মুসলিম বিশ্বের মধ্যে অনৈক্য রেষারেষি ও হানাহানির ইতিহাস বহু পুরনো। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা যে কী ভয়ঙ্কর রুপ নিয়েছে, তা তো ইয়েমেন ও সিরিয়ার ধ্বংসস্তুপের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। একদা সমৃদ্ধ ইরাক ও লিবিয়া আজ প্রায় অকার্যকর দেশ। ইরান ও কাতার প্রায়-একঘরে। এবার কি শনির দৃষ্টি পড়েছে তুরস্কের ওপর? নইলে সংযুক্ত আরব আমীরাত অর্থাৎ ইউএই কেন এমন আচরণ করবে?
সংযুক্ত আরব আমিরাত দেশটি উপসাগরীয় এলাকার সাতটি আমিরাতের সমন্বয়ে গড়া একটি ফেডারেল রাজতান্ত্রিক দেশ। এটি একসময় ব্রিটেনের উপনিবেশ বা কলোনি ছিল। ১৯৭১ সালে তারা স্বাধীনতা পায়।সংযুক্ত আরব আমীরাত ২০১০ সাল থেকে তুরস্কের সাথে বৈরী আচরণ শুরু করে। বলা হয়ে থাকে, দেশটি তুরস্কের বিরুদ্ধাচরণের কোনো সুযোগই মিস করে না।
তুরস্কে এরদোয়ান সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে সংঘটিত ১৫ জুলাইর ব্যর্থ অভ্যূত্থান থেকে শুরু করে কাতারের ওপর অবরোধ আরোপ এবং লিবিয়ার রক্তক্ষয়ী সংঘাত - সবখানেই তুরস্কের বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়েছে সংযুক্ত আরব আমীরাত। লিবিয়ায় যেখানে জাতিসংঘ-স্বীকৃত ত্রিপলী সরকারের পক্ষে তুরস্ক, আমীরাত সেখানে পক্ষ নিয়েছে একজন ওয়ারলর্ড বা যুদ্ধবাজ নেতার।
কিন্তু কেন এ বৈরিতা? তুরকের ইস্তাম্বুল মেদেনিয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর ওজদেন জেইনেপ অক্তাভ বলেন, আমীরাত ও তার মিত্র সউদি আরব আমাদের এমন একটি দেশ হিসেবে দেখে, যে দেশ মুসলিম দুনিয়া থেকে রাজতন্ত্র অবসানের লক্ষ্যে 'মুসলিম ব্রাদারহুড'কে সমর্থন দেয়।
আমীরাত ও সউদি - উভয় রাজতন্ত্রই মুসলিম ব্রাদারহুডের ধর্মীয় আন্দোলন সম্বন্ধে জানে। জানে বলেই তারা একে তাদের নিবর্তনমূলক শাসনব্যবস্থার প্রতি সার্বক্ষণিক হুমকি মনে করে। অথচ এ দলটি স্বৈরাচারী রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা উৎখাত করতে চায় শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে; সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে নয়।
মজার ব্যাপার হলো, এমবিজেড নামে পরিচিত আবু ধাবীর যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ, যিনি এখন সংযুক্ত আরব আমীরাতের সবচাইতে ক্ষমতাশালী মানুষ এবং ডি ফ্যাক্টো বা প্রকৃত শাসক, তিনি নিজেই একসময় মুসলিম ব্রাদারহুড আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। ২০০৭ সালে তিনি আমেরিকান কূটনীতিকদের বলেছিলেন, ''আমি একজন আরব, একজন মুসলিম এবং একজন নামাজী মানুষ। ১৯৭০ থেকে ৮০এর দশকের গোড়ার দিক পর্যন্ত আমি ওদের সাথেই ছিলাম।'' নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর মতে, ''তিনি তার দেশের মানুষের ওপর ইসলামী রাজনীতির প্রভাব নিয়ে নিয়ে উদ্বিগ্ন। তিনি একদা আমেরিকান কূটনীতিকদের বলেছিলেন, আমার বাহিনীর ৮০ শতাংশ যোদ্ধাই 'মক্কার কতিপয় পবিত্র মানুষের' ডাকে সাড়া দিতে প্রস্তুত।
তাদের কথাতেই পরিষ্কার যে, মুসলিম ব্রাদারহুড কোনো চরমপন্থী আন্দোলন নয়। কিন্তু এই দল ও গণতন্ত্র তাদের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের প্রতি সবচাইতে বিপজ্জনক হুমকি। কূটনীতিকরা বলেন যে এমবিজেড প্রায়ই বলেন, মুসলিম বিশ্ব এ মুহূর্তে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত নয়। নির্বাচন হলেই কেবল মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো দলগুলো সফল হতে পারতো।
আরব বিশ্বকে ঘিরে যে কূটনৈতিক ও কৌশলগত প্রতিযোগিতা তার অন্যতম এক খেলোয়াড়ের নাম মোহাম্মদ বিন জায়েদ। আরব আমিরাতের প্রথম শাসক শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ানের তৃতীয় পুত্র মোহাম্মদ বিন জায়েদ। তার জন্ম ১৯৬১ সালের ১১ মার্চ। ২০০৩ সালে শেখ জায়েদ বিন সুলতান তাকে আবু ধাবির ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স ঘোষণা করেন।
জায়েদ বিন সুলতান মারা গেলে ২০০৪ সালের নভেম্বর মাসে মোহাম্মদ বিন জায়েদ ক্রাউন প্রিন্স হোন। একই সাথে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার। মধ্যপ্রাচ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের যে আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি তার নেপথ্যে ব্যক্তি তিনি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের চেয়েও তাকে ক্ষমতাধর বলে মনে করা হয়।
মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রধান পরামর্শদাতা হিসেবে বিশেষ আস্থা অর্জন করেছেন আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদ। ইসরাইলের সাথে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার অন্যতম উদ্যোক্তা তিনি। আরব বসন্তের পর আরব বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে সর্ম্পকের যে মেরুকরন হয়েছে তাতে একটি পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আরব আমিরাত। তুরস্ক ও কাতারের মধ্যে যে ঘনিষ্ট সর্ম্পক গড়ে উঠেছে তার প্রবল বিরোধী জায়েদ। এ ক্ষেত্রে মিত্র হিসাবে তিনি পাশে পেয়েছেন সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে।
মধ্যপ্রাচ্য তুরস্কের প্রভাব খর্ব করার কারনে তিনি নানা ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জড়িয়ে পড়ছেন যুদ্ধে। লিবিয়ায় এখন আরব আমিরাতের ভুমিকা প্রকাশ্য। খলিফা হাফতারের বাহিনীকে তিনি প্রকাশ্য সমর্থন দিচ্ছেন। সাথে আছে মিশরের সেনা শাসক আব্দুল ফাত্তাহ সিসি। তুরস্ককে কোনঠাসা করতে গ্রিস, ফ্রান্স ও ইসরাইলের সাথে তিনি হাত মিলিয়েছেন। তুরস্কের ওপর ক্ষোভের পেছনে রয়েছে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি তুরস্কের সমর্থন।
মুসলিম বিশ্ব এ মুহূর্তে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত নয় – প্রাচ্যদেশে বহু ব্যবহারে জীর্ণ এ মতকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয় তুরস্ক। সামরিক বাহিনির দিক থেকে বার বার বাধা এসেছে, সেসব বাধা মোকাবিলা করেই সেই ১৯৫০ সাল থেকে বহুদলীয় নির্বাচনব্যবস্থা সমুন্নত রেখেছে তুরস্ক। মুসলিম বিশ্বে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে তুরস্ক।
২০০২ সাল থেকে তুরস্ক শাসন করে আসছে এ কে পার্টি। মুসলিম মূল্যবোধের সাথে গণতান্ত্রিক নীতিমালার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে একটি উদার রক্ষণশীলতার চর্চা করছে দলটি। তারা তাদের নেতা রিসেপ তাইয়েব এরদোয়ানের নেতৃত্বে পর পর কয়েকটি নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন ও পরিচালনা করে আসছে।
তুর্কী গণতন্ত্রের এ উদাহরণ এবং এ কে পার্টির মডেল আমীরাতের শাসকগোষ্ঠীকে ভীষণ উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। কারণ, তুরস্ক ২০০৩ সালে মিশরের সামরিক অভ্যুত্থানের তীব্র বিরোধিতা করে। ওই অভ্যুত্থানে দেশটির ইতিহাসের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে উৎখাত করে সেনাবাহিনী।
তুর্কী মডেল সউদি ও আমিরাতি শাসনব্যবস্থাকে অনিশ্চয়তার মাঝে নিক্ষেপ করেছে। বিরোধী গ্রূপগুলোর বিরুদ্ধে নানা রকম নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা নিয়ে এবং বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভর করেও তারা তাদের জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। আমিরাতি শাসকগোষ্ঠীর পরম বন্ধু ওয়াশিংটন সেই ১৯৯০এর দশক থেকে কয়েক শ' কোটি ডলার মূল্যের অত্যাধুনিক অস্ত্র সররাহ দিয়ে আসছে।
এমন অবস্থায় মুসলিমদের আকাঙ্ক্ষা ও গণতন্ত্রের মিলিত উপস্থাপনায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের দক্ষতা সংযুক্ত আরব আমিরাতের আরব দেশগুলোকে করছে প্রতিনিয়ত বিব্রত। কারণ, এরদোয়ানের সেই কুশলতা তাদের নেই।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তুলে ধরছেন মুসলিম গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের এমন এক উদাহরণ, যা ইসলামী দুনিয়ার বিপুল জনগোষ্ঠীকে স্বাধীনতার দিকে হাতছানি দেয়। ঈর্ষা ও রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা থেকেই এসব আরব দেশ তুরস্কের প্রতি খডগহস্ত হয়েছে। কারণ, তারা ভালো করেই জানে যে সউদি থেকে আমীরাত হয়ে মিশর পর্যন্ত বিস্তীর্র্ন অঞ্চলে এরদোয়ানই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি তাদের সেকেলে ও অচল নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন।
আমিরাতের এমবিজেড ও সউদি আরবের নেতারা বেশ ভালো করেই জানেন ও বোঝেন যে তাদের শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়তে শুরু করলে ব্রাদারহুডের মতো ধর্মমনস্ক আন্দোলনগুলোই তাৎক্ষণিকভাবে তাদের রাজনৈতিক বিকল্প হবে। কেননা, ইখওয়ান বা ব্রাদারহুডই ইসলামের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে, আমীরাত ও সউদি আরবের নেতারা যার ঘোর বিরোধী।
সৌদি ও আমিরাতি শাসকরা মুসলিম ব্রাদারহুডকে দমনের পাশাপাশি তুরস্কের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়ছে। যা এ অঞ্চলের ভূরাজনীতির ওপর বিরুপ প্রভাব পড়ছে। এমনকি ফিলিস্তিন বা জেরুসালেম ইস্যুতে তারা ইসরাইলের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। যা গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিরতার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। একই সাথে নিজ দেশের জনগনের বিশ্বাস ও আকাঙ্খার বিরুদ্ধেও তারা অবস্থান নিচ্ছেন।
প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে