মোহাম্মাদ বিন সালমান যিনি এমবিএস নামে পরিচিত। সৌদি আরবের প্রতাপশালী যুবরাজ। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই এই তরুণ আছেন আলোচনায়। বর্তমানে সৌদি আরবের রাষ্ট্রযন্ত্রের মূল চালক যে তিনি সেটি এখন অনেকটাই স্পষ্ট। বাদশাহর চেয়ারে সালমান বিন আবদুল আজিজ থাকলেও সমালোচকেরা বলেন, সৌদি আরব চলে বাদশাহর পুত্র এমবিএসের সিদ্ধান্তে। ক্রাউন প্রিন্স হওয়ার কারণে সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারীও তিনি। ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই কখনো ইতিবাচক কখনো বা নেতিবাচক কর্মকান্ডের মাধ্যমে বিশ্ব মিডিয়ায় তার উপস্থিতি সব সময়ই থাকছে। আজ আমরা তুলে ধরবো মোহাম্মদ বিন সালমানের রাজনৈতিক জীবনের নানা দিক
সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স বা যুবরাজ হিসেবে ২০১৭ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করেন মোহাম্মদ বিন সালমান। দায়িত্ব নেয়ার পর রক্ষণশীল সৌদি আরবের জন্য সামাজিক সংস্কারমূলক পদক্ষেপ হাতে নিয়ে যেমন প্রশংসিত হয়েছেন, তেমনি তুমুল বিতর্কিত অনেক বিষয়ের সাথেও আছে তার সরাসরি সম্পৃক্ততা। মহিলাদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দেয়া, সিনেমা হল চালুর মতো সংস্কারমূলক সিদ্ধান্ত যেমন নিয়েছে, তেমনি ইয়েমেন যুদ্ধ ও জামাল খাশোগি হত্যাকান্ডের মতো ঘটনায়ও তার সম্পকৃক্ততার কথা বহুল আলোচিত। এ যেন মুদ্রার বিপরীত দুইটি পিঠ। আবার তেল নির্ভরতা থেকে সৌদি অর্থনীতিকে বের করে আনতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থেকে তার বিচক্ষণ নীতি নির্ধরণী ক্ষমতার প্রমাণ মেলে। সব মিলে তাই মোহাম্মাদ বিন সালমান কারো কাছে নায়ক আবার কারো কাছে খলনায়ক।
সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের তৃতীয় স্ত্রীর সংসারে বড় সন্তান মোহাম্মাদ বিন সালমান। সালমান বাদশাহ নিযুক্ত হয়েই পুত্র মোহাম্মাদ বিন সালমানকে দায়িত্ব দেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর। তখন তার বয়স মাত্র ৩০ বছর। এর আড়াই বছর পর ২০১৭ সালে জুন মাসে ভাতিজা মোহাম্মাদ বিন নায়েফকে ক্রাউন প্রিন্সের পদ থেকে সড়িয়ে সেই পদে আনেন পুত্রকে। সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে আছে বিতর্ক। আর ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই খুব দ্রæত সৌদি আরবের কার্যত প্রধান হয়ে ওঠেন এমবিএস। বাদশাহ সালমানের অসুস্থতার কারণে তিনিই দেশটির সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। অনেকে বলেন, বিন সালমানের এখন শুধু সিংহাসনে বসাটাই বাকি আছে। বর্তমানে উপপ্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, অর্থনৈতিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যানসহ অনেকগুলো পদ তার দখলে।
২০১৫ সালে এমবিএস প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার কিছুদিন পরই শুরু হয় ইয়েমেন যুদ্ধ। প্রেসিডেন্ট আব্দুর রব্বুহ মানসুর হাদীর সরকারকে উৎখাত করে হাউছি যোদ্ধারা দেশটির রাজধানী সানা দখল করে। এরপর হাউছি যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা শুরু করে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট। ছয় বছর হতে চললেও সেই যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। ইরান সমর্থিত শিয়া হাউছি বিদ্রোহীদের পরাজিত করতে পারেনি সৌদি জোট। বলা হচ্ছে যে, তৎকালীন প্রতিরক্ষমন্ত্রী মোহাম্মাদ বিন সালমানের সিদ্ধান্তেই ইয়েমেন যুদ্ধে জড়িয়েছে সৌদি আরব।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ, ইয়েমেনে সৌদি বিমান বাহিনী নির্বিচারে বেসামরিক এলকায় হামলা চালিয়েছে। যাতে ধ্বংস হয়েছে হাসপাতাল, স্কুলসহ অনেক স্থাপনা। প্রাণ হারিয়েছে অনেক বেসামরিক নাগরিক। উদ্বাস্তু হয়েছে লাখ লাখ মানুষ । কিন্তু এতকিছু করেও হুতিদের বিরুদ্ধে জিততে পারেনি সৌদি আরব।
ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই এমবিএস জন্ম দেন বহুল আলোচিত এক ঘটনার। সেটি রিজ-কার্লটন কান্ড হিসেবে পরিচিত। ওই ঘটনায় হঠাৎ করেই গ্রেফতার করা হয় অনেককে। এদের মধ্যে ছিলেন সৌদি রাজপরিবারের অনেক সদস্য, দেশের শীর্ষ ধনী ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কযেকজন ব্যক্তি। দুর্নীতি দমনের নামে ওই ব্যক্তিদের গ্রেফতার করে রাখা হয় রিয়াদের বিলাসবহুল রিজ-কার্লটন হোটেলে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এমবিএস নিজের ক্ষমতার প্রতি যাদের হুমকি মনে করতেন তাদের গ্রেফতার করা হয় ওই অভিযানে। অনেককে মুচলেকা দিয়ে, অনেকের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে কয়েক সপ্তাহ পর মুক্তি দেয়া হয়। জব্দ করা হয় অন্তত ১০০ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের সম্পদ। নিউ ইয়র্ক টাইমস এক রিপোর্টে বলেছে, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে অন্তত ১৭ জনকে পরবর্তীতে চিকিৎসা নিতে হয়েছে, যাদের ওপর চালানো হয়েছিল নির্যাতন।
২০১৭ সালের ৫ জুন হঠাৎ করেই উপসাগরীয় ছোট্ট দেশ কাতারের সাথে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয় সৌদি আরব। একই সাথে দেশটির ওপর আরোপ করা হয় অবরোধ। সৌদি আরবের সাথে যোগ দেয় সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিসরসহ কয়েকটি দেশ। ছোট্ট দেশ কাতার প্রতিবেশী দেশগুলোর এমন বৈরী আচরণে বেশ সঙ্কটে পড়ে। তবে শেষ পর্যন্ত দেশটি টিকে গেছে। কাতারের কাছে আলজাজিরা চ্যানেল বন্ধ করা এবং মিসরের মুসলিম ব্রাদার হুডের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করাসহ বেশ কিছু দাবি ছিলো সৌদি আরবের। যদিও শেষ পর্যন্ত তারা সফল হতে পারেনি। কাতারের বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপের মাস্টার মাইন্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয় সৌদি যুবরাজ মোহাম্মাদ বিন সালমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মাদ বিন জায়েদকে। এই ঘটনার পর অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়ে উপসাগরীয় দেশগুলোর জোট জিসিসি।
২০১৮ সালে বেশ কিছু সমাজ ও নারী অধিকার কর্মীকে গ্রেফতার করা হয় সৌদি আরবে। ওই ঘটনায় তোলপাড় হয় সারা বিশ্বে। বিশেষ করে পশ্চিমা গণমাধ্যম এই ঘটনার জন্য দায়ী করে মোহাম্মাদ বিন সালমানকে। ওই ব্যক্তিরা এখনো জেলে আছেন। তাদের গ্রেফতার নিয়ে প্রতিবাদ করায় কানাডার সাথে শুরু হয় কূটনৈতিক বিরোধ। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় রিয়াদে নিযুক্ত কানাডীয় রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করে সৌদি সরকার। কানাডার সাথে সব বাণিজ্য স্থগিত ও কানাডায় থাকা সকল সৌদি ছাত্রকে দেশে ফেরার আদেশ দেয়া হয়। এছাড়া বেশ কয়েকজন ভিন্নমতাবলম্বী আলেমের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় দেশটিতে।
তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে যায় জামাল খাশোগি হত্যাকান্ড। ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুল নগরীর সৌদি কনস্যুলেটে হত্যা করা হয় এমবিএসের সমালোচক হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে। এই ঘটনায় তোলপাড় হয়েছে বিশ্ব রাজনীতিতে। রাষ্ট্রীয় হত্যাকান্ড হিসেবে আখ্যা পেয়েছে সেটি।
সেদিন প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আনতে কনস্যুলেট ভবনে গিয়েছিলেন খাশোগি। আর ফেরা হয়নি তার। আগে থেকেই তার জন্য কনস্যুলেট ভবনে ওৎ পেতে ছিলো ১৫ সদস্যের একটি কিলিং টিম। হত্যার পর লাশ গোপন করে ফেলা হয়। সৌদি আরব প্রথমে অস্বীকার করলেও তুরস্কের তদন্তে বের হয়ে আসে আসল ঘটনা। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তুর্কি গোয়েন্দারা হত্যকান্ডের সময়কার অডিও টেপসহ হাজির করে অনেক প্রমাণ। জানা যায়, প্রশিক্ষিত খুনিরা একটি বিশেষ বিমানে সৌদি আরব থেকে গিয়েছিল ইস্তাম্বুলে।
হত্যাকান্ডের পর লাশ গোপন করার ব্যবস্থা করে আবার তারা ফিরে যায় সৌদিতে। ঘটনায় উঠে আসে সৌদি আরবের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের জড়িত থাকার প্রমাণ। আর সেটি যে মোহাম্মাদ বিন সালমানকেই নিদের্শ করে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শেষ পর্যন্ত রিয়াদ স্বীকার করতে বাধ্য হয় সৌদি নাগরিকদের হাতেই ওই হত্যাকান্ড হয়েছে। তবে বিন সালমান ওই হত্যাকান্ডের নির্দেশদাতা নয় বলেই তারা এখনো দাবি করছে।
এসব ঘটনা ছাড়াও লেবানের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরিকে আটকে রেখে পদত্যাগে বাধ্য করা। তেল ট্যাঙ্কারে হামলা নিয়ে ইরানের সাথে উত্তেজনা, ভিন্নমতাবলম্বীদের গণহারে গ্রেফতারসহ অনেক ঘটনায় নেতিবাচকভাবে আলোচনায় আসেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মাদ বিন সালমান।
তবে মুদ্রার উল্টো পিঠের চিত্রটা আবার ভিন্ন। সৌদি আরবের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে সংস্কারের যে মাস্টার প্ল্যান হাতে নিয়ে মাঠে নেমেছেন বিন সালমান তা প্রশংসা কুড়িয়েছে সারা দুনিয়ায়। দীর্ঘদিনের নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে মহিলাদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দিয়েছেন। মহিলাদের দেয়া হয়েছে স্টেডিয়ামে গিয়ে ফুটবল খেলা দেখারও অনুমতি। এছাড়া সিনেমা, থিয়েটার চালু করেছেন রক্ষণশীল সৌদি সমাজের প্রথা ভেঙে। শিক্ষা, চিকিৎসা, বিদেশী শ্রমিক নিয়োগসহ অনেক ক্ষেত্রে নিয়েছেন যুগান্তকারী কিছু সিদ্ধান্ত।
সবচেয়ে বড় মিশন নিয়ে নেমেছে অর্থনীতিতে যেটি ভিশন ২০৩০ নামে পরিচিত। দীর্ঘদিনের তেল নির্ভরতা থেকে সৌদি অর্থনীতিকে বের করতে আনতে চান এই নেতা। অনেকে বলছেন, এটি একটি সূদূর প্রসারী ও বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত। কারণ মাটির নিচের তেলের রিজার্ভ শেষ হয়ে গেলে দেশটির ভবিষ্যত কী হবে সেটি নিয়ে আগে চিন্তা করতে দেখা যায়নি কোন সৌদি শাসককে। এমবিএস এই জায়গাটিতে মনযোগ দিয়েছেন।
পর্যটনসহ বিভিন্ন সেক্টরে বিনিয়োগ করে অর্থনীতিকে সম্প্রসারিত করার মাস্টারপ্ল্যান হাতে নিয়েছেন তিনি। আরামকোসহ রাষ্ট্রীয় অনেক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ছাড়তে শুরু করেছেন বেসরকারি খাতে। যার ফলে অনেকেই বলছেন, সৌদি আরবকে বদলে দিতে পারেন এই যুবক।
ইতিবাচক আর নেতিবাচক - এই দুই ইমেজের মধ্যে মোহাম্মাদ বিন সালমান কোন পরিচয়ে বিশ্বে পরিচিত হবেন সেটি বলতে আরো সময় লাগবে। যদি তিনি সৌদি আরবকে সত্যি বদলে দিতে পারেন তবে ইতিহাসে অবশ্যই তার নাম লেখা থাকবে। আবার নেতিবাচক যেসব কর্মকান্ড ঘটাচ্ছেন সেগুলোও মুছে যাবে না ইতিহাসের পাতা থেকে। তাই এমবিএস নায়ক নায়ক নাকি খলনায়ক সেই বিতর্কের এখনই সমাপ্তি টানা যাচ্ছে না। এ জন্য অপেক্ষা করতে হবে হয়তো আরো অনেক দিন।
প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে