লাখ-লাখ ফিলিস্তিনীকে স্বদেশভূমি থেকে উৎখাত করে ইঙ্গ-মার্কিনীরা প্রতিষ্ঠা করে দেয় ইসরাইল রাষ্ট্র। কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন আন্দোলন-সমঝোতা নয়, কোনো গণভোট নয়, কোনো মুক্তিযুদ্ধ তো নয়ই, দলে দলে পৃথিবীর নানা দেশ থেকে ইহুদীরা এলো আর আদিবাসী প্যালেস্টাইনীদের অস্ত্রের মুখে উৎখাত করে রাতারাতি সেখানে গজিয়ে উঠলো ইসরাইল নামের রাষ্ট্র!
একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কোনো রকম নিয়মবিধি না-মেনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ইসরাইলকে বলা হয়, 'মধ্যপ্রাচ্যের অবৈধ সন্তান'। এই অবৈধ দেশটির সাথে আশপাশের আরব দেশগুলোর বহুদিন কোনো সম্পর্ক ছিল না। ১৯৭৮ সালে এসে মার্কিন মধ্যস্থতায় ইসরাইলের সাথে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি করে মিশর। তারপর একে একে ওই পথে পা বাড়ায় তুরস্ক ও জর্দান। এভাবে অবৈধ দেশটি বৈধতা পেতে শুরু করে। আর আজ সেটা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, দুই পবিত্রতম মসজিদের দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত সউদি আরবও ইসরাইলের সাথে আলোচনার জন্য পা বাড়িয়ে বসে থাকে।
এই আগ্রহের কারণেই সউদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর মধ্যে ওয়াশিংটনে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে ওয়াশিংটন সফরই বাতিল করে দেন সউদি যুবরাজ। তাঁর ভয়, বৈঠকে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাঁর কী কথা হয়েছে, তা ফাঁস হয়ে যেতে পারে। সেটা হবে একটা মহাকেলেঙ্কারি।
অবশ্য সউদি যুবরাজ যখন তাঁর সফর বাতিল করছেন তখনও সিদ্ধান্ত হয়নি ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাঁর বৈঠকটি প্রথমে রেকর্ড করে পরে প্রচার করা হবে, নাকি সরাসরি স¤প্রচার করা হবে। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তাঁর জামাতা ও উপদেষ্টা জারেড কুশনার - দু'জনই চাচ্ছিলেন, যেভাবেই হোক, বৈঠকটি যেন অনুষ্ঠিত হয়। তাহলে তাঁরা সউদি যুবরাজ ও ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রীর হ্যান্ডশেইকের দৃশ্য প্রচার করে ''তরুণ আরব শান্তি প্রতিষ্ঠাতা'' হিসেবে যুবরাজের ইমেজ সমুন্নত করতে পারবেন। আর পারবেন ইসরাইল-আমীরাত শান্তি চুক্তির প্রতি আঞ্চলিক সমর্থন আদায় করতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এটা খুবই প্রয়োজন। কেননা, ওই চুক্তির কলকাঠি তো তারাই নেড়েছে!
মিডিয়া জেনে গেছে, সউদি যুবরাজ এ বিষয়ে যে বিবৃতিটি দেবেন তাতে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ থাকবে, প্রস্তাবিত বৈঠকের মানে এই নয় যে, ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে সউদি আরব। সউদি আরবের এ অবস্থান জেনেও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, বাতিল হওয়া বৈঠকটি সউদি-ইসরাইল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পথে একটা জোরদার পদক্ষেপ হতে পারতো। যুক্তরাষ্ট্র এ বৈঠক উপলক্ষে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছিল। বৈঠকের দিনক্ষণ স্থির হয়েছিল। প্রটোকল টিমও পাঠানো হয়েছিল।
রিপাবলিকান পার্টির কনভেনশন শেষ হওয়ার পর, ৩১ আগস্ট, সউদি যুবরাজের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসার কথা ছিল। ২০১৮ সালের পর যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের এটাই হতো প্রথম যুক্তরাষ্ট্র সফর। সর্বশেষ ওই সফরকালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিন সপ্তাহ অবস্থান এবং ব্যাপক গণসংযোগ করেন।
প্রস্তাবিত সফরকালে সউদি দূতাবাস কিংবা রাষ্ট্রদূতের বাসভবন - কোথাও থাকতে চাননি যুবরাজ। কারণ, এসব জায়গা সবার চেনা। যুবরাজ সেখানে আছেন জানলে সেখানে বিক্ষোভকারীরা সমবেত হতে এবং বিক্ষোভ করতে পারে। সবদিক বিবেচনা করে যুবরাজের থাকার থাকার জন্যে কোনো এক গোপন স্থানে চারটি বাড়ি কেনা হয়।
কিন্তু সব পরিকল্পনা পন্ড হয়ে যায় গত ২২ আগস্ট, যখন যুবরাজ জানতে পারেন যে তাঁর গোপন সফরটি আর গোপন নেই, ফাঁস হয়ে গেছে। হোয়াইট হাউসকে তিনি শর্ত দিয়েছিলেন যে পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে হবে কড়া গোপনীয়তায়। বৈঠক শেষ হওয়ার পরই কেবল তাঁর ওয়াশিংটনে উপস্থিতির কথা জানানো যাবে।
এরকম কড়া গোপনীয়তা রক্ষার শর্ত দেয়ার পেছনে যুবরাজের উপদেষ্টাদের কিছু হিসাবনিকাশ ছিল। তাঁরা ভেবেছিলেন, এর ফলে মার্কিন কংগ্রেসে যুবরাজের যেসব বিরোধিতাকারী আছেন তারা কোনো বিবৃতি তৈরী করার সময় পাবেন না। সময় পাবে না সউদি সাংবাদিক জামাল খাসোগী হত্যার বিচার দাবিকারীরা। কোনো আইনী ব্যবস্থা নেয়ার সময় পাবেন না সাবেক সউদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সা'দ আল-জাবরীর আইনজীবীও। আল-জাবরী বর্তমানে কানাডায় পালিয়ে আছেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার জামাতা কুশনার কিন্তু এখনও ব্যাকুলভাবে চাইছেন, সউদি যুবরাজের সফরটি অনুষ্ঠিত হোক। কারণ, এ সফরের ওপর নির্ভর করছে মার্কিন মধ্যস্থতায় সম্পাদিত ইসরাইল-আমীরাত চুক্তির প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সমর্থন আদায়। তাই যুবরাজের সফর বাতিলের কয়েক ঘণ্টার মাথায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং উপদেষ্টা কুশনার - দু'জনকেই মধ্যপ্রাচ্য সফরে পাঠান। উদ্দেশ্য : সেই চুক্তির পক্ষে ঢোল বাজানো।
এর আগের দিন, গত ২১ আগস্ট আরেকটি পরিকল্পিত বৈঠক বাতিল করে সংযুক্ত আরব আমীরাত। আমীরাতের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫ জঙ্গি বিমান বিক্রির পরিকল্পনায় ভেটো দিয়েছেন নেতানিয়াহু। তা নিয়ে জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেলি ক্র্যাফট ও তার ইসরাইলী প্রতিপক্ষের মধ্যে বৈঠকটি হওয়ার কথা ছিল।
এদিকে ইসরাইলকে আমীরাতের স্বীকৃতি প্রদান আরব দুনিয়ার যতটা সমর্থন পাবে বলে মনে করেছিলেন শ্বশুর-জামাই ট্রাম্প ও কুশনার, বাস্তবে ততোটা মেলেনি। তার বদলে গোটা আরব বিশ্বে এখন ধিক্কারধ্বনিই বেশি শোনা যাচ্ছে। এমনকি যে বাহরাইন ও সুদান প্রথমে ইসরাইল-আমীরাত চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছিল, তারাও এখন চুপ করে গেছে।
তারপরও কুশনার বলেন, ''আমাদের হাতে এমন আরো দেশ আছে, যারা ইসরাইলের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ার পথে এগিয়ে যেতে খুবই আগ্রহী। এ প্রক্রিয়া এগিয়ে যেতে থাকলে একসময় সউদি আরব ও ইসরাইল অনিবার্যভাবেই সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে এবং উভয়ে মিলে অনেক বড় কাজ সম্পন্ন করবে।''
ইসরাইল-আমীরাত চুক্তির প্রতি সউদি আরবের সমর্থনকে একটি টারনিং পয়েন্ট হিসেবে দেখছেন চুক্তির সমর্থকরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি শীর্ষস্থানীয় সউদি সূত্র সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ''৩১ আগস্ট যুবরাজের আমেরিকা যাওয়া ছিল নিশ্চিত। এ সফরের উদ্দেশ্য ছিল ইসরাইলের সাথে একটা বড় কিছু করা। তবে সেটা কী, তা নিয়ে আলোচনা চলছিল।''
তিনি আরো বলেন, ''নেতানিয়াহুর সাথে পরিকল্পিত বৈঠকটি একান্তে অথবা ক্যামেরার সামনে - দু'ভাবেই হতে পারতো। যেভাবেই হোক, এটা কিন্তু একটা বড় ব্যাপার। ওই বৈঠকেই সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ঘোষণা আসবে - এতোটা কেউ আশা করেনি, তবে যুবরাজ-যে ওই লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছেন, তার একটা সূচনা হতো ওই বৈঠকে।''
সউদি যুবরাজের মনে আরো ভয় ছিল। ১৯৭৮ সালে পরস্পরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিন করেছিলেন ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি। সেই হাত মেলানোটা কাল হয়েছিল সাদাতের জন্য; মুসলিম বিশ্বে তিনি একঘরে হয়ে পড়েছিলেন, পরে তো তাকে প্রাণই দিতে হয়। সেই ইতিহাস স্মরণ করে সউদি যুবরাজও ভয় পাচ্ছেন, নেতানিয়াহুর সাথে হাত মেলানোর পরিণামটা কেমন হবে!
সউদি সূত্র মিডল ইস্ট আইকে জানায়, দুই শত্রুর হাত মেলানোর উদ্যোগটা এসেছে মার্কিনীদের পক্ষ থেকে। যেহেতু ট্রাম্প ও কুশনার চাপ দিচ্ছেন তাই রাজি হয়েছেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানও। কেননা, আসন্ন মার্কিন নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়ী হওয়াটা যুবরাজের খুবই দরকার। সউদি সিংহাসনের সত্যিকার দাবিদার মোহাম্মদ বিন নায়েফকে সরিয়ে মোহাম্মদ বিন সালমানের যুবরাজ বনে যাওয়াকে সমর্থন করেছিলেন ট্রাম্প, দিয়েছিলেন বৈধতা।
আরো কয়েকটি গুরুতর বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের ছত্রছায়া পেয়েছিলেন মোহাম্মদ বিন সালমান। যেমন, সাংবাদিক খাসোগী হত্যা, জ্ঞাতি ভাইদেরকে ফাইভ স্টার হোটেলে বন্দী করে রাখা, কাতারের ওপর অবরোধ আরোপ ইত্যাদি। এ অবস্থায় মার্কিন ডেমোক্র্যাটদের দিক থেকে যুবরাজের কাছে যেসব ইঙ্গিত আসছে, তা মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়।
এমন অবস্থায় ওয়াশিংটন যাওয়ার আগে যুবরাজ শর্ত দেন যে তিনি যতদিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকবেন ততোদিন যেন তার সফরের কথা কেউ জানতে না-পারে। কেননা তাহলে সিআইএ, কংগ্রেস, সাংবাদিক মহল, খাসোগী-হত্যার বিচার দাবিকারী লোকজন এবং সাবেক সউদি মন্ত্রী জাবরি-র আইনজীবী - সবাই যুবরাজের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ আয়োজনের প্রচুর সময় পেয়ে যাবে। এটা হবে যুবরাজের জন্য একটা দুঃস্বপ্নের মতো। তাই যুবরাজ ঠিক করেছেন, নেতানিয়াহুর সঙ্গে আকস্মিক সাক্ষাতই হবে ভালো। এটাই তাকে শান্তিবাদী নেতার তকমা পরিয়ে দেবে।
সউদি রাজবংশের অনেকেও যুবরাজের পরিকল্পনার সাথে একমত নন। তাদের একটা বিরাট অংশই যুবরাজকে 'ধীরে চলার' পরামর্শ দিয়েছেন। তাদের যুক্তি হলো, আসন্ন নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়ের আশা ক্ষীণ। যদি ট্রাম্প জয়ী হতে না-পারেন তাহলে যুবরাজের এ সফর বুমেরাং হয়ে তাঁকেই আঘাত হানতে পারে। যেমন ঘটেছিল আরেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের বেলায়। ১৯৭৮ সালে তাঁরই মধ্যস্থতায় ইসরাইল-মিশর ক্যাম্প ডেভিড শান্তিচুক্তি হয়েছিল। আর এর মাত্র দুই বছরের মাথায় ১৯৮০ সালের নির্বাচনে হেরে যান তিনি।
ইসরাইলের সাথে সউদি আরবের স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ার উদ্যোগের খবরটি ছড়িয়ে পড়ার সাথে-সাথে আরব বিশ্বে ঘোরতর বিস্ময় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। রাজপরিবারের একজন বিশিষ্ট সদস্য লিখেন, ''জেরুসালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না-হওয়া পর্যন্ত ইসরাইলের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক হতে পারে না।'
সৌদি রাজপরিবারের আরেক সদস্য বলছেন, প্রতিবেশীর সাথে আমরা অবশ্যই শান্তিতে বসবাস করতে চাই, এমনকি সেই প্রতিবেশী ইসরাইল হলেও। তবে ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি কনফারেন্স স্টাইলে করলে হবে না। এক্ষেত্রে চাই ব্যাপক অংশগ্রহণ, বহু আলোচনা। নিঃসন্দেহে ভালো যুক্তি। প্রশ্ন হলো, সউদি শাসকরা কি তা মেনে নেবেন? আর মেনে নিলেও রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বহুজনের অংশগ্রহণের পন্থা কি আর কারাই বা হবেন সেই বহুজন? তাঁরাও কি পারবেন শাসকের ইচ্ছার বিপরীতে গিয়ে স্বাধীন মত প্রকাশ করতে? - এসব প্রশ্নের জবাব থেকেই মিলতে পারে আগামী দিনে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির পথনির্দেশ।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে