আরব বসন্তের কথা মনে আছে? ২০১০-১১ সালের সেই ঝড়ো হাওয়া শুধু দু'-একটি দেশের শাসকবদল ঘটিয়েই শেষ হয়ে গছে, এমন ভাবনা অনেকে ভাবলেও ভাবনাটি সর্বাংশে সঠিক নয়। বরং বলা চলে, এ 'বিপ্লবের' প্রভাব, তা ইতিবাচক হোক কিংবা নেতিবাচক, তছনছ করে দিয়েছে গোটা মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতাকে। মধ্যপ্রাচ্যের আভ্যন্তরিন রাজনীতি ও বিভিন্ন দেশের মধ্যে পারস্পরিক সর্ম্পক এখন নির্ধারন হচ্ছে আরব বসন্তে কার কী ভুমিকা ছিলো তার ভিত্তিতে।
তিউনিসিয়া ও মিশরে ক্ষমতাসীনদের পতনের পরপরই সেখানে জন্ম হয়েছে তিনটি অক্ষের। এর একটির নেতৃত্বে রয়েছে সউদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমীরাত। এ অক্ষটি পুরোপুরি বিপ্লববিরোধী বা প্রতিবিপ্লবী। দ্বিতীয় অক্ষটি ইসলামী-সংস্কারপন্থী। এদের সমর্থন বিপ্লবের প্রতি এবং ইসলামী ব্রাদারহুড ও সমমনা সংগঠনগুলোর প্রতি। এ অক্ষের নেতৃত্বে আছে তুরস্ক ও কাতার। তৃতীয় অক্ষটি প্রতিরোধপন্থী। আমেরিকা ও ইসরাইলকে প্রতিরোধ করাই এদের ধ্যানজ্ঞান। এ অক্ষে আছে ইরান, সিরিয়া ও হেজবুল্লাহ।
রাশিয়ার মতোই বিপ্লববিরোধী বা প্রতিবিপ্লবী অক্ষটি আরব গণজাগরণকে নিজেদের জন্য হুমকি হিসেবেই দেখে। কারণ, এ গণজাগরণ বিশেষভাবে রাজনৈতিক ইসলামেরই প্রতিনিধিত্ব করে। পক্ষান্তরে ইসলামী-সংস্কারপন্থী অক্ষটি আরব গণজাগরণের সমর্থক এবং তারা আরব দুনিয়ায় রাজনৈতিক ইসলামের বিজয়ের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে আরব বসন্তের ফলে সউদি আরবের সুবিধাভোগী শ্রেণীর গায়ে ধাক্কা লাগায় ইরান এ গণজাগরণকে সহর্ষ অভিনন্দন জানায়।
আরব দেশগুলোর এ অবস্থানে সামান্য ব্যতিক্রম এনে দিয়েছে লিবিয়া ও সিরিয়ার সামরিক সংঘাত। প্রতিরোধপন্থী অক্ষটি যেখানে স্থিতাবস্থার পক্ষে, রিয়াদ-আবু ধাবী অক্ষ সেখানে আংকারা-দোহা অক্ষের সাথে মিলে লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফীকে উৎখাতে সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের বিষয়ে এক অবস্থানে আসতে ব্যর্থ হয়েছে তারা। এ ক্ষেত্রে সউদি আরবের একটি বড় ইচ্ছা নিয়ামকরূপে কাজ করেছে। তা হলো, এ অঞ্চলে ইরানের প্রভাব খর্ব করা।
আসল ব্যাপার হলো, এসব অক্ষ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাজনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ থেকে, ধর্মীয় কারণে নয়। যে শিয়া-সুন্নি বিরোধ মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক বিভাজনকে চিহ্নিত করে, তা কিন্তু এখানে কাজ করেনি। সুন্নী মতবাদকে সুরক্ষা দেয়ার কোনো ইচ্ছা রিয়াদ-আবু ধাবী অক্ষের ছিল, এমনটা মোটেও নয়।
রিয়াদ-আবু ধাবী অক্ষের নৈকট্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার সাথে যে ইসরাইলের আরও কাছাকাছি হও, ইরানকে ঠেকাও আর মুসলিম ব্রাদারহুডকে কখনওই বিশ্বাস করো না। ইরানকে নিয়ে আমিরাতের চাইতে বেশি দুশ্চিন্তায় ভোগে সউদি আরব আর মুসলিম ব্রাদারহুড নিয়ে সউদি আরবের চাইতে বেশি উদ্বিগ্ন আমীরাত।
২০১৩ সালের জুলাই মাসে এক সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যূত হন মিশরের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি। মুসলিম ব্রাদারহুডের এ নেতার পতনকে নিজেদের বিরাট বিজয় অনুভব করে সউদি আরব ও আমীরাত। মিশরে এ প্রতিবিপ্লবের হোতা ছিলেন সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি। ক্ষমতায় বসেই তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের স্টিম রোলার চালাতে শুরু করেন। এ কাজে তাকে ব্যাপক সমর্থন দেয় সউদি আরব ও আমীরাত।
মজার ব্যাপার হলো, সউদি আরবের এসব কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে তার নীতিগত অস্পষ্টতাই প্রকট হয়ে উঠেছে। আমরা দেখি, সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপ সরকারপন্থী শিবিরকে রক্ষা করেছে এবং প্রেসিডেন্ট আসাদকে উৎখাতের উদ্যোগকে প্রায়-পন্ড করে দিয়েছে। সত্যি বলতে কী, সিরিয়ায় সউদি আরবের পরাজয় চূড়ান্ত হয়ে যায় ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসেই, যখন তাদের মদদপুষ্ট জৈশ আল ইসলাম বা আর্মি অব ইসলামের যোদ্ধারা গৌতার যুদ্ধে হেরে গিয়ে সরকারি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
ইসলামপন্থার প্রতি সউদি আরবের সহানুভূতির অস্পষ্টতা লক্ষ্য করা যায় একটি সালাফিস্ট গোষ্ঠীর প্রতি তাদের সমর্থন থেকেও। পরিবর্তনকামী ও সংস্কারবাদী চরিত্রের কারণে মুসলিম ব্রাদারহুডকে ঘৃণা করা হলেও বিস্ময়করভাবে মিশর ও সিরিয়ায় কয়েকটি জাতীয় সালাফিস্ট গ্রæপের কাজ করার অনুমতি রয়েছে।
পূর্বাঞ্চলীয় গৌতার যুদ্ধে হেরে যাওয়ার আট মাস পর সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে আবার দূতাবাস চালু করে সংযুক্ত আরব আমীরাত। এবার তারা সিরিয়ায় কর্তৃত্ববাদী শাসন ও স্থিতিশীলতাকে অগ্রাধিকার দিতে থাকে। তবে তাদের মিত্র সউদি আরব এখনও দ্বিধায় ভুগছে। তারা ইরানের মদদপুষ্ট সিরিয়ান শাসককে সমর্থন দিতে রাজি নয়।
রিয়াদ-আবু ধাবী অক্ষটি হালে লিবিয়ায়ও সমস্যায় পড়ে গেছে। আমীরাত, মিশর এবং কিছু মাত্রায় সউদি আরব সেখানে সমর্থন দেয় যুদ্ধবাজ নেতা খলিফা হাফতারকে, যিনি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ত্রিপলির ফায়েজ আল-সারাজের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্যের সরকারকে উৎখাতে সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি এ সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ফিরে আসছে স্থিতিশীলতা। এটা ত্রিপলিতে রিয়াদ-আবু ধাবী অক্ষের জন্য সুস্পষ্ট পরাজয়। কেননা, তুরস্ক ত্রিপলির ফায়েজ আল-সারাজের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের কড়া সমর্থক।
কৌতূহলোদ্দীপক হলো, সউদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমীরাত একই অক্ষভূক্ত হলেও এবং সউদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও আমীরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদের মধ্যে গলায় গলায় দোস্তি থাকলেও দুই দেশ এখন আর এক অবস্থানে থাকতে চাচ্ছে না বলেই মনে হচ্ছে।
সংযুক্ত আরব আমীরাত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তার অগ্রাধিকারগুলো পুনর্বিবেচনা করে দেখছে বলেই মনে হয়। তবে এ ক্ষেত্রেও পরস্পরবিরোধিতা চোখে পড়ার মতো। যেমন, কোথাও-কোথাও তারা গণতন্ত্রায়ন ও রাজনৈতিক ইসলামের বিরুদ্ধে গিয়ে কর্তৃত্ব ও স্থিতাবস্থাকে মদদ দিচ্ছে। এ পটভূমিতে তারা কখনও সাময়িককালের জন্য হলেও ইরানের পক্ষ নিচ্ছে। হালে দেশটি একটি মেরিটাইম নেটওয়ার্ক বা সমুদ্র যোগাযোগব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে, যা কিনা ইয়েমেন ও সোমালিল্যান্ডে বিচ্ছিন্নতাবাদকে উস্কে দিতে পারে। এমন আশঙ্কা সত্ত্বেও আমিরাত অনমনীয়।
ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সউদি আরবের নেতৃত্বে যে মহাজোট লড়াই করছে, তা-ও ডুবতে বসেছে। রাজধানী সানা এবং দেশের বেশিরভাগ এলাকা এখন হুতি বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে। দীর্ঘ পাঁচ বছর লড়াইয়ের পর রাজনৈতিক ও সামরিক - উভয়ভাবে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে হুতি বিদ্রোহীরা। সউদি আরব ও প্রেসিডেন্ট মনসুর হাদীর অনুগত বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় যে আসন্ন, এ নিয়ে কারও মনে কোনো সন্দেহ নেই।
ইয়েমেনে আমীরাত পক্ষ নিয়েছে দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় বিদ্রোহীদের। তাদের কথা, মনসুর হাদির সরকারের পক্ষপুটে আশ্রয় নিয়েছে মুসলিম ব্রাদারহুডপন্থী দল আল ইসলাহ পার্টি। কাজেই আমীরাত ইয়েমেনে মনসুর হাদির সরকারের পক্ষে থাকতে পারে না। দেশটি এখন সমর্থন দিচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের। এই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দখলে রয়েছে এডেন। গত এপ্রিলে ওরা দক্ষিণাঞ্চলের সব প্রদেশের স্বায়ত্তশাসন ঘোষণা করেছে। আমীরাতের ওদের পক্ষ নেয়াটা প্রকারন্তরে সউদি আরবের বিপক্ষে অবস্থান নেয়ারই শামিল।
বাস্তবতা হচ্ছে ইয়েমেনের ওপর এখন সউদি আরবের কোনোই নিয়ন্ত্রণ নেই। দেশটির উত্তরাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে হুতিরা আর দক্ষিণাঞ্চল বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। কাজেই বলতে হয়, আরব বিশ্বে সউদি-আমিরাতী গাঁটছড়ার ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল নয়। এ জোটের একমাত্র ''বিজয়'' বলতে যদি কিছুকে বিবেচনায় নিতে হয়, তাহলে শুধু মিশরে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে উৎখাতের কথাই বলা যায়। আদর্শিক দিক বিচারে বললে বলতে হয়, আরব জনগণ অস্থিতিশীলতা যেমন কামনা করে না, তেমনি স্বৈরাচারী ব্যবস্থাও তাদের কাম্য নয়। আলজেরিয়া ও লেবাননের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সেটাই প্রমান করেছে।
সবচাইতে বড় কথা হলো, সউদি পররাষ্ট্রনীতির ফল হয়েছে দেশটির জন্য বিপর্যয়কর : সউদি আরব ইরাক ছেড়েছে, সিরিয়ায় পরাজিত হয়েছে, লেবানন থেকে পিছু হটে আসতে হয়েছে, ইয়েমেনে ছত্রভঙ্গ স্বাদ গ্রহণ করতে হয়েছে আর লিবিয়ায় তার কৌশল সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দেখেশুনে পর্যবেক্ষকরা বলতে শুরু করেছেন, সউদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান স্ট্র্যাটেজিস্ট বা রণকৌশল-প্রণেতার চাইতে হয়তো উৎসব আয়োজনকারী হিসেবেই বেশি ভালো করবেন।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে