ইসরাইলের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতের চুক্তির ফলে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে ইহুদিবাদী দেশটি। আর সবচেয়ে বেকায়দায় পড়েছে সৌদি আরব। এবার সৌদি আরবও কী আমিরাতের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে? সেটা কি সম্ভব? নিউইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ান, ফরেন ম্যাগাজিন ও মিডল ইস্ট আইয়ের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে এর নানা দিক।
আমিরাতের সঙ্গে চুক্তির ফলে ইসরাইলকে কার্যত কিছুই ছাড় দিতে হয়নি। চুক্তির জন্য পশ্চিম তীরে ইসরাইল দখলদারিত্ব সম্প্রসারণ স্থগিত রেখেছে মাত্র। সুযোগ বুঝে আবার তা ঠিকই বাস্তবায়ন করবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার কারণে ইসরাইলের পক্ষে আরও ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করার ইসরাইলের পক্ষে এই মুহূর্তে সম্ভব ছিল না। ফলে ইসরাইল কোনো ছাড় না দিয়েই পেয়েছে আমিরাতের মতো একটি আরব মুসলিম দেশের পূর্ণ বন্ধুত্ব। বিপরীতে আমিরাতও ভূরাজনৈতিক কৌশলের দিক থেকে কিছুটা লাভবান হতে পারে। বিশেষ করে আমিরাত এখন মধ্যপ্রাচ্যের নানা সংকটে মধ্যস্ততার জায়গায় চলে এসেছে।
আমিরাত-ইসরাইল চুক্তিতে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবেন তিন শাসন। তারা হলেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সযুক্ত আরব আমিরাতের শাসক মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান।
তবে এ চুক্তিতে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছে সৌদি আরব। এটা এখনো স্পষ্ট নয় যে সৌদি আরবের সম্মতিতে আমিরাত ইসরাইলের সঙ্গে চুক্তি করেছে কিনা। আমিরাত ও সৌদি শাসকদের মধ্যে গভীর অন্তরঙ্গতা ও রাজনৈতিক ইসলাম দমনের ব্যাপারে ঐকমত্য রয়েছে। তবে সম্প্রতি ইয়েমেন থেকে সৈন্য সরিয়ে নিয়ে সৌদির বিরাগভাজন হয়েছে আমিরাত। তাছাড়া তলে তলে ইরানের সঙ্গেও আমিরাত সম্পর্ক ভালো করার চেষ্টা করছে।
অনেকেই মনে করছেন, এবার সৌদি আরবও ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে যাচ্ছে। ট্রাম্প বলেছেন, শিগগিরই আরেকটি মুসলিম দেশ ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে যাচ্ছে। সেটি সৌদি আরব কিনা তা স্পষ্ট নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সৌদি আরবকে ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের আহ্বান জানিয়েছেন।
সৌদি আরব মনেপ্রাণে চাইলেও নানা জটিল সমীকরণে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন সহজ কাজ নয়। আমিরাত কখনও মুসলিম বিশ্বের সংকটে সোচ্চার ছিল না। তবে এক সময় সৌদি আরব ছিল। এমনকি ২০০২ সালে সৌদি আরব একটি শান্তি পরিকল্পনা দিয়েছিলো। যাতে বলা হয়েছে, ইসরাইল ১৯৬৭ সালের আগের সীমানায় ফিরে গেলে আরব দেশগুলো তাকে পূর্ণ স্বীকৃতি দেবে। এখন পর্যন্ত সৌদি সরকার সেই অবস্থান থেকে প্রকাশ্যে সরে আসেনি। আর ইসরাইল যে ওই পরিকল্পনা কখনো মানবে না তা স্পষ্ট।
ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন সৌদি আরবের জন্য সহজ নয়। সৌদি বাদশাহরা নিজেদের ইসলামের পবিত্রতম দুটি মসজিদের জিম্মাদার বলে দাবি করে থাকেন। এখন জেরুজালেম ও আল আকসা মসজিদ ইহুদিবাদীদের নিয়ন্ত্রণে রেখে কিভাবে ইসরাইলের সঙ্গে চুক্তি করবে তারা? সমস্যা আরও আছে।
সৌদি যুবরাজ এবং কার্যত দেশটির শাসক মোহাম্মদ বিন সালমানের কার্যক্রমে দেশটির আলেম সমাজ এবং জনগণের বিপুল অংশ অসন্তুষ্ট। মুসলিম দেশটিকে তিনি পাশ্চাত্যের ভাবধারায় পরিচালনা করতে চান বলে অনেকেই সন্দেহ করছেন। এ লক্ষে তিনি বেশ কিছু পদক্ষেপও নিয়েছেন। এখন ফিলিস্তিনি সংকটের সমাধান ছাড়াই সরাসরি ইসরাইলের সঙ্গে চুক্তি হলে সৌদির আলেম ও জনগণ ফুঁসে উঠতে পারে। সৌদি আরবে মত প্রকাশের কোনো স্বাধীনতা না থাকায় উত্থান হতে পারে উগ্রপন্থার। ১৯৭৯ এবং ২০০৩ ২০০৪ সালে সৌদিতে এভাবে উগ্রপন্থার বিকাশ ঘটেছিল। এমন পরিস্থিতির উত্থান হলে চরম অজনপ্রিয় সৌদি যুবরাজের ক্ষমতা মসনদ কেঁপে উঠতে পারে। সৌদি রাজপরিবারেও এ নিয়ে বিবাদ চরমে উঠতে পারে।
সৌদি আরব ইসরাইলের সঙ্গে চুক্তি করলে এখন দেশটি হবে আমিরাতের পদাঙ্ক অনুসারী। মুসলিম বিশ্ব এবং সৌদি জনগণ মহানবী সা. এর জন্মভূমিকে এ ভূমিকায় দেখতে আগ্রহী নয়। তাদের প্রত্যাশা সৌদি আরব থাকবে নেতৃত্বের আসনে, অনুসারীর জায়গায় নয়।
সৌদি আরবও এটা বুঝতে পারে। তাই আমিরাত ইসরাইল চুক্তি নিয়ে তারা কোনো কথা বলছে না। এর কারণ হতে পারে, তারা আমিরাতকে দিয়ে চুক্তি করিয়ে মুসলিম বিশ্বের প্রতিক্রিয়া বুঝতে চাইছে। এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে যে চুক্তির বিরুদ্ধে অনেকেই ফুঁসে উঠেছেন। এর অগ্রভাগে রয়েছে তুরস্ক, ইরান ও ইয়েমেন। কয়েকটি আরব দেশ চুক্তিকে সমর্থন করলেও বেশিরভাগ দেশই নীরব থাকার নীতি গ্রহণ করেছে।
সৌদি আরব এখন পরিস্থিত পর্যবেক্ষণ করছে। পরিস্থিতি অনুকুল মনে হলে তারাও ইসরাইলের সঙ্গে চুক্তি করতে পারে। সৌদি আরবের চির প্রতিদ্বদ্বী ইরান যেভাবে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন ও ইয়েমেনে প্রভাববলয় তৈরি করছে তাতে নিরাপদ বোধ করছে না রিয়াদ। ইরানের মোকাবিলায় তাদের এখন দরকার ইসরাইলের সহযোগিতা। বহুদিন ধরে গোপনে এ ধরনের সহযোগিতা আরব দেশগুলো নিচ্ছে ইসরাইলের কাছ থেকে। তবে এখন তারা আর রাখঢাকের ধার ধারতে চাচ্ছে না।
সৌদি আরব কয়েক বছর ধরে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রকাশ্যে নিয়ে আসার পক্ষে জনমত তৈরি করতে চেষ্টা চালিয়ে আসছে। এর অংশ হিসেবে ইহুদদিদের জয়গান এবং ইহুদদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করাকে উৎসাহিত করে গত রমজান মাসে দুটি বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করেছে সৌদি সরকার পরিচালিত একটি টিভি চ্যানেল। সমালোচকরা বলছেন, ইসরাইলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক তৈরির পথ সুগম করতে আরবদের মনোভাব পরিবর্তনের এটা একটা নিলর্জ্জ প্রচেষ্টা।
ঐতিহাসিকভাবে ইসরাইলের প্রতি বৈরিতা ও ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি মধ্যপ্রাচ্যের আরবদের ঐক্যবদ্ধ রেখেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধ, বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা ও অর্থনৈতিক সংকটে আরবের সরকারগুলো অভ্যন্তরীণ ইস্যুগুলোর দিকে বেশি মনযোগ দিচ্ছে। এতে তাদের অগ্রাধিকারের তালিকা থেকে ছিটকে পড়েছে ফিলিস্তিন ইস্যু। অনেক আরব নেতা মনে করছেন ইসরাইল তাদের চিরস্থায়ী শত্রু নয়। বরং ইরান ও মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে তাদের মিত্র এই ইহুদি দেশটি।
সৌদি যুবরাজ বলেছেন, ইসরাইলের সঙ্গে তার দেশের বাণিজ্যিক ও নিরাপত্তা স্বার্থ রয়েছে। তিনি রীতি ভেঙে এ কথাও বলেছেন যে ইসরাইলিদের নিজেদের ভূমির অধিকার রয়েছে। যদিও আন্তর্জাতিক আইনে ইসরাইল একটি অবৈধ রাষ্ট্র।
তবে সৌদি যুবরাজ বলেছেন, ইসরাইল একটি বড় অর্থনীতি এবং বিকাশমান অর্থনীতি। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়লে উপসাগরীয় দেশগুলো লাভবান হবে। তিনি বলেছেন, ইহুদিদের সঙ্গে সৌদির কোনো বিরোধ নেই।
এখন পর্যন্ত মিশর ও আমিরাতসহ তিনটি আরব আরব দেশ ইসরাইলে স্বীকৃতি দিলেও ইসরাইল সবচেয়ে বেশি চাচ্ছে সৌদি আরবের সমর্থন। অন্য যে কোনো মুসলিম দেশের তুলনায় সৌদি আরবের সমর্থন পেলে তার বৈধতা সংকট কিছুটা হলেও কেটে যায়। যুক্তরাষ্ট্রও চাচ্ছে সৌদি আরব ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে সম্পর্ক স্বাভাবিক করুক।
ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা রবার্ট ও ব্রায়েন ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য সৌদি আরবের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, তেল আবিবের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা হবে রিয়াদের জন্য ‘চমৎকার’ সিদ্ধান্ত। সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি একথাও ফাঁস করে দেন যে, শুধু সৌদি আরব নয় মধ্যপ্রাচ্যের আরো বেশ কয়েকটি দেশকে তেল আবিবের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য উৎসাহিত করে যাচ্ছে ওয়াশিংটন। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, শিগগিরই আরো দুই বা ততোধিক দেশ ইসরাইলের সঙ্গে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে যাচ্ছে।
অনেক বিশ্লেষক বলছেন, ইসরাইলের সঙ্গে চুক্তি করে আমিরাত নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইহুদি রাষ্ট্রটির অনন্ত যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। আর এতে লাভবান হবেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সযুক্ত আরব আমিরাতের শাসক মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান। ফিলিস্তিনিদের আশা ধ্বংস্তস্তূপে পরিনত করে তারা শান্তির জয়গান গাইছেন। গাডির্য়ানের এক সম্পাদকীয়তে তাই এই চুুক্তিকে ঐতিহাসিক ভুল বলে মন্তব্য করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, ট্রাম্প জনপ্রিয়তা হারিয়ে আসন্ন নির্বাচনে পরাজয় বরণ করতে যাচ্ছেন বলে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়। ডুবন্ত ট্রাম্প এখন যে কারো সাহায্য পেলেই খুশি। উত্তর কোরিয়া ও আফগানিস্তানে তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তাই তিনি আমিরাত-ইসরাইল চুক্তিতে ঐতিহাসিক হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করছেন।
নেতানিয়াহু নিজ দেশে চরম বেকায়দায় রয়েছেন। করোনা সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থতার জন্য তার পদত্যাগের দাবিতে জোরালো আন্দোলন চলছে। দুর্নীতির জন তিনি বিচারের মুখোমুখি। পরপর তিনটি নির্বাচনেও তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাননি। ইসরাইলের অর্থনীতি ভীষণ চাপে পড়েছে। তার দরকার ছিল জনগণের দৃষ্টি অন্যত্র সরাতে এরকম একটি চুক্তি। এ চুক্তির পর আগামী শীতেই তিনি আরেকটি সাধারণ নির্বাচনের ডাক দিতে পারেন। চুক্তির ফলে ওই নির্বাচনে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবেন বলে আশা করছেন।
মোহাম্মদ বিন জায়েদও তার ভুলের জন বিপাকে পড়েছেন। ইয়েমেন ও লিবিয়া যুদ্ধে জড়িয়ে তার দেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এতে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও তিনি নিন্দিত হয়েছে। তার দেশের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ইসরাইলের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে তিনি এসব ফাড়া কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে