লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে তুরস্ক বড় ধরনের জয়ের পথেই বলে মনে হচ্ছে। তুরস্ক লিবিয়ায় বন্ধুভাবাপন্ন সরকারকে শক্তপোক্তভাবে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হলে পাল্টে যেতে পারে মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামপন্থী ও রাজনৈতিক ইসলামের বিরোধী জোটের দীর্ঘ লড়াইয়ের দৃশ্যপট। এতে কোণঠাসা হয়ে পড়তে পারে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর ও ইসরাইল জোটের ভবিষ্যত পরিকল্পনা। মধ্যপ্রাচ্যে আবার উত্থান হতে পারে ইসলামপন্থীদের। কিভাবে ঘটতে পারে এই পরিবর্তন, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে আজ তুলে ধরব।
লিবিয়ায় তুরস্কের সামরিক সহায়তার পেছনে আছে পূর্ব ভ‚মধ্যসাগরের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আংকারার জটিল হিসাবনিকাশ। লিবিয়ার সঙ্গে মেরিটাইম বা সমুদ্রসীমা চুক্তির মাধ্যমে তুরস্ক সেই স্বপ্ন পূরণের পথে অনেকটা এগিয়ে গেছে। লিবিয়ায় তুরস্ক চূড়ান্ত জয় পেলে এই পথ আরও সমৃণ হবে আংকারার জন্য।
মেরিটাইম চুক্তির মাধ্যমে তুরস্ক তার প্রতিপক্ষ ইসরাইল, মিশর, লেবানন ও গ্রিসের একটি তেল পাইপলাইন চুক্তিতে ভন্ডুল করে দিতে অনেকাংশে সক্ষম হয়েছে। ভূমধ্যসাগরে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান প্রকল্প নিয়ে বিভক্ত সাইপ্রাস ইস্যুতে ১৪ বছর ধরে গ্রিসের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে আছে তুরস্ক। লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে এই বিরোধ চরমে পৌছেছে। এই বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে বিদেশি শক্তিগুলোও। তবে সম্প্রতি লিবিয়ার সঙ্গে মেরিটাইম চুক্তির পর তুরস্ক বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে চলে গেছে।
মধ্যপ্রাচ্যেও সিরিয়া ও ইয়েমেনে এখনও যুদ্ধ চলছে। তবে লিবিয়ার যুদ্ধেই বিশ^শক্তির আগ্রহ বেশি। লিবিয়া তেল ও গ্যাসে সমৃদ্ধ হলেও জ্বালানি তেল এখানে মুখ্য নয়। ভ‚রাজনৈতিক অবস্থানই বিভিন্ন শক্তিকে লিবিয়ায় লোলুপ দৃষ্টি ফেলতে বাধ্য করছে।
তবে এই সমীকরণ দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। তুরস্ক যুদ্ধে নিবিড়িভাবে জড়িয়ে পড়ার পর রাশিয়া এখন সেখান থেকে বিদায় নেওয়ার পথ খুঁজছে। রাশিয়া তার দেশের ভাড়াটে সেনাদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে তুরস্কের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে।
রাশিয়া চেয়েছিল হাফতারকে ক্ষমতায় বসিয়ে লিবিয়ায় সামরিক ঘাটি তৈরি করে তার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বাড়াতে। তবে মস্কোর সেই আশার গুড়ে বালি পড়তে শুরু করেছে। হাফতারের একের পর এক পরাজয়ের পর রাশিয়া লিবিয়ায় কয়েকটি জঙি বিমান পাঠালেও তার উদ্দেশ্য সেখানে যুদ্ধ জয় নয়। বরং তুরস্ককে কিছুটা চাপে রেখে নিজেদের সৈন্য সরিয়ে নেওয়া ছিলো মস্কোর লক্ষ্য। তুরস্কও কৌশলগত কারণে তাতে রাজি হয়। এ নিয়ে গোপনে তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যে সমঝোতা হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।
লিবিয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হিসাবনিকাশও পাল্টে যাচ্ছে। আমেরিকা সরকারিভাবে লিবিয়ায় জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারকে সমর্থন দিলেও তলে তলে হাফতারকে ক্ষমতায় বসাতে চাইছিল। কারণ হাফতার শুরু থেকেই ছিলেন সিআইএর চর। আশির দশকে তিনি গাদ্দাফিকে উৎখাতের চেষ্টা করে আমেরিকায় নির্বাসিত জীবন কাটান। তবে রাশিয়া লিবিয়া যুদ্ধে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়ার আমেরিকার মোহভঙ্গ ঘটেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার জঙ্গিবিমান মোতায়েনের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিয়েছে। আর এতে সুবিধা পাচ্ছে তুরস্ক।
আরব বসন্তের পর মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্রের যে সূচনা ঘটতে শুরু করেছিল তাকে ব্যর্থ করে দিতে মরিয়া হয় সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। বিপরীত মেরুতে অবস্থান নেয় তুরস্ক ও ক্ষুদ্র ধনী দেশ কাতার।
আরব বসন্তের পর মিশরে ইসলামপন্থী ও গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও তাকে টিকতে দেয়নি সৌদি ও আমিরাত। অন্যদিকে তিউনিসিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। লিবিয়ায়ও নিজেদের অনুগত সরকার বসাতে চেয়েছিল তারা। তবে সৌদি ও আমিরাতের এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে তুরস্কের নেতৃত্বে রাজনৈতিক ইসলামের অনুসারীরা। তুরস্ক এতে কাতার ও তিউনিসিয়ার পাশাপাশি কৌশলগত কারণে ইতালিরও সমর্থন পাচ্ছে। তাদের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে সৌদি আরব, মিশর, আমিরাত, জর্ডান ও ফ্রান্স।
গত বছরের এপ্রিল থেকে ত্রিপোলি দখলের অভিযান শুরু করেন খলিফা হাফতার। যাকে অনেক উদীয়মান স্বৈরাচার বলে মনে করে থাকেন। ২০১১ সালে লিবিয়ার স্বৈরশাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে উৎখাতে ন্যাটোর সামরিক হামলার পর এটাই ছিল দেশটির সবচেয়ে সব সংঘাত।
২০১৯ সালের শেষ দিকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান লিবিয়ার বিপন্ন সরকারের পাশে দাড়ান। তিনি ত্রিপোলির সরকাকে প্রকাশ্যে সাহায্যের ঘোষণা দেন। তিনি লিবিয়ার সঙ্গে মেরিটাইম সীমান্ত ও সামরিক সহযোগিতা চুক্তি করেন। এতে বিপাকে পড়ে যায় তুরস্কের প্রতিপক্ষ।
ত্রিপোলিভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক সাদেক ইন্সটিটিউটের পরিচালক আনাস আল গোমতি বলেন, এটা ছিল তুরস্কের একটি স্মার্ট পদক্ষেপ। এতে ত্রিপোলি সরকার উজ্জীবিত হয়েছে।
তুরস্ক চায় গাদ্দাফির আমলে নির্মাণ খাতে ঠিকাদারি বাবদ পাওনা শত শত কোটি ডলার আদায় করতে। আর এজন্য তার দরকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারকে টিকিয়ে রাখা।
গাদ্দাফির সময়ে লিবিয়ায় বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে তুরস্ক। নির্মাণ কাজে বিনিয়োগ করা হয় শত শত কোটি ডলার। তখন তুরস্কের প্রওায় ২৫ হাজার নাগরিক লিবিয়ায় কাজ করতেন। লিবিয়ার কাছে তুরস্কের পাওনা দাড়ায় ১৫০০ কোটি ডলার। তবে আরব বসন্তের জেরে লিবিয়ায় গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন শুরু হলে তুরস্ক গাদ্দাফিকে গণদাবি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানায়। এতে গাদ্দাফি সাড়া না দিলে তুরস্ক ন্যাটোর সামরিক অভিযানে সমর্থন দেয়।
তুরস্কের সমর্থনে লিবিয়া যুদ্ধের মোড় ঘুরে যাচ্ছে। তুরস্কের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ড্রোনের হামলার কুপোকাত হয়ে পড়েছে হাফতার বাহিনী। হাফতারের সামরিক ঘাঁটিসহ কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বহু এলাকা দখল করে নিয়েছে তুর্কি সমর্থিত বাহিনী।
লিবিয়ার সঙ্গে তুরস্কের মেরিটাইম চুক্তির ফলে আংকারা এখন তার প্রতিপক্ষের একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্যাস পাইপলাইন আটকে দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করেছে। গ্রিস, ইসরাইল, মিশর ও গ্রিক সাইপ্রিয়ট একটি কনসোর্টিয়াম গঠন করে ইস্টমেড নামের এই পাইপলাইন প্রকল্প তৈরির উদ্যোগ নেয়। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে তারা ভ‚মধ্যসাগর থেকে গ্যাস উত্তোলন করে দক্ষিণ ইউরোপে রফতানির উদ্যোগ নেয়।
লিবিয়ার সঙ্গে তুরস্কের চুক্তির ফলে এই পাইপলাইন আটকে দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করেছে তুরস্ক। এখন ইসরাইল চাচ্ছে তুরস্কের সঙ্গে জোট বেধে পাইপলাইনে যুক্ত হতে। এজন্য তুরস্কের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্র্ক বাড়াতেও মরিয়া ইসরাইল। তুরস্ক চাচ্ছে কৃষ্ণ সাগর, এজিয়ান সাগর ও ভূমধ্যসাগরে উপস্থিতি জোরদার করতে।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ড্রাগন এনার্জির পরিচালক মুস্তফা কারাহান বলেন, ভূমধ্যসাগরে তেল ও গ্যাসের ওপর নিয়ন্ত্রণ এখন আর অর্থনৈতিকভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নয়। তুরস্কের জন্য গ্যাস সরবরাহ এখন জরুরি কোনো বিষয় নয়। এটা হলো আসলে রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াই। ভূমধ্যসাগরে জ্বালানি প্রকল্পে ব্যয় হলো প্রতিরক্ষা বাজেটের মতো বিষয়। শত্রুর আগেই আপনাকে পদক্ষেপ নিতে হবে। গত ১৭ বছরে এরদোয়ান দেখিয়েছেন যে তিনি ঝুকি নিতে পিছপা হন না।
হাফতারের স্বৈরাচারি মানসিকতাও লিবিয়া ও তুরস্ক সরকারকে সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করে দিয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ত্রিপোলি দখলের জন্য একটি রুদ্ধশ্বাস অভিযানের প্রস্তুতি নিয়েছিল তার মিত্র দেশগুলো। কিন্তু হঠাৎ হাফতার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করায় সেই অভিযান বাতিল করা হয়। গত জুলাইতে ওই অভিযানের জন্য আমিরাতের সরকার ঘনিষ্ঠরা ৮ কোটি ডলার দিতে চেয়েছিল। কথা ছিল আকাশ ও সমুদ্রপথে কমান্ডো অভিযানে দখল করা হবে ত্রিপোলি।
এজন্য দুজন সাবেক ব্রিটিশ মেরিন পাইলট স্পিডবোট নিয়ে প্রস্তুত হয়েছিলেন। মাল্টা থেকে ভ‚মধ্যসাগর হয়ে অভিযানের জন্য প্রস্তুতি ছিল কমান্ডো স্পিডবোড, বতসোয়ানা থেকে আনা হয়েছিল ছয়টি হেলিকপ্টল্টার। প্রস্তুত ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের ভাড়াটে কমান্ডোরা। তারা এসেছিলে জর্ডান হয়ে। এদের সবাই ব্যবহার করছিল ছদ্মপরিচয়।
২০ সদস্যের ওই ভাড়াটে কমান্ডোদের বেনগাজিতে মোতায়েন করা হয়েছিল। এর নেতৃত্বে ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বিমানবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা স্টিভ লজ। তিনি ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীতে কাজ করেছেন। নাইজেরিয়ায় প্রাইভেট সামরিক কক্ট্রাক্টর হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। এ বাহিনীর অন্য সদস্যরাও ছিল সাবেক সেনা কর্মকর্তা। দক্ষিণ আফ্রিকার ১১ জন, ব্রিটেনের ৫ জন, দুইজন অস্ট্রেলিয়ার এবং একজন আমেরিকার প্রশিক্ষিত পাইলট। তারা ত্রিপোলি সরকারের কাছে সাগরপথে তুরস্কের একটি সরবরাহ করা অস্ত্রের চালানে কমান্ডো হামলা চালাতে চেয়েছিল। জাতিসংঘের তদন্তে বেরিয়ে আসে, স্পিডবোড ও হেলিকপ্টারের সাহয্যে ওই চালানে হামলার করতে চেয়েছিল।
বেনগাজিতে খলিফা হাফতার হেলিকপ্টারগুলো দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। কারণ সেগুলো ছিল বেশ পুরনো। অথচ তাকে কোবরা অ্যাটাক হেলিকপ্টার কিংবা গোয়েন্দা নজরদারিতে ব্যবহৃত লাসা টি বার্ড টাইপের শক্তিশালী হেলিকপ্টার দেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছিল। হাফতারকে বুঝাতে ব্যর্থ হয়ে ওই ভাড়াটে সেনারা ২ জলাই রাতে বেনগাজি ত্যাগ করেন। কিন্তু সমুদ্রে তাদের একটি বোট অচল হয়ে পড়ে। এরপর তারা অন্য একটি বোটে মাল্টার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়। কয়েক সপ্তাহ পর লিবিয়ার কোস্ট গার্ড পরিত্যক্ত বোটটি উদ্ধার করে। সেটির খবর ও ছবি তখন স্থানীয় গণমাধ্যমেও ছাপা হয়।
জাতিসংঘের এক তদন্তে এই ঘটনা বেরিয়ে আসে। হেলিকপ্টারের মান নিয়ে হাফতারের সাথে বিরোধের জেরে অভিযান বাতিল করা হয়। জাতিসংঘের তদন্তে বলা হয়েছে, আমিরাতের কিছু রহস্যময় কোম্পানি এতে অর্থায়ন করে। গত ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে অতি গোপনীয় ওই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে