তুরস্কের সঙ্গে ফ্রান্সের বিরোধ বহু পুরনো। লিবিয়ায় এখন দুদেশ বিপরীত মেরুতে অবস্থানের কারণে আবার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, পদে পদে ফ্রান্সের বাধা সত্ত্বেও ভূমধ্যসাগর ও ইউরোপের দক্ষিণাংশে তুরস্কের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। যা ভুমধ্যসাগরের উপকূলে প্রভাব বিস্তার নিয়ে নতুন এক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। যেখানে আরেক শক্তিশালী খেলোয়াড় রাশিয়াও রয়েছে।
তুরস্কের সঙ্গে বড় ধরনের বিরোধের জেরে ফ্রান্স ন্যাটোর একটি নিরাপত্তা মিশন থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দাবি করছে, তুরস্ক লিবিয়ার বিরুদ্ধে জারি করা অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা লংঘন করায় অপারেশন সি গার্ডিয়ান নামে সাগরে ন্যাটোর নিরাপত্তা অভিযানে ফ্রান্স আর আপাতত অংশ নেবে না। কয়েক সপ্তাহ আগে ফ্রান্স অভিযোগ করে যে তুরস্কের জাহাজ ভূমধ্যসাগরে ফরাসী রণতরীকে লক্ষ্য করে অস্ত্র তাক করেছে। তবে তুরস্ক এ অভিযোগ জোরলোভারে অস্বীকার করেছে । লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে ফ্রান্স ও তুরস্কের ক্রমবর্ধমান বিরোধের মধ্যেই এ ঘটনা ঘটে।
ন্যাটো সমর্থিত বাহিনী ২০১১ সালে কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে তেল সমৃদ্ধ দেশটি সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে লিবিয়ায় জাতিসংঘের সমর্থন পুষ্ট জিএনএ সরকার যুদ্ধবাজ নেতা খালিফা হাফতারের বাহিনীকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। খালিফা হাফতারের বাহিনীকে সমর্থন দিচ্ছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য ফ্রান্স। আর জিএনও সরকারকে সর্বাত্মক সহায়তা দিচ্ছে তুরস্ক। লিবিয়ার সঙ্কট, উত্তর সিরিয়ায় তুরস্কের ভূমিকা, এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তেল উত্তোলন নিয়ে সা¤প্রতিক মাসগুলোতে ফ্রান্সের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক ক্রমশই তিক্ত হয়ে উঠেছে।
ফ্রান্সের সাবেক ঔপনেবিশিক দেশগুলোতে নতুন করে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে যাচ্ছে ফ্রান্স। এ অঞ্চলের জ্বালানী সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্টা করতে চায় ফ্রান্স। আবার এসব দেশ এক সময় উসমানীয় শাসনের অধীনে ছিলো। স্বাভাবিকভাবে এসব দেশে আছে তুরস্কের প্রভাব বিস্তারের আকাঙ্খা। যা ফ্রান্স ও তুরস্ককে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
ন্যাটো সদস্য তুরস্ক ও ফ্রান্সের মধ্যে বড় ধরনের সর্ম্পকে চিড় ধরে গত ১০ জুন। সেদিন ফরাসী রণতরী কুরবে লিবিয়ার উপকূলে তানজানিয়ার পতাকাবাহী মালবাহী জাহাজ সারকিন পরিদর্শন করতে যায়। ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা বাহিনী বলছে, তুরস্কের জাহাজ এ সময় সারকিন জাহাজটিকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। তুরস্কের বক্তব্য ছিল ওই জাহাজে চিকিৎসা সরবরাহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু ওই সময় তুরস্কের জাহাজ তাদের রণতরী কুরবেকে লক্ষ্য করে আগ্রাসী আচরণ করে। এমনকি তিনবার তুরস্কের জাহাজ কুরবেকে লক্ষ্য করে অস্ত্র তাক করে বলে ফ্রান্স অভিযোগ করে। ফ্রান্স ন্যটোর প্রতি ওই ঘটনার তদন্ত করার আহ্বান জানায়।
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসগ্লু এ ঘটনায় ফ্রান্সকে ক্ষমা চাইতে বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, তুরস্ক এ ব্যাপারে ন্যাটোকে সব ধরনের তথ্য সরবরাহ করেছে। ন্যাটোর 'অপারেশন সি গার্ডিয়ান' তৎপরতা থেকে ফ্রান্স নিজেদের প্রত্যাহার করে নেবার পর ফ্রান্সের একজন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলছেন, ন্যাটোর মিত্র দেশ যেখানে জোটের দেওয়া নিষেধাজ্ঞার প্রতি সম্মান দেখায় না, সেখানে এই জোটের মিশনের সঙ্গে আমাদের থাকার কোন মানে হয় না।
আসলে ন্যাটোতে ফ্রান্সের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ম্যাক্রো অর্থনৈতিক কারণে ঝুঁ পড়ছেন চীন ও রাশিয়ার দিকে। লিবিয়ায় খলিফা হাফতারকে রাশিয়ার সাথে ফ্রান্সও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। যা যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। রাশিয়ার সাথে ফ্রান্সের এই ঘনিষ্টতা ভালোভাবে গ্রহন করছে না ইতালি। ইতোমধ্যে ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী তুরস্ক সফর করেছেন। পরোক্ষভাবে তুরস্কের অবস্থানকে সমর্থন করেছেন। লিবিয়া প্রশ্নে তুরস্কের অবস্থান সমর্থন করছে জার্মানীও।
অপরদিকে রাশিয়ার সাথেও লিবিয়া পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে তুরস্ক। তুরস্ক সমর্থিত জিএনএ সরকার যখন লিবিয়ার বিস্তৃত এলাকা দখল করে সেখানে হাফতারের পক্ষে রাশিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধার অবস্থান করছিলো। কিন্তু তাদের ওপর কোনো ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেনি। তারা রাশিয়া থেকে পাঠানো সামরিক বিমানে লিবিয়া ত্যাগ করে। খলিফা হাফতারকে সমর্থন দিলেও লিবিয়ায় ফ্রান্স বড় আকারে প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না। এক্ষেত্রে মিশরের সেনা শাসককে আব্দুল ফাত্তাহ সিসিকে ব্যবহার করতে চাইছে ফ্রান্স। কিন্তু লিবিয়ায় যুদ্ধে জড়ানোর মতো অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি নেই মিশরের।
এমন পরিস্থিতিতে দুই দেশই পরস্পরের বিরুদ্ধে কটূক্তি করেছে। ফরাসী প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ অভিযোগ করেছেন, তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য দেশ হওয়া স্বত্ত্বেও লিবিয়ার সংঘাতে দেশটি ঐতিহাসিক এবং অপরাধমূলক ভূমিকা নিয়েছে। জবাবে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন, উত্তর আফ্রিকার এই দেশটিতে ফ্রান্স একটা বিধ্বংসী ভূমিকা পালন করছে।
ফ্রান্স খলিফা হাফতারকে রাজনৈতিকভাবে সমর্থন দিচ্ছে। এসব অভিযোগ ফ্রান্স অস্বীকার করলেও রাশিয়াসহ হাফতারের মিত্রদের সমালোচনা করা থেকে বিরত রয়েছে । অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা লংঘন করে হাফতারকে অস্ত্র দেয়ার জন্য জাতিসংঘ আরব আমিরাতকে সতর্ক করা সত্ত্বেও এ নিয়ে কিছু বলেনি ফ্রান্স।
হাফতারকে রক্ষায় মিশরের স্বৈরশাসক আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি লিবিয়ায় সামরিক অভিযানের হুমকি দিলেও তাকে সমর্থন করেছে ফ্রান্স। প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ সিসির এই অবৈধ হুমকিকে আইনসংগত বলে মন্তব্য করেছেন।
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এর জবাবে বলেছে , ফ্রান্স একজন জলদস্যু এবং অভ্যুত্থানকারীকে সমর্থন দিচ্ছে। প্যারিস মূলত জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কাজ করছে। তিনি বলেন, ফ্রান্স অতীতে যেভাবে আফ্রিকার দেশগুলোতে উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল ঠিক একইরকম লক্ষ্য এখন লিবিয়াতে বাস্তবায়ন করতে চায়।
তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র অভিযোগ করছেন ২০১১ সালে লিবিয়া সংকটের শুরু থেকে মূল দায়ী ফ্রান্স। এ কথা আর গোপন নেই যে, লিবিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে কথা বলার সুযোগ পেতে দেশটি হাফতারকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়েছে। এছাড়া গাদ্দাফি হত্যার সাথে ফ্রান্সের গোয়েন্দাদের সংশ্লিষ্টতা ছিলো বলে অভিযোগ রয়েছে।
তুরস্ক বলছে লিবিয়ার আঞ্চলিক অখন্ডতা এবং সার্বভৌমত্বের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ আঘাত হলো অন্য দেশের সঙ্গে মিলে হাফতারকে দেওয়া ফ্রান্সের সামরিক সহায়তা। হাফতার বাহিনী একটি বৈধ সরকারের ওপর হামলা চালাচ্ছে। ফ্রান্স যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রায়ের সিদ্ধান্তে অবদান রাখতে চায় তাহলে তাদের উচিত হবে প্রথমে হাফতারকে সহায়তা দেওয়া বন্ধ করা।এর আগে সিরিয়ায় তুরস্কের অভিযান সময় এরদোয়ান ম্যাক্রোঁকে ব্রেইন ডেড বলে মন্তব্য করেছিলেন।
গাদ্দাফির পতনের পর থেকেই সহিংসতা আর বিভক্তিতে জর্জরিত হয়ে আছে লিবিয়া। গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে দেশটিতে সক্রিয় রয়েছে দুটি সরকার। এর মধ্যে রাজধানী ত্রিপোলি থেকে পরিচালিত জিএনএ সরকারকে সমর্থন দিয়েছে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বড় অংশ। তুরস্কের সমর্থনও এই সরকারের প্রতি। আর দেশটির পূর্বাঞ্চল থেকে পরিচালিত জেনারেল খলিফা হাফতারের নেতৃত্বাধীন অপর সরকারটিকে সমর্থন দিচ্ছে মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, সৌদি আরব,ও ফ্রান্স।
তুরস্ক ২০১৯ সালে জিএনএ সরকারের সাথে একটি সামরিক চুক্তি করে এবং জানুয়ারি মাসে দেশটিতে সৈন্য মোতায়েন করে। গত মাসে জিএনএ বাহিনী ত্রিপোলিসহ দেশের বিস্তীর্ন অঞ্চলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়। এর পেছনে মূল কারণ ছিল তুরস্কের সহযোগিতা। এর সাথে এ অঞ্চলে তুরস্কের সামরিক প্রভাব বিস্তারের উচ্চাকাঙ্খা রয়েছে।
তুরস্ক ও লিবিয়ার মধ্যে প্রতিরক্ষা চুক্তির পর এখন লিবিয়াতে সামরিক ও নৌঘাটি স্থাপনের উদ্যেগ নিয়েছে তুরস্ক। অপরদিকে রাশিয়াও সিরিয়ার মতো লিবিয়াতে সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখতে চায়। তুরস্কের সামরিক উপস্থিতির ব্যাপারে ন্যাটোর নীরব সমর্থন রয়েছে। ন্যাটোর সদস্য দেশ হয়েও ফ্রান্স তুরস্কের এই অবস্থানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়া সিরিয়া এবং পূর্ব ভূমধ্যমাগরীয় এলাকায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানসহ বেশ কয়েকটি ইস্যুতে সম্প্রতি প্যারিস ও আঙ্কারার সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। ভূমধ্যসাগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গত বছরের জুনে সাইপ্রাসের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে তুরস্ক। সেখানে সাইপ্রাসের কাছে প্রাকৃতিক গ্যাসের একটি বিশাল মজুদ আবিস্কৃত হওয়ার পরে সেই গ্যাস উত্তোলনে পাইপলাইন স্থাপণে চুক্তি করে গ্রীস , মিশর, দক্ষিণ সাইপ্রাস ও ইসরায়েল। কিন্তু ওই এলাকার অন্যতম অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও তুরস্ক ও লিবিয়াকে চুক্তিতে অর্ন্তভূক্ত করা হয়নি।
আবিষ্কৃত সম্পদের সুষ্ঠু ও নায্য বিতরণ করার জন্য তুরস্ক ওই দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু তাতে কোনো সাড়া না পাওয়ায় তুরস্ক তাদের খনন কার্যক্রম লিবিয়ার দিকে সম্্রসারণ করে। ফলে মিশর, গ্রীস , দক্ষিণ সাইপ্রাস ও ইসরায়েলের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
লিবিয়াতে ফ্রান্সের চেয়েও রাশিয়ার ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে চ্যালেঞ্জ করে ক্রিমিয়া দখল এবং সিরিয়ায় সামরিক ঘাঁটি তৈরির পর লিবিয়ায়তে শক্ত আসন গড়তে চাচ্ছে। তুরস্কও একই পথ অনুসরণ করেছে। লিবিয়ায় জিএনএ সরকারের সমর্থনে তুরস্ক ভূমধ্যসাগরে মেরিটাইম সীমানা বদলে দিয়েছে। তুরস্ক ও রাশিয়া ইউরোপের দক্ষিণাংশে নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করেছে। যেখানে ফ্রান্সের ভূমিকা রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে
ফ্রান্স এখন পদে পদে তুরস্ককে বাধা দিচ্ছে। এমনকি কুর্দি বিদ্রোহীদের সমর্থন দিচ্ছে ফ্রান্স। ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের আধিপত্য ঠেকাতে ফ্রান্স তার একমাত্র বিমানবাহী রণতরী চার্লস দ্য গলকে ভূমধ্যসাগরে মোতায়েন করে রেখেছে।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে