ইসরাইল-সংযুক্ত আরব আমিরাত চুক্তি আপাত দৃষ্টিতে শান্তি চুক্তি মনে হলেও বাস্তবে এটা যুদ্ধ। এ যুদ্ধ প্রথমত ইরানের বিরুদ্ধে এবং পরবর্তীতে তা সম্প্রসারিত হবে তুরস্কের বিরুদ্ধে। এ চুক্তির মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ঘাটি গাড়বে ইসরাইলী সৈন্য। এর ফলে দেশটি সামরিকভাবে পৌঁছে যাবে ইরানের অতি কাছে।
ছোট কয়েকটি আরব দেশের সাথে কথিত এ শান্তি চুক্তির মাধ্যমে ইসরাইলের অন্যতম লক্ষ্য হলো হরমুজ প্রনালী, বাব আল মানদেব প্রণালী নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে, পারস্য উপসাগর, লোহিত সাগর এবং সুয়েজ খালের ওপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্টা করা। একই সাথে উপসাগরীয় অঞ্চলের আরব দেশগুলোকে সরাসরি ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলা এবং তা শেষ পর্যন্ত তুরস্ক মুখী করা। অতীতের আরব ইসরাইল যুদ্ধ এখন রুপ নিতে পারে আরব-ইরান এবং আরব তুরস্ক যুদ্ধে। এ শান্তি চুক্তি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেছেন, ইসরাইল-সংযুক্ত আরব আমিরাত ইরানের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা এবং সামরিক জোট গঠনের একমত হয়েছে। আর এটা করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে।
মাইক পম্পেও ইসরাইল-সংযুক্ত আরব আমিরাত চুক্তিকে দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা এবং সামরিক জোট হিসেবে আখ্যায়িত করলেও এ দুই দেশের মধ্যে অতীতে কোনো যুদ্ধ হয়নি। দুদেশের নিরাপত্তারও কোনো সমস্যা ছিল না। ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর সংযুক্ত আরব আমিরাত একজন ইসরাইলী নাগরিকেরও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতি করেনি। দেশটি ইসরাইলের প্রতি আদৌ কোনো হুমকি ছিল না।
সংযুক্ত আরব আমিরাত সম্প্রতি ইয়েমেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এরপর সে লিবিয়া যুদ্ধে জড়িয়েছে। এর আগ পর্যন্ত দেশটি শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের এ শান্তিপূর্ণ উপাধি আর থাকছে না কথিত এ শান্তি চুক্তির ফলে। কারন ইসরাইলের সাথে কথিত শান্তি চুক্তির মাধ্যমে আসলে দেশটি নিজেকে প্রতিবেশী ইরানের বিরুদ্ধে দাড় করিয়েছে ।
এ চুক্তির ফলে সংযুক্ত আরব আমিরাত এখন ইরানের সাথে সরাসরি সামরিক সংঘাতের মুখোমুখি দাড়িয়ে গেছে। ইয়েমেন যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাত আগেই ইরানের বিরুদ্ধে সামরিকভাবে অবস্থান নিয়েছে। ইসরাইলের প্রধান শত্রæ ইরান। আর ইরানেরও ঘোর শত্রæ ইসরাইল। সংযুক্ত আরব আমিরাত ইরানের ঘোর শত্রæর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে নিজের নিরাপত্তার জন্য ।
নতুন এ আরব- ইসরাইল শান্তি চুক্তির ফলে মূলত পূর্বের সকল আরব-ইসরাইল শান্তি চুক্তি ভন্ডুল হতে পারে। নতুন সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে। আরব আমিরাতের আগে মিশর ১৯৭৯ সালে এবং জর্ডান ১৯৯৪ সালে ইসরাইলের সাথে শান্তি চুক্তি করেছে। এই দুই দেশ ইসরাইলের সাথে শান্তি চুক্তি করলেও তাদের ভ‚মিতে ইসরাইলী সৈন্যের উপস্থিতি প্রশয় দেয়নি। নিরাপত্তা সহযোগিতাও সীমাবদ্ধ অবস্থায় ছিল।
বর্তমান ইসরাইল-আরব আমিরাত শান্তি চুক্তি পূর্বের সব কিছু নতুন পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। আর এটি হবে শান্তির জন্য সুরক্ষার ছদ্মাবরনে। ইসরাইল-আমিরাত শান্তি চুক্তির মূল বিষয় হলো নিরাপত্তা এবং সামরিক বিষয়। এ চুক্তির ফলে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিভিন্ন ঘাটি ও আউট পোস্টে ইসরাইলী সৈন্য মোতায়েন থাকতে পারবে। ইসরাইলীরা এখন আরব উপদ্বীপে কোনো অতিথি বা টুরিস্ট হিসেবে সাদরে গৃহীত হচেছ না। বরং তারা এখন তাদের রক্ষক এবং মিত্র।
সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইরানের মাঝে পারস্য উপসাগর। পারস্য উপসাগরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে সর্বনিমন্ন দূরত্ব মাত্র ৩১ মাইল। এখন শান্তি চুক্তির ফলে সংযুক্ত আরব আমিরাতে উপস্থিত থাকবে ইসরাইল সৈন্য। তার মানে ইরানের একেবারে নাকের ডগায় এসে গেছে ইসরাইলী বাহিনী। পারস্য উপসাগরের পূর্ব উপক‚লে রয়েছে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ তেল ক্ষেত্র এবং সামরিক স্থাপনা। হরমুজ প্রণালীর কাছে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ বন্দর আব্বাস শহর এবং বন্দর। এসবই এখন ইসরাইলের সহজ নিশানার মধ্যে এসে গেছে । একই সাথে ইয়েমেনও ইসরাইলের সহজ নিশনার মধ্যে এসে গেছে। ইয়েমেনে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধ চালাচ্ছে ইরান।
ইসরাইলের সাথে কথিত এ শান্তি চুক্তির আরেকটি দিক হলো সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে ইসরাইলের বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ। যেহেতু উভয় দেশ ইরানের হুমকির মুখে স্বাভাবিকভাবে এ চুক্তিতে প্রাধান্য পেয়েছে নিরাপত্তা এবং সামরিক বিষয়টি। এ চুক্তির মাধ্যমে ইসরাইলের গুরুত্বপূর্ণ সমদ্রু রুট নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
এ চুক্তির মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থান করে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হরমুজ প্রণালীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায় ইসরাইল। যদিও এটি একটি আন্তর্জাতিক জলপথ। কিন্তু ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে হরমুজ প্রণালীর ওপর স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রন রয়েছে ইরানের। ইসরাইল হরমুজ প্রণালীর ওপর থেকে ইরানের এ নিয়ন্ত্রণ খর্ব করতে চায়। হরমুজ প্রণালীর নিয়ন্ত্রন নিয়ে ইরান- যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘ দিন থেকে দ্বন্দ্ব রয়েছে। এখন এ লড়াইয়ে যুক্ত হবে ইসরাইল। এক সময় সুয়েজ খাল এবং তিরান প্রণালী ইসরাইলের জন্য বন্ধ ছিল। মিশরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, সিনাই উপদ্বীপ দখল এবং পরবর্তীতে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে ইসরাইল সুয়েজ খাল এবং তিরান প্রণালী দিয়ে নৌ চলাচল নিশ্চিত করেছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের সহায়তায় ইয়েমেনের গুরুত্বপূর্ণ এডেন বন্দরে সামরিক ঘাটি নির্মাণের বাসনা রয়েছে ইসরাইলের। এ খবর যদি সত্য হয় তাহলে ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হবে বাব আল মানদেব প্রণালীর ওপর। এ প্রণালী যুক্ত করেছে লোহিত সাগর এবং এডেন উপসাগর হয়ে আরব সাগরকে । আর সুয়েজ খালের এক প্রান্ত যুক্ত লোহিত সাগরের সাথে। ফলে বাব আল মানদেব প্রণালীর ওপর নিয়ন্ত্রন আরোপের মাধ্যমে ইসরাইল আসলে সুয়েজ খাল, লোহিত সাগর এবং আকাবা উপসাগরের ওপর নিয়ন্ত্রন আরোপ করতে পারবে।
মিশর, জর্ডান এবং মরক্কো নিয়ে ‘এক্সিস অব মডারেশন’ জোট গঠনের চেষ্টা ছিলো। এ জোটের নেতৃত্বে রাখা হয় ইসরাইলকে । এর উদ্দেশ্য ছিল ইরান ও তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এটি জানার পর মিশর, জর্ডান এবং মরক্কো এ জোট বিষয়ে আর আগ্রহী নয়। এরপর ওয়াশিংটন দৃষ্টি দিয়েছে ইসরাইলকে সাথে নিয়ে উপসাগরীয় দেশগুলোকে ইরানের বিরুদ্ধে দাড় করাতে। যে সংঘাত শেষ পর্যন্ত তুরস্কের বিরুদ্ধে গড়াবে।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন ইসরাইল- সংযুক্ত আরব আমিরাত চুক্তির এখন পর্যন্ত সামান্য প্রকাশ পেয়েছে। এ চুক্তির বিষয় পুরোপুরি জানা যাবে কেবল মাত্র এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে। ইতোমধ্যে সৌদি এবং বাহরাইনের আকাশসীমা ইসরাইলের বেসামরিক এবং সামরিক বিমান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। এখন তেলআবিব থেকে ইসরাইলের সামরিক এবং বেসামরিক বিমান সরাসরি সৌদি আরব এবং বাহরাইনের ওপর দিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পৌছতে পারবে।
ভবিষ্যতে এ রুট ইসরাইল ব্যবহার করতে পারে ইরানের পারমানবিক রিএক্টরসহ বিভিন্ন স্থাপনার ওপর হামলা পরিচালনায়। ইসরাইল প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে তারা ইরানকে পারমানবিক বোমার অধিকারী হতে দেবে না। সংযুক্ত আরব আমিরাত এখন ইসরাইলের সাথে কাতার, সৌদি আরব এবং ওমানের চুক্তি করানোর জন্য নানা ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে । এজন্য দেশটি ওয়াশিংটনের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে।
কারন সংযুক্ত আরব আমিরাত একা লেজ কাটা শেয়াল হয়ে থাকতে চায় না। যেহেতু সাধারণ আরব জনগণ এধরনের চুক্তি ঘৃনা করে। এ কারনে আমিরাতের চাওয়া হলো অন্যান্য আরব দেশও তার মত ইসরাইলের সাথে শান্তি চুক্তি করুক। তাহলে কেউ আর একার দিকে আঙ্গুল তুলে দোষ দিতে পারবে না।
এক সময় আরব দেশে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী অস্ত্র বিক্রিতে আপত্তি ছিল ইসরাইলের। এখন আর ইসরাইলের এ ক্ষেত্রে বাধা দেয়ার কোনো কারন নেই। কারন সে জানে এসব অস্ত্র তার বিরুদ্ধে কখনই ব্যবহার করা হবে না বরং ব্যবহার করা হতে পারে ইরানের বিরুদ্ধে।
বাস্তবতা হচ্ছে ইসরাইল বর্তমানে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। ইসরাইল নিয়মিতভাবে সিরিয়া, ইরাক এবং লেবাননে হামলা পরিচালনা করছে। সিরিয়ার আসাদ সরকারের পক্ষে যুদ্ধ করছে ইরান। এ ছাড়া ইরাক এবং লেবাননে রয়েছে ইরান সমর্থিত বিভিন্ন বাহিনী। তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত হামলা চালাচ্ছে ইসরাইল। ইসরাইল এখন আর ইরানের বিরুদ্ধে কোনো প্রক্সি যুদ্ধ নয় বরং সরাসরি ইরানের মূল ভ‚খন্ডে হামলা চালাতে চায়। আর তা করা হবে আরব মিত্র দেশগুলোতে বসে।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে