করোনাসংকটে কিছুদিন আগেও বিপর্যস্ত ছিল ইরান। তখন অনেক পন্ডিত মন্তব্য করেছিলেন ইরান সরকার এবার চরম বেকায়দায় পড়বে। ইরান সেই সংকট অনেকাংশে উতরে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে ভেনিজুয়েলায় জ্বালানি তেল সরবরাহ করেছে ইরান। যুক্তরাষ্ট্র ইরানি ট্যাংকারে হামলা চালাতে পারে বলে আশংকা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তেমন কিছুই হয়নি। আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ইরানি ট্যাংকার নিরাপদে পৌছে যাচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ভেনিজুয়েলায়। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা পশ্চিম গোলার্ধে ইরানের প্রভাব বাড়ার ইঙ্গিত। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই ইরান কী আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে? আজ আমরা এ সম্পর্কে আলোচনা করবো।
জ্বালানি গ্যাস নিয়ে ভেনিজুয়েলায় নোঙ্গর করে একের পর এক ইরানি ট্যাংকার। ফরচুন নামের প্রথম ট্যাংকারটি অবতরণ করে ২রা মে। এরপর নোঙর করবে আরও চারটি ইরানি ট্যাংকার। ইরান ও ভেনিজুয়েলার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাই ইরানি ট্যাংকারের এই আগমনকে ভেনিজুয়েলা সরকার দেখছে বিজয় হিসেবে।
এ দফায় ইরান ৫টি ট্যাংকারে ভেনিজুয়েলায় সরবরাহ করবে প্রায় ১৫ লাখ ব্যারেল জ্বালানি। প্রথম চালানটি সরবরাহ করা হয়েছে ভেনিজুয়েলায় রাজধানী কারাকাসের কাছের একটি তেল শোধনাগারে। শুধু গ্যাস নয়, ভেনিজুয়েলার তেল শোধানাগারের যন্ত্রাংশও সরবরাহ করছে ইরান। ভেনিজুয়েলার জঙ্গিবিমান এসব ট্যাংকারকে এসকর্ট নিয়ে নিয়ে আসছে।
ভেনিজুয়েলার তেল শোধনাগারগুলো অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। ইরানের প্রথম ট্যাংকার ভেনিজুয়েলায় নোঙ্গরের পর দেশটির প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো বলেছেন, ‘ভেনিজুয়েলার সবচেয়ে মহান ও স্পর্শকতার জনগণের অন্তর থেকে আমি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান, দেশটির প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি এবং দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিসহ ইরানের সবাইকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। তারা আমাদের প্রতি সংহতি জানিয়েছেন, আমাদের সমর্থন দিয়েছেন।’
ভেনিজুয়েলায় রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেলের মজুদ। তবে আগে যত তেল শোধন করতে পারত দেশটি এখন তার ১০ ভাগের মত পরিশোধন করা সম্ভব হচ্ছে। এতে দেশটিতে তীব্র জ্বালানি তেলের সংকট তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় ত্রাতার ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয়েছে ইরান।
ইরান তেলের বিনিময়ে ভেনিজুয়েলা থেকে পাবে স্বর্র্ণ। ইরানের প্রথম ট্যাংকার ভেনিজুয়েলায় পৌছার পর যুক্তরাষ্ট্রের সরকার এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। অবশ্য এর আগে ট্রাম্প প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা বলেছিলেন, কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় তা নিয়ে তারা চিন্তাভাবনা করছেন। তখন যুক্তরাষ্ট্রকে হুমকি দিয়েছিল ইরান।
ইরানের তেল বিক্রির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অন্যদিকে দক্ষিণ আমেরিকার দেশটি থেকে মাদুরোকে উৎখাতের জন্য কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে ইরান ও ভেনিজুয়েলার মধ্যে সম্পর্ক দিনদিনই উষ্ণ হচ্ছে।
কারাকাসে ইরানি ট্যাংকার নোঙর করার পর ভেনিজুয়েলার জ্বালানিমন্ত্রী তারিক আল আইসামি বলেছেন, ‘আমরা অগ্রসর হচ্ছি এবং বিজয় অর্জন করছি।’ করোনা সংকটের কারণে ট্রাম্প প্রশাসন এখন এমনিতেই বেশ বেকায়দায় আছে। ইরানের মধ্যে এই প্রত্যয় জন্মেছে যে ট্রাম্পপ্রশাসন তেমন কিছু করবে না। এই সুযোগে ইরান ঝুঁকি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় প্রভাব বাড়াচ্ছে।
বিশ্বের বৃহত্তম তেল মজুদের দেশ ভেনিজুয়েলা এক সময় ছিল বিশ্বের অন্যতম তেল উৎপাদনকারী দেশ। কিন্ত এখন তার তেল শোধনাগারগুলো অচল। তবে এ দফায় ইরান থেকে যে তেল আসছে তা দিয়ে ভেনিজুয়েলার দুই-তিন সপ্তাহ চলতে পারে। সেই তেলও আবার সাধারণ মানুষ পাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
দেশটিতে তেলের সংকট এতোটাই তীব্র যে গ্যাস স্টেশনে লোকজনকে গাড়ি নিয়ে দিনের পর দিনও দাড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। অনেক লোক মাইলের পর মাইল হেটে কাজে যাচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, তারা কাজে যেতে পারছেন না। হাসপাতালে যেতে না পেরে অনেক অন্তঃসত্ত্বার সন্তান জন্মদান পিছিয়ে যাচ্ছে।
ইরান ও ভেনিজুয়েলার মধ্যে সম্পর্ক কয়েক দশকের পুরোনা। বিশেষ করে ভেনিজুয়েলার সাবেক নেতা হুগো শ্যাভেজের সময় থেকেই ইরান সেখানে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটায়। ইরান ভেনিজুয়েলায় গাড়ি ও সিমেন্ট কারখানা তৈরি করেছে। সেখানে হাজার হাজার ঘরবাড়ি তৈরি করেছে ইরান। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভেনিজুয়েলার অর্থনীতিতে ধস নামার পর ইরানের সেসব ব্যবসা বাণিজ্যও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন দুটো দেশের সম্পর্ক মূলত রাজনৈতিক ও প্রতীকী।
যুক্তরাষ্ট্রকে এমন সময় এ ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হলো যখন ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্টকে গ্রেফতার করতে দেড় কোটি ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। মাদুরোর বিরুদ্ধে মাদক পাচারের অভিযোগে এ পুরস্কার ঘোষণা হলেও আসলে এই সমাজতান্ত্রিক নেতাকে উৎখাত করে তার প্রতি™^›দ্বী জুয়ান গুয়াইদোকে ক্ষমতায় বসাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
মায়ামিভিত্তিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষক রাস ডালেন বলেন, ইরানের এই জ্বালানি সরবরাহ ভেনিজুয়েলার জন্য একটা বিজয়। ভেনিজুয়েলার সাবেক নেতা হুগো শ্যাভেজের সময় দেশটিতে ছিলো বিশে^র বৃহত্তম তেল শোধনাগার। দেশটিতে প্রায় ৫৫ লাখ গাড়ি রয়েছে।
ভেনিজুয়েলায় সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দেশটির বহু নাগরিক অন্য দেশে পাড়ি দিয়েছেন। অনেকে উদ্বাস্তু জীবন বেছে নিয়েছেন। এক সময় সমাজতান্ত্রিক স্বর্গ নামে পরিচিত দেশটি মাদুরোর শাসনে কার্যত নরকে পরিণত হয়েছে।
তাই ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক উষষ্ণতর হলেও তা নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়নে আদৌ কোনো ভ‚মিকা রাখতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে মাদুরো বলেছেন, আমরা দুটো বিদ্রোহী জাতি। দুটি বিপ্লবী জাতি কখনোই আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের সামনে মাথানত করবে না। বিশে^ ভেনিজুয়েলার সাহসী বন্ধু রয়েছে।
ইরান ভেনিজুয়েলাকে এমন সময় এই সহায়তা দিল যখন দেশটি করোনাভাইরাস সংকট থেকে ক্রমশই মুক্তি পাচ্ছে। ২৬ মে পর্যন্ত ইরানে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ৪০ হাজারের মত মানুষ আর মৃত্যু হয়েছে সাড়ে সাত হাজার মানুষের। তবে মুসলিম বিশে^র মধ্যে ইরানই প্রথম দেশ যারা ব্যাপকসংখ্যক মানুষের সংক্রমণের মধ্যেও মসজিদগুলো খুলে দেওয়ার সাহস দেখিয়েছে। বস্তুত, সরকারের মধ্যে এই আস্থা তৈরি হয়েছে যে এতে আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা বাড়লেও তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হবেন তারা।
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ইরানে আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা বাড়লেও মৃত্যু বেশ কমে এসেছে। আগে ইরানে দৈনিক দেড়শ মানুষের মৃত্যু হলেও এখন তা ৫০-৬০ জনে নেমে এসেছে।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে অর্থনৈতিক সংকটে থাকা ইরান করোনা সংকটে বেশ ভালোভাবেই সামাল দিয়েছে। চীনের পরই যে দেশটিতে করোনাভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সেটি হলো ইরান। তেমন কোনো পূর্ব প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়ে হঠাৎ করেই করোনার তান্ডব শুরু হয় চীনের ঘনিষ্ঠ ইরানে। ফলে প্রথম দিকে পরিস্থিতি সামলাতে কর্তৃপক্ষকে হিমশিম খেতে হয়েছে। তবে দ্রæতই ইরান ঘুরে দাঁড়ায়। ইরান মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রণে ইউরোপ আমেরিকার চেয়েও অত্যন্ত সফলতার সাক্ষর রেখেছে।
ইরান মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রণে অনেকাংশে জার্মানির মত সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে যে অর্থনৈতিক সংকটে পর্যুদস্ত থাকলেও ইরানে স্বাস্থ্যসেবার মান এসব দেশের চেয়ে কোনো অংশে খারাপ নয়।
২০১৮ সালে ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল ট্রাম্প প্রশাসন। করোনা সংকটেও যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেনি। বরং যুক্তরাষ্ট্র পদে পদে বাধা দিয়েই চলেছে ইরানকে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ থেকে জরুরি ভিত্তিতে ৫০০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছিল ইরান। যুক্তরাষ্ট্র এই ঋণের বিরোধিতা করছে। ফলে ইরান সেই ঋণ পায়নি। অথচ করোনার সংকটের কারণে বহু দেশকে আইএমএফ ইতোমধ্যেই বিশেষ ঋণ দিয়েছে।
ইরানের জন্য এসব সংকট অবশ্য নতুন নয়। ইসলামী বিপ্লবের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের অন্যায় নিষেধাজ্ঞা মাথায় নিয়েই ইরান টিকে আছে। তবে অনেকে বলে থাকেন সৌদি আরবসহ কয়েকটি আরব দেশের চরম বৈরিতা ও পাশ্চাত্যের নিষেধাজ্ঞা না থাকলে ইরান একটি বিশ্বশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতো।
বড় ধরনের সংকটে অবশ্য ইরানি জাতি নজিরবিহীন ঐক্যের দৃষ্টান্ত দেখায়। করোনা সংকটেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানায়, করোনা মোকাবিলায় সারা দেশে কাজ করেছে ১০ হাজার সে¦ছাসেবী সংগঠন। এর মধ্যে চিকিৎসা বিজ্ঞানে অধ্যয়নরত ২৩০টি দলও ছিল। সারা দেশে সোয়া লাখ স্বেছাসেবী কাজ করেছেন। তারা ফেসমাস্কসহ নানা প্রয়োজনীয় উপকরণ তৈরি করে তা বিলি করেছেন। দৈনিক ৫ লাখ মাস্ক তৈরি করেছেন তারা। ইরানের একটি কোম্পানি তো মাস্ক তৈরির জন্য ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা হয়।
প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে