সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইসরাইলের মধ্যে দীর্ঘদিন থেকে যে গোপন অভিসার চলছিলো তা প্রকাশ্য এলো। ১৩ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইসরাইল সর্ম্পক স্বাভাবিক করতে যাচ্ছে। দুদেশ শান্তিচুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে পুরোমাত্রায় কূটনৈতিক সর্ম্পক স্থাপন করবে। এই ঘোষণার পর মধ্যপ্রাচ্যে এর নানামুখী প্রতিক্রিয়া হয়েছে।
ইসরাইল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ঘোষণা সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও দীর্ঘদিন থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইসরাইলের মধ্যে অপ্রকাশ্য কূটনৈতিক সর্ম্পক ছিলো। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদের মধ্যে এই চুক্তিকে এক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প 'ঐতিহাসিক মূহুর্ত' বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘বরফ যেহেতু গলেছে এখন আমি আশা করবো আরও অনেক আরব এবং মুসলিম দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতকে অনুসরণ করবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই ঘোষণা দেওয়ার পরপরই ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু হিব্রুতে টুইট করেন, ‘এক ঐতিহাসিক দিন।’
সামনের দিনগুলোতে ইসরাইল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিনিধি দল নানা বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে নিয়মিত মিলিত হবে । এর মধ্যে বিনিয়োগ, পর্যটন, দুই দেশের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট, নিরাপত্তা, টেলিযোগাযোগ, প্রযুক্তি, জ্বালানি, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, পরিবেশ, দুই দেশে পরস্পরের দূতাবাস স্থাপন থেকে কিছুই বাদ থাকছে না। দুটি বন্ধুপ্রতিম দেশের মধ্যে যত রকমের সম্পর্ক থাকার কথা, তেমন এক সম্পর্কের দিকেই যাচ্ছে দুই দেশ।
আরব আমিরাত বলছে, একটি আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে এই সম্পর্কের বিনিময়ে ইসরাইল নতুন করে পশ্চিম তীরের যেসব ফিলিস্তিনি এলাকা দখলের পরিকল্পনা করছিল, তা আপাতত স্থগিত রাখবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আনওয়ার গারগাশ বলেছেন, ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে তার দেশ সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। কারণ এর মাধ্যমে পশ্চিম তীরকে সংযুক্ত করার যে পরিকল্পনা নিয়ে ইসরাইল এগোচ্ছিল, সেই 'টাইম বোমা' থামিয়ে দেওয়া গেছে। ফিলিস্তিনের স্বার্থের দোহাই দিয়ে ইসরাইলের সাথে সর্ম্পক স্থাপন করলেও ইসরাইলের দিক থেকে এমন কোনো প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি। ইসরাইল বলছে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর দখলের পরিকল্পনা বাদ দেওয়া হয়নি। নেতানিয়াহু খুব স্পষ্ট করে বলেছেন, পরিকল্পনাটি শুধু স্থগিত রাখা হয়েছে মাত্র।
ফিলিস্তিনিদের স্বার্থে আরব আমিরাত ইসরাইলের সাথে সর্ম্পক স্বাভাবিক করছে এমন দাবি ফিলিস্তিনিদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা পায়নি। বরং এই উদ্যেগকে ফিলিস্তিনিদের পিঠে ছুরিকাঘাত হিসাবে উল্লেখ করেছে। ফিলিস্তিনিরা সংযুক্ত আরব আমিরাতের এই পদক্ষেপকে 'বিশ্বাসঘাতকতা' হিসেবে দেখছে। ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এর নিন্দা করে বলেছেন, ‘এটি জেরুজালেম, আল-আকসা এবং ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।
ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা হানান আশরাউই সমঝোতার নিন্দা করে বলেছেন, ইসরাইলের সঙ্গে আমিরাত তলে তলে যেসব গোপন লেনদেন আর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালাচ্ছিল, সেটা এবার প্রকাশ হয়ে গেল। তিনি আবুধাবির প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘নিজের বন্ধুর দ্বারা কেউ যেন এভাবে বিক্রি হয়ে না যান। এর প্রতিক্রিয়ায় সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ফিলিস্তিনি দূতকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস বলেছে, এই চুক্তি ফিলিস্তিনিদের স্বার্থের অনকূলে নয়। এতে ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকারকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। এক বিবৃতিতে সংগঠনটি বলেছে, ইসরায়েলের সঙ্গে এই চুক্তি ফিলিস্তিনি জনগণের পিঠে ষড়যন্ত্রমূলক ছুরিকাঘাত।
আরেকটি ফিলিস্তিনি সংগঠন পপুলার রেসিস্ট্যান্স কমিটি চুক্তিটিকে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছে। ইসলামিক জিহাদ মুভমেন্টের পক্ষ থেকে নতুন চুক্তিকে আত্মসমর্পণের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
ফিলিস্তিনিরা খুব কঠোর ভাষায় এই সমঝোতার নিন্দা জানিয়েছে ইরান। ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্তকে 'বিপজ্জনক' এবং 'বোকামি' হিসেবে আখ্যায়িত করেছে তেহরান। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে এই বিশ্বাসঘাতকতার জন্য আমিরাত কখনোই ক্ষমা পাবে না।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে বরাবরই সোচ্চার তুরস্ক। দেশটির প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়্যেব এরদোয়ান বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপ সহ্য করা যায় না। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করারও হুঁশিয়ারি দিয়েছে তুরস্ক। দেশটি বলছে, আমিরাতের এই ভন্ডামি ইতিহাস কখনও ক্ষমা করবে না।
ইসরাইলের মিত্র মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসি এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। ইসরাইলের আরেক মিত্র জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি বলেছেন, এই চুক্তির পর থমকে যাওয়া মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনা নতুন করে শুরু হতে পারে। সৌদি-আমিরাতের আরেক মিত্র বাহরাইন এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। এই চুক্তিতে ভূমিকা রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকেও ধন্যবাদ জানিয়েছে দেশটি। সৌদি-আমিরাতি বলয়ের আরেক দেশ ওমানও এই চুক্তির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। রিয়াদের পক্ষ থেকে প্রকাশ্য কোনো মন্তব্য করা হয়নি। তবে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত গনমাধ্যমে সর্ম্পক স্থাপনের প্রক্রিয়ার প্রশংসা করা হয়েছে।
এই সময়ে ইসরাইলের সাথে আরব আমিরাতের সর্ম্পক স্থাপনের এই ঘোষণাকে দেখা হচ্ছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাচনী রাজনীতির কৌশল হিসাবে। যাতে লাভবান হবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। আর ক্ষতিগ্রস্থ হবে ফিলিস্তিনিরা। কার্যত এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদে ইসরাইলি পরিকল্পনায় আরব দেশগুলোর পক্ষ থেকে অনুমোদন দেয়া হলো।
এক টেলিভিশন ভাষণে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু খুব স্পষ্ট করে বলেছেন, তিনি ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের কিছু অংশ দখলের পরিকল্পনা স্থগিত রাখলেও তা বাতিল করা হয়নি। ওই পরিকল্পনা এখনও ইসরায়েলের রয়েছে। অথচ সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্র দেখাতে চাইছিল যে, এই সমঝোতার ফলে ইসরাইলকে যেন এই কাজ থেকে বিরত রাখা যাবে।
অনেক বিশ্লেষক মরে করেন বলছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু, উভয়েই অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এই সমঝোতা থেকে কিছু ফায়দা তুলতে পারেন। এই কাজে এগিয়ে এসেছে আরব আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদ।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখন এটিকে তার পররাষ্ট্রনীতির এক বিশাল বিজয় হিসেবে দেখাতে চাইবেন। নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে তার ভাবমূর্তিকে চাঙ্গা করতে কথিত এই শান্তি চুক্তিকে ব্যবহারের চেষ্টা করবেন। অপরদিকে নেতানিয়াহু দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে যে বিপদের মধ্যে আছেন, সেখান থেকে মানুষের মনোযোগ অন্য দিকে সরানোর জন্য এটিকে কাজে লাগাতে পারবেন।
পশ্চিম তীরের বিরাট অংশ ইসরায়েলের দখলে নেওয়ার পরিকল্পনা নেতানিয়াহুর মাথা থেকেই এসেছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে যে রকম চাপের মুখে পড়তে হচ্ছিল ইসরাইলকে, তাতে কাজটা নেতানিয়াহুর জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল। এখন আরব আমিরাত এই অবস্থা থেকে উদ্ধারে এগিয়ে এসেছে। এখন এই পরিকল্পনা বাতিল না করে ধীরে ধীরে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে ইসরাইল।
ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুকে উদ্ধারে আরব আমিরাতের এই প্রক্রিয়ার সাথে সৌদি আরবের সমর্থন আছে বলে মনে করা হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে সৌদি আরবের সাথে ইসরাইলের ঘনিষ্ঠতার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নের ধারাবাহিকতায় সৌদি আকাশসীমা ব্যবহার করে ইসরাইল-ভারতের সরাসরি বিমান চলাচলের অনুমতি দেয় সৌদি কর্তৃপক্ষ। এর মধ্য দিয়ে ইসরায়েলে ফ্লাইট পরিচালনায় নিজেদের আকাশসীমা ব্যবহারে কয়েক দশকের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় রিয়াদ।
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এর আগে প্রকাশ্যেই মন্তব্য করেছেন, ইসরাইলের অস্তিত্বের অধিকার রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে কার্যত একটি ইহুদিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইলকে মেনে নিয়েছে রিয়াদ। এখন মিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাতের ধারাবাহিকতায় সৌদি আরবও শিগগিরই ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
ইতোমধ্যে ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাতের চুক্তিকে স্বাগত জানানোয় সৌদি আরবের মিত্রদেশগুলোকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। টুইটারে দেওয়া এক পোস্টে নেতানিয়াহু বলেন, ইসরায়েল ও আমিরাতের মধ্যে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তিতে সমর্থন দেওয়ায় আমি মিসরের প্রেসিডেন্ট আল সিসি এবং ওমান ও বাহরাইনের সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। এই চুক্তি ‘শান্তির পরিসরকে’ আরও ব্যাপক করে তুলেছে। পুরো অঞ্চলের জন্যই এটি ইতিবাচক।
ইসরাইলের সঙ্গে এর আগে কেবল মাত্র দুটি আরব রাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক হয়েছে। প্রথমটি মিসরের সঙ্গে ১৯৭৯ সালে। এই চুক্তি করার পরিণামে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে প্রাণ দিতে হয়েছে। দ্বিতীয়টি জর্ডানের সঙ্গে ১৯৯৪ সালে।
ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাতের চুক্তির পর যুক্তরাষ্ট্র চাইছে অন্য মুসলিম ও আরব দেশগুলোও যেন আমিরাতকে অনুসরণ করে। হোয়াইট হাউসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, এমন চুক্তি সম্পাদনের বিষয়ে মধ্যপ্রাচ্যের আরও অনেক দেশের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে ওয়াশিংটন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, ট্রাম্পের সিনিয়র উপদেষ্টা ও তার ইহুদি ধর্মাবলম্বী জামাতা জ্যারেড কুশনার এবং মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দূত আভি বেরকোউইটজ আরব দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছেন। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন আমিরাত ও সৌদি আরবকে ব্যবহার করে ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সর্ম্পক স্থাপনের জন্য এখন অনেক মুসলিম দেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হবে।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে