যুদ্ধ চলছে ইরাকে সিরিয়ায় ইয়েমেনে লিবিয়ায়। কোনো-কোনো দেশ যুদ্ধে উস্কানি দিচ্ছে, কোনো-কোনো দেশ আবার নিজেদের মতো করে চেষ্টা করছে শান্তি স্থাপনের। সর্বশেষ খবর হলো, লিবিয়ার জাতিসংঘ-সমর্থিত জাতীয় চুক্তি সরকার বা জিএনএ এবং জঙ্গি নেতা খলিফা হাফতারের বাহিনী-ভয় পক্ষই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা এবং দেশটিতে একটি নতুন নির্বাচনের অঙ্গীকার করেছে। ২১ আগস্ট পৃথক বিবৃতিতে উভয় পক্ষ এ ঘোষণা দেয়। কেন এই উভয় পক্ষের যুদ্ধ বিরতির ঘোষণা। আর এর পেছনে কার কী ভুমিকা তা নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করবো।
ত্রিপলি সরকারের বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন সরকার প্রধান ফায়েজ আল-সারাজ আর অপর পক্ষের বিবৃতিতে স্বাক্ষর দেন বিদ্রোহী সরকারের মদদপুষ্ট পার্লামেন্টের স্পিকার আগুইলা সালেহ। এ ঘোষণাকে তাৎক্ষণিক স্বাগত জানিয়েছে জাতিসংঘ। লিবিয়া যুদ্ধে নানা পক্ষকে সমর্থন দিচ্ছে তুরস্ক, মিশর, রাশিয়া ও ফ্রান্স। এসব দেশও যুদ্ধ বিরতিকে স্বাগত জানিয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে একে শান্তির সুবাতাস মনে হলেও এখানেও একটা 'কিন্তু' রয়ে গেছে। তা হলো, সালেহর বিবৃতিটি কি হাফতার ও তার লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির অনুমোদিত, নাকি সালেহ নিজ দায়িত্বেই এ কাজ করে বসেছেন!
সালেহকে নিয়ে এমন সন্দেহের কারণ হচ্ছে, তিনি হাফতারের তুলনায় ক্রমেই প্রভাবশালী হয়ে উঠছিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন, উভয় পক্ষের পাঁচ জন করে নিয়ে গঠিত যৌথ কমিশনের বৈঠক আবারও অনুষ্ঠিত হোক। অর্থাৎ আলোচনার টেবিলে বসে সমস্যার সমাধানই তাঁর কাম্য।
একই পন্থার পক্ষ সমর্থন করেছেন মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল-সিসিও। দু'পক্ষের বিবৃতিকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক সমাধান অর্জনের পথে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সবকিছু যদিও এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়, তবুও বলা যায়, দিগন্তে শান্তির একটি ক্ষীণ আলোকরেখা জেগে উঠেছে। সেটি কতটা পূর্ণ তেজে জ্বলে উঠতে পারবে, তা এখনই বলা নয়।
জাতসংঘ সমর্থিত জিএনএ সরকার, তুরস্ক ও কাতারের মধ্যে চলতি সপ্তাহের গোড়ার দিকে এক ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা হয়। সমঝোতা অনুসারে লিবিয়ায় সামরিক প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতার লক্ষ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমন্বয় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হবে।
তুর্কী মিডিয়া লিখেছে, নতুন প্রটোকলের মাধ্যমে তুরস্কের সেনাবাহিনী ত্রিপলি সরকারের জন্য একটি নতুন নিয়মিত বাহিনী গঠন করবে এবং তাদের প্রশিক্ষণ দেবে। আশা করা যায়, এর ফলে পশ্চিমা কিছু দেশের মদদ পেয়ে উচ্ছৃঙ্খল মিলিশিয়ারা দেশটিতে যে নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টি করেছে, ধীরে ধীরে তার অবসান ঘটবে।
অতীত অভিজ্ঞতা থেকে তুরস্ক ও কাতার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ১৯৯৩ সালে আজারবাইজানের ব্যাপারেও ঠিক একই রকম পদক্ষেপ নিয়েছিল তুরস্ক। আজারবাইজান তখন সবে সোভিয়েত ইউনিয়নের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা পেয়েছে। তখনও তাদের নিয়মিত ও আধুনিক সেনাবাহিনী বলতে কিছু নেই। এমন তালগোল পাকানো অবস্থায় দেশটির সেনাবাহিনী গঠন ও প্রশিক্ষণে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে গিয়েছিল তুরস্ক।
সেই সময়ের প্রায় তিন দশকের মাথায় আজ তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে লিবিয়ায়। ত্রিপক্ষীয় সমঝোতাটি সম্বন্ধে অবহিত একটি সূত্র মিডিয়াকে জানান, উদ্যোগটিকে নতুন মনে হলেও আসলে তা ঠিক নতুন নয়। এ মুহূর্তেও লিবিয়ার কয়েক ডজন সৈন্য তুরস্কে প্রশিক্ষণে আছেন।
লিবিয়ার সরকারী সৈন্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান নতুন না-হলেও মিসরাতায় তুরস্ক, কাতার ও ত্রিপলি সরকারের যৌথ উদ্যোগে ত্রিপক্ষীয় সামরিক সমন্বয় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা তো নতুন বটেই। আরো নতুন হলো, বেনগাজিভিত্তিক জঙ্গি নেতা খলিফা হাফতারের লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি-র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ত্রিপলি সরকারকে সহায়তা দানে কাতারের আনুষ্ঠানিকভাবে এগিয়ে আসা।
অবশ্য আগে থেকেই গুজব ছিল যে, তুরস্কের অনেক বৈদেশিক উদ্যোগেই কাতারের অর্থসাহায্য আছে। যেমন, বলা হয় যে, সিরিয়ার বিদ্রোহীদের তুরস্ক সামরিক প্রশিক্ষণ দেয় আর কাতার দেয় নগদ অর্থ। তবে যারা যা-ই বলুক, কাতার এ ব্যাপারে কখনোই উচ্চবাচ্য করে না।
যাহোক, লিবিয়ায় ত্রিদেশীয় উদ্যোগ গ্রহণের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর তুরস্ক ও আরব মিডিয়া জগতে নতুন জল্পনাকল্পনা শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে, নতুন সমঝোতা অনুযায়ী লিবিয়ার মিসতারায় তুরস্ক একটি নৌ-ঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ পাবে। অবশ্য এ গুঞ্জনটিও নতুন নয়, আগেও একাধিকবার এ রকম খবর ছাপা হয়েছে।
খবরগুলো একেবারে ভিত্তিহীন ছিল, এমনও নয়। কারণ, চলতি বছরের গোড়ার দিকে তুরস্কের কর্মকর্তারা স্বীকার করেন যে, লিবিয়ার কিছু ঘাঁটি ব্যবহার করতে চায় তুরস্ক। এ নিয়ে ত্রিপলি সরকারের সাথে আলোচনা হচ্ছে। এসব ঘাঁটির মধ্যে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থিত আল-ওয়াতিয়া বিমানঘাঁটিও রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে দু'দেশ যদি ইতিমধ্যে একমত হয়ে যায়, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কেননা এর আগে
গত বছরের নভেম্বর মাসে উভয় দেশ এক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। এতে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুরস্ক ও লিবিয়ার সমুদ্রসীমা চিহ্নিত করা হয়। ওই অঞ্চলে গ্রীক ও সাইপ্রিয়টদের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকাজকে আর বেশি বাড়তে না-দেয়াই এ সমঝোতার লক্ষ্য। ত্রিপলি সরকারের সাথে সামরিক সহযোগিতা চুক্তি করেছে তুরস্ক। ২০১৯ সালের এপ্রিলে জঙ্গি নেতা হাফতার যখন রাজধানী দখল করতে আসেন, তুরস্ক তখন ওই চুক্তিবলেই ত্রিপলি সরকারের সাহায্যে এগিয়ে যায়। পাঠায় ড্রোন, সাঁজোয়া যান, মিলিটারি অফিসার।
তুরস্কের সহায়তায় সেবার শুধু রাজধানী রক্ষা পায় তা-ই নয়, হাফতারের বাহিনীর বিরুদ্ধে ত্রিপলির সরকারী বাহিনী আরো বহু গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জন করে। এর মধ্যে বিদ্রোহীদের হাত থেকে আল-ওয়াতিয়া বিমানঘাঁটি পুনর্দখল অন্যতম।
প্রতিবেশী মিশর আবার জঙ্গি নেতা হাফতারের পক্ষে। গত জুন মাসে তারা ঘোষণা দেয় যে, লিবিয়ার সির্তে ও জুফরা নগর-দু'টি হলো রেড লাইন। ত্রিপলি সরকার যদি এ দু' নগরী দখলের চেষ্টা করে তাহলে মিশরও 'ব্যবস্থা' নেবে। উভয় পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নেয়ার মধ্যে নতুন এই যুদ্ধ বিরতির ঘোষণা আসলো।
নতুন এই যুদ্ধ বিরতির এই প্রস্তাব অনুসারে আগামি বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহার ও আগামি বছরের মার্চে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে এই যুদ্ধ বিরতিতে হাফতারের কোনো ভুমিকার কথা উল্লেখ করা হয়নি। এছাড়া আগামিতে নির্বাচন হলে জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের লোকজন বিজয়ী হবে। কারন এই দলগুলোর আছে সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি। এছাড়া লিবিয়ার জনসংখ্যার বেশি বসবাস ত্রিপোলি সরকারের নিয়ন্ত্রিত এলাকায়। আসুন জেনে নেই নতুন যুদ্ধ বিরতির আরো কিছু দিক
কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সির্তে ও জুফরা শহর-দু'টিকে অসামরিকীকরণের প্রস্তাব দেয় জার্মানি। তুরস্ক বলে, হাফতারের বাহিনী যদি তিনটি শর্ত মেনে নেয় তাহলে জার্মান প্রস্তাবটি মেনে নেয়া যেতে পারে। শর্তগুলো হলো, এক. ভবিষ্যৎ-লিবিয়ার কোনো কিছুতেই হাফতার থাকতে পারবেন না, দুই. রাশিয়ার বেসরকারী ওয়াগনার প্যারামিলিটারি গ্রæপ এবং অন্যসকল ভাড়াটে সৈন্যকে লিবিয়া ছাড়তে হবে এবং তিন. লিবিয়ার সির্তে ও জুফরা নগর-দু'টি প্রহরার দায়িত্বে থাকবে জিএনএ বাহিনী।
এদিকে জার্মান প্রস্তাব মেনে নিতে এবং আলোচনার টেবিলে আসতে হাফতারকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে চলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাদের এবং ইউরোপিয়ানদের চাপের মুখে কিছুটা নতি স্বীকার করেন তিনি। এর অংশ হিসাবে নিজ নিয়ন্ত্রিত এলাকায় তেল উৎপাদনের ওপর মাসখানের আগে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন হাফতার।
শুধু হাফতার নয় মিশরের আল সিসির ওপর চাপ ছিলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর। অপরদিকে লিবিয়ায় আরেক বড় খেলোয়াড় হচ্ছে রাশিয়া। লিবিয়ায় স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যেও সম্ভবত কিছু বিষয়ে বোঝাপড়া হয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন এই যুদ্ধ বিরতি ঘোষণার আগে টেলিফোনে কথা বলেছেন। আবার জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলও কথা বলেছেন পুতিনের সাথে।
পশ্চিমা চাপ আর ত্রিপলি সরকারের ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয়ের মুখে হাফতারের পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে। এ অবস্থায় উভয় পক্ষ থেকে এখন এলো যুদ্ধবিরতি ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের সংশয়পূর্ণ বিবৃতি। এটা একটা ঐতিহাসিক অগ্রগতি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সন্দেহ শুধু এই অগ্রগতির গন্তব্যে পৌঁছানো নিয়ে। দেখা যাক, কোথাকার জল কোথায় গড়ায়!
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে