আপনাদের সাথে আছি আমি সুরভি দিবা। যুক্তরাষ্ট্রের আগামি নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প অনেক পিছিয়ে পড়ছেন। ডেমোক্র্যাট প্রার্থী বাইডেন এগিয়ে আছেন। অনেকে বলছেন ট্রাম্পের শোচনীয় পরাজয় অনেকটা নিশ্চিত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বড় ধরনের প্রভাব পড়ে আর্ন্তজাতিক রাজনীতিতে। ট্রাম্প যদি হেরে যান এর প্রভাব উপসাগরীয় দেশগুলোর শাসকদের ওপর কতটা পড়বে তা বিশ্লেষন করছে মিডল ইস্ট আই। এতে বলা হয়েছে আরব শাসকরা শঙ্কিত। কেন এই শঙ্কা আসুন জেনে নেই
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বাকি আর মাত্র তিন মাস। এ নির্বাচনে জনগণ সিদ্ধান্ত নেবেন তারা ট্রাম্পকে পুনরায় বিজয়ী করবেন, নাকি এক মেয়াদ শেষেই তাকে হোয়াইট হাউস থেকে বের করে দেবেন। তিনি পরাজিত হলে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কয়েকজন প্রেসিডেন্টের একজন হবেন যারা তৃতীয়বার আর গদিতে বসার সুযোগ পাননি। ট্রাম্পের পরাজয় হলে বিজয়ী হবেন ডেমোক্রেটিক নেতা জো বাইডেন।
এখন থেকে নভেম্বরের মধ্যে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। তবে ট্রাম্প এক কঠিন লড়াইয়ের মধ্যে পড়েছেন। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিধ্বস্ত জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনীতির প্রভাবের পাশাপাশি কৃষষ্ণাঙ্গদের ওপর পুলিশি বর্বরতার ঘটনায় নজিরবিহীন আন্দোলন তাকে গভীর সংকটে ফেলেছে। সাম্প্রতিক জনমত জরিপে দেখা গেছে, বাইডেন ট্রাম্পের চেয়ে ১২-১৩ শতাংশ পয়েন্ট এগিয়ে রয়েছেন। ফলে বাইডেনের জয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল।
১০ জুন থেকে ১৬ জুন পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, নিবন্ধিত ভোটারদের ৪৮ শতাংশ বলেছেন, তারা নির্বাচনে বাইডেনকে সমর্থন দেবেন; আর ৩৫ শতাংশ বলেছেন, তারা ট্রাম্পকে সমর্থন করবেন। এই জরিপে দেখা যায়, গত কয়েক মাসের মধ্যে বাইডেন এবারই প্রথম সবচেয়ে বড় ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন।
এসব জরিপ ট্রাম্পের জন্য স্পষ্টতই এ এক বিপদসংকেত। জরিপের ফলে ট্রাম্পের সমর্থনের ভিতি টলে যাচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। নিজ দল রিপাবলিকানদের মধ্যেও ট্রাম্পের সমর্থন মার্চ থেকে জুনের মধ্যে ১৩ পয়েন্ট কমেছে। নিউইয়র্ক টাইমস ও সিয়েনা কলেজের করা সা¤প্রতিক জরিপের ফলাফল বলছে, ইলেকটোরাল কলেজ ভোটেও বিপর্যয় হতে পারে ট্রাম্পের। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই ইলেকটোরাল কলেজের ভোটের জোরে পপুলার ভোটে হেরেও প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ট্রাম্প। রাজনৈতিক পরিমন্ডলে নাটকীয় কিছু না ঘটলে এ নির্বাচনে বাইডেনের কাছে শোচনীয় পরাজয়ের শিকার হবেন ট্রাম্প।
ট্রাম্প উপসাগরীয় দেশগুলোর শাসকদের এক ধরনের বø্যাংক চেক দিয়ে রেখেছিলেন যে নিজেদের সুরক্ষার জন্য তারা যা খুশি তাই করতে পারেন। এজন্য মানবাধিকার বা গণতন্ত্রের তোয়াক্কা করার দরকার নেই। মনের দিক থেকে অহংকারী ট্রাম্প ঔদ্ধত্য, নির্মমতা, অযোগ্যতা, আত্মমগ্নতা, লোভ ও বর্ণবাদেও এক অদ্ভুত মিশেল। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিকে নজিরবিহীন মাত্রায় যেমন মেরুকরণ করেছেন। তেমনি আর্ন্তজাতিক সর্ম্পকের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে এনেছেন বড় ধরনের পরিবর্তন
ট্রাম্পের শাসনে আরব দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নতুন মাত্রায় উপনীত হয়েছে। তার ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরির’ আওতায় ইসরাইলকে কোনো বাধা ছাড়াই ফিলিস্তিনি ভ‚মি দখলের অধিকার দেওয়া হয়েছে। ইসরাইলকে সমর্থনের মাধ্যমে আরব শাসকেরা ইরানের মোকাবিলায় ওয়াশিংটন ও তেল আবিবের অব্যাহত সমর্থন পাচ্ছেন। উপসাগরীয় দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রিতেও এখন আর কোনো বাধা নেই। আরব মিত্রদের মানবাধিকার লংঘনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র চোখ বুজে থাকার নীতি গ্রহণ করেছে।
কংগ্রেসের তীব্র বাধার মুখেও সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে অস্ত্র বিক্রিতে ট্রাম্প প্রশাসন মরিয়া। ইয়েমেনে এই দুটো দেশ ২০১৫ সাল থেকে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করলেও তাদের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রি অব্যাহত রয়েছে।
তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগজির নির্মম হত্যার পরও ট্রাম্প প্রশাসনের নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। ট্রাম্প প্রকাশ্যেই বলেছেন যে এ হত্যার বিচারের জন্য চাপাচাপি করে তিনি সৌদির সঙ্গে লোভনীয় অস্ত্র বিক্রির চুক্তিকে বিপদে ফেলতে নারাজ। কংগ্রেস সৌদি প্রশাসকদের জবাবদিহির আওতায় আনার দাবি জানালেও তাতে সায় দেয়নি ট্রাম্প প্রশাসন।
তবে ট্রাম্পের পরাজয় হলে ডেমোক্রেটিক প্রশাসনের আওতায় এসব নীতিও বদলে যাবে। অনেক ডেমোক্র্যাট মনে করেন ট্রাম্প যেভাবে আরব স্বৈরশাসকদের, বিশেষ করে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে অব্যাহত সমর্থন যুগিয়ে চলছেন তা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের অনুকুল নয়। তারা মনে করছেন অন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা রক্ষা ছাড়াই একজন স্বৈরশাসক আরেকজনকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন।
উপসাগরীয় দেশগুলোর বড় মিত্র হলেন ট্রাম্প। ইরানকে মোকাবিলা কিংবা দেশের ভেতরে সংস্কারপন্থীদের দমনে ট্রাম্প তাদের সমর্থন জুগিয়েছেন। কিন্তু এসব শাসকেরা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন যে তারা ট্রাম্পের সমর্থন পেলেও অর্ধেকের বেশি আমেরিকানের কাছে তারা অনেকটা অচ্ছুতে পরিণত হয়েছেন।
নির্বাচনে ডেমোক্রেটরা বড় ধরনের জয় পেলে উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস ঘটবে। এসব শাসকদের বিরুদ্ধে বাইডেন প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ নিলে আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যাবে। অথচ এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের কোনো লোকসান গুনতে হবে না। ট্রাম্পের পরাজয়ে বড় ভ‚মিকা রাখবে বিভিন্ন বর্ণ বা জাতি, ধর্মীয় গোষ্ঠী ও কর্মজীবী শ্রেণি। তারা মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
আরব শাসকরা দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের যে পাহাড় গড়েছেন তার প্রতি বৈরিতা দেখাবে এসব শ্রমজীবী ভোটাররা। মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রতি তাদের অবিচল আস্থা। বাইডেন প্রশাসনের ওপর তাদেও ব্যাপক প্রভাব থাকবে।
যেমন বামপন্থী ডেমোক্রটিক নেতা বার্নি স্যান্ডার্স মনোনয়ন না পেলেও দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়। দলের একটি বিশাল অংশের কাছে তার আদর্শ জনপ্রিয়। স্যান্ডার্স সৌদি শাসকদের একজন কড়া সমালোচক। এটা অনেক ডেমোক্র্যাট নেতাকর্মীর অবস্থানের প্রতিফলন।
বিকল্প জ্বালানি প্রযুক্তির দ্রæত প্রসার ও উত্তর আমেরিকায় প্রভ‚ত তেল খনির আবিষ্কারের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে উপসাগরীয় দেশগুলোর ক্ষয় অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। বিশ্বে উপসাগরীয় দেশগুলোর প্রভাব ক্রমক্ষয়িষষ্ণু।
করোনা ভাইরাসের কারণে তেলের দামের ধপাস পতন এই প্রবণতাকে আরো গতিশীল করেছে। এ পরিস্থিতিতে আরব শাসকদের টিকে থাকার জন্য বাইরের সমর্থন জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে আমেরিকার জনগণ এখন আর তাদের সমর্থন দিতে আগ্রহী নয়। কারণ এতে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বেহুদা যুদ্ধের আশংকা রয়েছে।
ভোটে ট্রাম্প পরাজিত আর বাইডেন জয়ী হলে একজন ব্যর্থ প্রেসিডেন্টের চোখ দিয়ে জনগণ আন্তর্জাতিক সর্ম্পককে দেখতে চাইবেন না। যুক্তরাষ্ট্রের বদলে চীন ও রাশিয়া এসব শাসকদের রক্ষাকবচ হবেন বলেও মনে হয় না। ফলে উপসাগরীয় শাসকরা পড়বেন অস্তিত্ব সংকটে।
আরব শাসকদের টিকে থাকার জন্য তাদের দরকার পড়বে আঞ্চলিক শান্তি, গণতান্ত্রিক বিকাশ, সমন্বয় ও উন্নয়ন। আর এসব করতে গেলে দরকার হবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার আমূল পরিবর্তন। ডেমোক্র্যাটরা আরব বসন্তের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন। কিন্তু আরব শাসকরা রাজনৈতিক পরিবর্তনের সে সুযোগ কঠোরভাবে দমন করেছেন। আরব বসন্ত ব্যর্থ হয়ে পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে আগামি দিনে মধ্যপ্রাচ্য রাজনৈতিক পরিবর্তন আরো রক্তাক্ত হয়ে উঠতে পারে। বিকল্প হিসাবে টিকে থাকার জন্য আরব শাসকরা প্রকাশ্যে ইসরাইলের সর্ম্পক বাড়ানোর চেষ্টা করবেন।
অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে মৌলিক রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া আরব শাসকরা ইসরাইলের ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়বেন। ইসরাইলও এই সুযোগ নিতে চাইবে। আরব বিশ্বে অরাজক অবস্থা বিরাজ করলেই ইসরাইলের লাভ। ইসরাইল চাইবে এসব স্বৈরশাসকদের টিকিয়ে রাখতে।
ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ ইতিমধ্যেই গ্রহণ করেছেন আরব শাসকরা। তবে তাতেও জটিলতা আছে। ইসরাইল ফিলিস্তিনি ভূমি জবরদখল অব্যাহত রাখলে এই শাসকরা আরও বিপদে পড়বেন। আর আরব শাসকদের সমর্থনের বিনিময়ে ইসরাইল চাইবে তাদের সম্প্রসারণমূলক নীতি মেনে নেবেন এসব শাসকরা।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ট্রাম্পের ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল হয়ে আরব শাসকরা অনেক বেশি ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছেন। ট্রাম্প আর তার দল রিপাবলিকান পার্টি পরাজিত হলে তাদের ঝুঁকি আরও বাড়বে।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে