ড্রোন যেভাবে পাল্টে দিল লিবিয়া যুদ্ধের গতিপথ

যুদ্ধে এখন মনুষ্যচালিত যুদ্ধবিমানের পরিবর্তে শুরু হয়েছে আনম্যানড এরিয়াল ভেহিকেল বা ইউএভি’র ব্যবহার - ইন্টারনেট

  • আহমেদ আবদুল্লাহ
  • ০৭ জুন ২০২০, ১৯:৪১

নতুন মোড় নিয়েছে লিবিয়ার যুদ্ধ। খলিফা হাফতারের লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। লিবিয়া ছেড়েছে হাফতার বাহিনীর হয়ে কাজ করা অনেক মার্সেনারি বা ভাড়াটে যোদ্ধা। রাজধানীর নিরাপত্তা জোরদার করার পাশাপাশি উপকূলীয় বেশ কয়েকটি শহর দখল করেছে জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের অনুগত বাহিনী। এই বাহিনীকে সহযোগিতা করছে তুরস্ক। যুদ্ধের এই দৃশ্যপট পাল্টানোর মূলে ছিলো বিমান হামলা।

বিমান হামলার সামর্থ বেশি থাকায় একের পর এক অঞ্চল দখল করে রাজধানী অভিমুখে এগিয়ে যাচ্ছিলো হাফতার বাহিনী। তাদের হাতে আছে চীনের উইং লং ড্রোন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে হাফতার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যান। সরকারি বাহিনীর হাতে এসে পৌছায় তুরস্কের তৈরি সর্বাধূনিক বেরাকতার ড্রোন। আর এতেই পাল্টে গেছে যুদ্ধের গতিপথ।

২০১৪ সালে শুরু হওয়া লিবিয়ার এই গৃহযুদ্ধকে বলা হচ্ছে দেশটির দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধ। এর দুটি পক্ষ- এক দিকে জাতিসংঘ সমর্থিত প্রধানমন্ত্রী ফয়েজ আল সিরাজের ত্রিপোলি ভিত্তিক সরকার। যাদের সহযোগিতা করছে তুরস্ক, কাতার ও ইতালি। অন্য দিকে সামরিক কমান্ডার জেনারেল খলিফা হাফতারের অনুগত বাহিনী। যাদের পক্ষে আছে রাশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এক বছর ধরে হাফতার বাহিনী একের পর এক অঞ্চল দখল করে চললেও সম্প্রতি তারা পিছু হঠতে শুরু করেছে। হঠাৎ করে লিবিয়ার গৃহযুদ্ধের এই গতিপথ পাল্টে যাওয়ার নেপথ্যে রয়েছে আকাশ পথে লড়াই বা বিমান হামলা। আরো স্পষ্ট করে বললে ড্রোন হামলাই এই যুদ্ধের সমীকরণ অনেকটা পাল্টে দিয়েছে।

উত্তর লিবিয়ার মরু অঞ্চলের এবং উপকূলীয় অঞ্চলের সামরিক অবস্থানগুলো আকাশ থেকে সহজেই চিহ্নিত করা যায়। এসব এলাকায় খুব কম জায়গায়ই আছে যেগুলো গোপন থাকছে প্রতিপক্ষের কাছে। যে কারণে আকাশ থেকে হামলা অনেকটা সহজ হয়ে গেছে। এই সুবিধাটা নিয়েছে উভয় পক্ষই- জাতিসংঘ সমর্থিত সরকার ও পূর্বাঞ্চলীয় খলিফ হাফতারের লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি। শুরুর দিকে উভয় বাহিনীই ব্যবহার করতো ফরাসি ও সোভিয়েত যুগের যুদ্ধবিমান। যা এখন অনেকটাই অপ্রচলিত এবং এর প্রযুক্তিগত সুবিধাও কম।

তবে এই ধারায় পরিবর্তন এসেছে ড্রোন আসার পর। যুদ্ধে এখন মনুষ্য চালিত যুদ্ধবিমানের পরিবর্তে শুরু হয়েছে আনম্যানড এরিয়াল ভেহিকেল বা ইউএভি’র ব্যবহার। সাধারণ মানুষের কাছে কাছে যা ড্রোন নামে পরিচিত। সম্প্রতি এই লিবিয়া যুদ্ধে এই ড্রোনের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারণেই মূলত যুদ্ধের এই বাক পরিবর্তন। দেশটিতে গত কিছুদিনে প্রায় এক হাজার হামলা হয়েছে ড্রোন ব্যবহার করে। লিবিয়া বিষয়ক জাতিসঙ্ঘের বিশেষ প্রতিনিধি ঘাসান সালামির ভাষায়, লিবিয়া সঙ্ঘাত এখন পর্যন্ত বিশ্বের সর্ববৃহৎ ড্রোন যুদ্ধ।

যুদ্ধক্ষেত্রে ড্রোন ব্যবহার বৃদ্ধির অনেকগুলো কারণ রয়েছে। অনেক দূরের সামরিক ঘাঁটিতে কম্পিউটারের সামনে বসে চালানো এই ড্রোন শত্রুর ভূখন্ডে ঢুকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যেমন সংগ্রহ করতে পারে, তেমনি হামলার জন্য টার্গেট নির্ধারণ করতে পারে নিখুত ভাবে। হামলার ক্ষেত্রেও এর টার্গেট খুব বেশি মিস হয় না। আবার শত্রুর গুলিতে যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হলে পাইলট নিহত বা ধরা পরার যে ভয় থাকে, ড্রোন ভূপাতিত হলেও সেটি থাকে না। অনেকটা ভিডিও গেমের মতো, একটি ড্রোন শত্রুর হাতে ভূপাতিত হলে অপারেটর সাথে সাথেই আবার আরেকটি পাঠাতে পারেন ওই এলাকায় হামলা চালাতে।

লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে ড্রোনের ব্যবহার শুরু হয় ২০১৬ সালে। ওই বছর খলিফা হাফতারের লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির হাতে আসে চীনের তৈরি উইং লং ড্রোন। তখন থেকেই তাদের শক্তি ও সফলতা বাড়তে থাকে। পূর্ব লিবিয়ার দেরনা যুদ্ধে এই বাহিনী প্রথম উইং লং ড্রোন ব্যবহার করে। রক্তক্ষয়ী সেই লড়াইয়ে দারুণ সফলতা দেখায় উইং লং ড্রোন। লিবিয়ার আল খাদিম ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করলেও ওই ড্রোনগুলো অপারেট করা হতো দেড় হাজার কিলোমিটার দূরের সংযুক্ত আরব আমিরাতের মাটি থেকে। ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা ছুড়তে পারে এই ড্রোনগুলো, হামলা চালাতে পারে লিবিয়ার যে কোন স্থানে।

২০১৯ সালের এপ্রিলে শুরু হওয়া হাফতার বাহিনীর রাজধানী ত্রিপোলি অভিমুখে অভিযানেও এই উইং লং ড্রোন ব্যবহৃত হয়। যার ফলে একের পর এক সাফল্য পেয়ে ত্রিপোলি অভিমুখে এগিয়ে যেতে থাকে তারা। রাজধানীতে কোনঠাসা ও অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে সরকারি বাহিনী। তবে ওই হামলায় প্রচুর বেসামিরক লোক হতাহত হতে থাকে, কারণ উইং লং ড্রোনের হামলাগুলো নির্ভূলভাবে টার্গেটে আঘাত হানতে পারেনি। শহরের অনেক বাড়ি ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে ড্রোনের হামলায়।

ওই অবস্থায় ত্রিপোলির সরকার টিকে থাকতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ দেখায় দেয়। সরকারি বাহিনীর প্রতি ইতালি ও কাতারের সহযোগিতা থাকলেও হাফতার বাহিনী দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে। ঠিক তখনই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোয়ান ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ঘোষণা দেন লিবিয়া সরকারের পক্ষে তার দেশের সামরিক সহযোগিতা দেবে।

সৈন্য ও অস্ত্রসস্ত্রের সাথে এরদোগান লিবিয়ায় পাঠান তুরস্কের নিজস্ব উদ্ভাবিত বেরাকতার টিবি টু ড্রোন। আর এরপরই মোড় ঘুরে যেতে থাকে যুদ্ধের। চীনের উইং লং ড্রোনের চেয়ে সাইজে ছোট ও উড্ডয়ন রেঞ্জ কম হলেও বেরাকতার ড্রোন হাফতার বাহিনীর অবস্থানগুলোতে নির্ভূলভাবে আঘাত হানতে শুরু করে। তাদের রসদ সরবরাহ লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত বিমান ঘাঁটিগুলোতেও হামলা চালায় সফলতার সাথে।

আকাশ হামলার সহায়তা নিয়ে দ্রুত অগ্রসর হতে থাকে সরকারের স্থল বাহিনী। ড্রোনের সংগৃহীত তথ্যের কারণে শত্রæর অবস্থান সম্পর্কেও নির্ভূল ধারণা ছিলো তাদের কাছে।

হক মিসাইলসহ আকাশ পথে লড়াইয়ের অনেকগুলো উপাদান যুক্ত আছে এই বেরাকতার ড্রোনে। যার কারণে সরকারি বাহিনী তাদের প্রধান বিমান ঘাঁটি ত্রিপোলির মিতিগা এয়ারপোর্ট থেকে এখন নির্ভয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারছে।

বেরাকতার ড্রোনের সহায়তায় হাফতার বাহিনীকে প্রতিরোধের পাশাপাশি অন্য এলাকায় পাল্টা হামলাও শুরু করে সরকারি বাহিনী। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে উপকূলীয় শহর সুরমান, সাবরাতাহ ও আল আজায়লাতসহ চারটি শহর অবরোধ করে তারা। হাফতার বাহিনীর অপারেশন পরিচলানার প্রধান কেন্দ্র আল ওয়াতিয়া বিমান ঘাঁটিতে হামলা শুরুর পরপরই চলে এই অভিযান। শেষ পর্যন্ত মে মাসের ১৮ তারিখে আর ওয়াতিয়া বিমান ঘাঁটি পুনর্দখল করে সরকারি বাহিনী। ওই বিমান ঘাঁটিটি শুধু হাফতার বাহিনীর হেডকোয়ার্টারই ছিল না, সেটি ছিলো তাদের রসদ ও যুদ্ধ সামগ্রিরও প্রধান কেন্দ্র।

হামলার পর হাফতার বাহিনী ঘাঁটিটি ছেড়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। হামলায় ওই ঘাঁটিতে থাকা আরব আমিরাতের কাছ থেকে পাওয়া প্যান্টসার এস ওয়ান আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয় তুরস্কের বেরাকতার ড্রোন। রাশিয়ার তৈরি এই অত্যাধুনিক অস্ত্রটি কোন সুরক্ষাই দিতে পারেনি হাফতার বাহিনীকে। প্যান্টসার ওয়ানের রাডারে তুর্কি সেনারা এমনভাবে জ্যাম সৃষ্টি করেছিল যে সেটি হামলা সম্পর্কে কোন পূর্ব ধারণাই করতে পারেনি। অসহায় আত্মসমার্পন করা ছাড়া কিছুই করার ছিলো না তার।

রাজধানী ত্রিপোলি দখলের অভিযানেও হাফতার বাহিনীকে মূলত পিছু হটতে বাধ্য করেছে এই বেরাকতার ড্রোন। এক সময় মনে হচ্ছিল জেনারেল হাফতার বুঝি রাজধানী দখল করে নেবে; কিন্তু তারা এখন পিছু হটতে ব্যস্ত। আলজাজিরা খবরে বলা হয়েছে, অবস্থা খারাপ দেখে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে দেড় হাজার ভাড়াটে রুশ যোদ্ধা পালিয়ে গেছে। রাশিয়ার বেসরকারি সামরিক সংস্থা ওয়াগনার গ্রুপের এই ভাড়াটে যোদ্ধারা লড়াই করছিল হাফতার বাহিনীর হয়ে। বানি ওয়ালিদ এয়ারপোর্ট থেকে একটি কার্গো বিমান তাদের নিয়ে উড়াল দেয়।

হাফতার বাহিনীর জন্য সুখবরও আছে। মার্কিন সেনাবাহিনীর আফ্রিকা কমান্ড জানিয়েছে, সিরিয়ার খেমেইমিন বিমান ঘাঁটি থেকে লিবিয়ার জুফরার উদ্দেশ্যে উড়ে গেছে কয়েকটি রুশ যুদ্ধ বিমান। যারা হাফতার বাহিনী ও তার মিত্রদের হয়ে কাজ করবে। মিগ-২৯এস, দুটি সুখোই এস-২৪ এবং অন্তত দুটি এস-৩৫ অ্যাডভান্স জেনারেশন ফাইটার উড়ে গেছে লিবিয়ায়। যুক্তরাষ্ট্র এই বিমান উড্ডয়নের স্যাটেলাইট ফটো বিশ্লেষণ করে এই তথ্য দিয়েছে।

এই ঘটনা যদি সত্যি হয় তাহলে বলতে হবে, হাফতার বাহিনীও তাদের আকাশ হামলার নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। এবং সেটি হবে তুরস্কসহ ত্রিপোলির সরকারি বাহিনীর জন্য নতুন একটি চ্যালেঞ্জ। যুক্তরাষ্ট্র আশঙ্কা করছে, রাশিয়া হয়তো লিবিয়ার উপকূলীয় এলাকা দখল করে সেখানে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম স্থাপন করবে।

রুশ বিমান শক্তি যদি লিবিয়া যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয় তাহলে বলতে হবে এই যুদ্ধের আরো অনেক কিছুই বাকি আছে এখনো। আরো অনেক পট পরিবর্তন হয়তো আমরা দেখবো সামনের দিনগুলোতে। যুদ্ধে সব সময়ই বিমান হামলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু লিবিয়া যুদ্ধে তা যেভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে আগামী দিনে বিশ্বের জন্য তাকে সতর্ক সঙ্কেতই বলতে হবে।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে