন তারা তাদের প্রতি সংঘটিত সহিংসতার তথ্য- প্রমান যোগান দিয়ে তাঁকে সহায়তা করেন।
ভারতে ক্রমবর্ধমান ইসলামবিদ্বেষ আরব বিশ্বকে মনে করিয়ে দেয় কিছু তিক্ত স্মৃতি। কয়েক বছর আগে তেজস্বী সূর্য নামে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি-র এক এমপি টুইট করেছিল, ''আরব নারীদের ৯৫ ভাগই গত কয়েক শ' বছর ধরে চরম যৌনতৃপ্তি বলতে কিছু পায় না। তারা সন্তান জন্ম দেয় যৌনক্রিয়ার ফল হিসেবে, ভালোবাসার ফসল হিসেবে নয়।''
একদিকে নিজের ও নিজ দলের সীমাহীন মুসলিমবিদ্বেষ, অন্যদিকে উপসাগরীয় মুসলিম দেশগুলোকে হাতে রাখার প্রয়োজনীয়তা - দুয়ে মিলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদীজি আটকা পড়েছেন পলিটিক্যাল ফাটা বাঁশের মাঝখানে। ওখান থেকে বের হতে তিনি এখন খেলতে চাইছেন ডাইভারসিটি বা বহুত্ববাদের কার্ড। সেই খেলার অংশ হিসেবে ক'দিন আগে তিনি টুইটারে লিখেছেন, ''কোভিড-১৯ হানা দেয়ার আগে কোনো গোত্র, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা বা দেশ দেখে না। তাই আমাদের প্রথম কর্তব্য হলো ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে এক হওয়া। এ ক্ষেত্রে আমরা ঐক্যবদ্ধ আছি।''
এদিকে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা বা ওআইসি-র কাছেও মুখ লুকাতে পারছেন না ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ভারতের কতিপয় হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার জন্য দেশের মুসলিমদের ওপর দোষ চাপালে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ওআইসি। ওআইসি-র নিরপেক্ষ স্থায়ী মানবাধিকার কমিশন এক বিবৃতিতে বলে, ভারতে ক্রমবর্ধমান মুসলিমবিদ্বেষ বিস্তার রোধ, মুসলিমদের ওপর হামলা বন্ধ করা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী সংখ্যালঘু মুসলিমদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য আমরা ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।
এই প্রতিবেদনের ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন