তুরস্কের সমর্থন নিয়ে মিশরের মতো আরেক স্বৈরশাসকের উত্থান ঠেকিয়ে দিয়েছেন লিবিয়ার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারের প্রধানমন্ত্রী ফায়েজ আল-সারাজ। তবে সম্প্রতি নাটকীয়ভাবে তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। প্রশ্ন উঠছে, সারাজ কেন আকস্মিকভাবে পদত্যাগ করার ঘোষণা দিলেন? তার পদত্যাগের পর তুরস্কের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক হবে ভবিষ্যত ত্রিপোলি সরকারের?
মাত্র কয়েক মাস আগের কথা। লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি দখলের দ্বারপ্রান্তে ছিলেন দেশটির যুদ্ধবাজ ও স্বৈরতান্ত্রিক সামরিক নেতা খলিফা হাফতার। মনে করা হচ্ছিল, তার বাহিনী যে কোনো সময় ত্রিপোলি দখল করে নেবে। ঠিক এ সময় ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তুরস্ক। তুরস্কের সামরিক সহায়তায় যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। পিছু হটতে শুরু করেন হাফতার। এর ফলে মিশর, ইসরাইল, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের সমর্থনে মধ্যপ্রাচ্যে আরেক স্বৈরশাসকের উত্থানের শঙ্কা তিরোহিত হয়। তুরস্কের প্রভাববলয়ে চলে আসে লিবিয়া।
তবে গত ১৬ সেপ্টেম্বর লিবিয়ার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং তুরস্ক সমর্থিত জিএনএ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ফায়েজ আল সারাজ আকস্মিকভাবে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। তিনি জানান, অক্টোবরের পর তিনি আর ক্ষমতায় থাকতে চান না। এতে জল্পনাকল্পনা শুরু হয় কেন তিনি কোনো চাপ ছাড়াই স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করার ঘোষণা দিলেন।
অবশ্য সারাজের পদত্যাগের আগেই একই ঘোষণা দিয়েছে তার প্রতিপক্ষ ও খলিফা হাফতারের সমর্থনপুষ্ট সরকার। তবরুক-ভিত্তিক সেই সরকার ইতোমধ্যে পদত্যাগও করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সারাজের এই পদত্যাগ তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের হিসেবি গুটি চালানোর অংশ। লিবিয়ায় রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের পরিসমাপ্তি টেনে সেখানে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার অংশ দেশটির দুই অংশের সরকারের পদত্যাগ।
লিবিয়া নিয়ে তুরস্কের অবস্থানকে সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ ওয়াশিংটন চায় না, মধ্যপ্রাচ্যের আরেকটি দেশে রাশিয়ার প্রভাব বাড়ুক। এজন্য খলিফা হাফতারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর চাপ রয়েছে। এর ফলে হাফতারের সমর্থনপুষ্ট সরকার পদত্যাগ করেছে। ঠিক একইভাবে রাজনৈতিক সমঝোতার অংশ হিসেবে সরে দাঁড়াচ্ছেন সারাজও। ফলে লিবিয়ার শিগগিরই যে নতুন নির্বাচন হওয়ার কথা তাতে হাফতারের কোনো স্থান হবে না। থাকবেন না সারাজও। এতে দেশটিতে জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী একটি সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পথ সুগম হবে।
তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্র পরিকল্পনা অনুযায়ী সম্ভবত সারাজ পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। মিশর ও আমিরাতের ইচ্ছা ছিল সেখানে স্বৈরাচার হাফতারকে বসানো। তাদের সে খেলা ভন্ডুল হয়ে গেছে। সারাজের পদত্যাগের ঘোষণায় দুঃখপ্রকাশ করেছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিজেপ তায়্যেপ এরদোয়ান। তবে তিনি বলেছেন, এতে লিবিয়ার সঙ্গে তাদের সম্পর্কে প্রভাব পড়বে না।
ইরাকি রাজনৈতিক বিশ্লেষক মেহমেত বুলোভালি বলেছেন, রাশিয়া, ফ্রান্স, আমিরাত, সৌদি আরব ও মিশরের সমর্থনপুষ্ট হাফতারের বিদায় হচ্ছে। সম্ভবত তার স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন তবরুক ভিত্তিক সংসদের স্পিকার আহমেদ মাইতিক। তার নেতৃত্ব গঠিত সরকারকে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে। অর্থাৎ ত্রিপোলি শাসনের ভার তার কাধে তুলে দেওয়া হতে পারে। তুরস্ক বংশোদ্ভুত মাইতিক একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তিনি সারাজের উপপ্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
তার নেতৃত্ব নিয়ে বিদেশি শক্তি কোনো প্রশ্ন না তুললে তিনি গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে দেশটিতে শৃংখলা ফেরাতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেন বুলোভালি।
লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে বিশ্বশক্তির বিপরীত মেরুতে অবস্থানের জেরে কিছুদিন আগে পূর্ব ভূমধ্যাসাগরেও যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছিল। লিবিয়ার বৈধ সরকারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা চুক্তির মাধ্যমে সেখানে প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধানের অনুমতি পেয়েছে তুরস্ক। তবে ফ্রান্স, মিশর, গ্রিস তাতে বাধা দিতে চাচ্ছে। এ নিয়ে সম্প্রতি তুরস্কের সঙ্গে তাদের উত্তেজনা চরমে পৌছায়। তুরস্ক ও ফ্রান্স রণতরী পাঠায় পূর্ব ভূমধ্যসাগরে।
সম্প্রতি উভয় পক্ষই সুর নরম করেছে। ফ্রান্স ও গ্রিস বুঝতে পেরেছে যে চাপের কাছে মাথা নত করার পাত্র নন তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। ব্রাসেলসে ন্যাটো সদর দফরে বৈঠকে মিলিত হয়েছেন তুরস্ক ও গ্রিসের কূটনীতিকরাা। দুই দেশের উত্তেজনা প্রশমনে যুক্তরাষ্ট্রও কাজ করছে। বুলোভালি বলেন, ন্যাটোর সদস্য তুরস্ক ও গ্রিস কেউই যুদ্ধ চায় না। উভয়ই চাচ্ছে সংঘাত এড়াতে। লিবিয়ায় সংঘাত এড়ানো গেলেও ভূমধ্যসাগর কেন্দ্রিক উত্তেজনাও পরিহার করা সম্ভব হবে।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, লিবিয়ার উভয় পক্ষের সরকারের পদত্যাগের এই কৌশল আমেরিকার। তারা চাচ্ছে লিবিয়ায় রাশিয়ার আধিপত্য বিস্তার রোধ করতে। তবে ফ্রান্স, রাশিয়া ও আমিরাত নতুন এই রাজনৈতিক সমঝোতাকে ভন্ডুল করে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। তবে বুলোভালির বিশ্বাস, সেটা করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
প্রেসিডেন্ট এরদোগানের মুখপাত্র ইব্রাহিম কালিন বলেছেন সারাজ আগামী মাসে পদত্যাগ করবেন বলে ঘোষণা দেয়ার পরও দেশটির জাতীয় সরকারের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখবে তুরস্ক। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বীকৃত লিবিয়ার জাতীয় সরকারকে সমর্থন দেয়া এবং গত বছর ত্রিপোলির সাথে সই হওয়া নিরাপত্তা চুক্তিসহ সমস্ত দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বহাল রাখবে আঙ্কারা।
ইব্রাহিম কালিন বলেন, লিবিয়ার রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ এসব চুক্তির ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। কারণ এ সমস্ত সিদ্ধান্ত দুই দেশের সরকারের মধ্যে হয়েছে, কোনো ব্যক্তির সাথে নয়। লিবিয়ার ঘটনাবলী নিয়ে আলোচনা করার জন্য তুরস্কের সরকারি কর্মকর্তারা আগামী দিনগুলোতে ত্রিপোলি সফর করতে পারেন বলে তুর্কি প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র জানান।
এদিকে লিবিয়ার ওপর আরোপিত জাতিসংঘের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের অভিযোগে তুরস্কের একটি প্রতিষ্ঠানের ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞার নিন্দা জানিয়েছে আঙ্কারা। তুরস্ক বলছে, এই পদক্ষেপ ইউরোপীয় জোটটির দ্বৈতনীতি এবং পক্ষপাতমূলক অবস্থান।
গত জুনে সমুদ্র এলাকায় বিরোধপূর্ণ একটি ঘটনায় জড়ায় দুই ন্যাটো মিত্র ফ্রান্স ও তুরস্ক। ওই ঘটনায় যুক্ত ছিল তুরস্কের আভরাসিয়া শিপিং কোম্পানির মালিকানাধীন পরিবহন জাহাজ সিরকিন। ওই কোম্পানিটির সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ইইউ’র অভিযোগ, ওই জাহাজ ব্যবহার করে লিবিয়ায় অস্ত্র পাচার করছিল কোম্পানিটি।
অস্ত্র পাচারের অভিযোগ অস্বীকার করে আঙ্কারা বলছে, জাহাজটি মানবিক ত্রাণ পরিবহন করছিল। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, লিবিয়ার যুদ্ধরত পক্ষগুলোর কাছে অস্ত্র পৌঁছানো ঠেকাতে ভূমধ্যসাগরে নিয়োজিত ইউরোপীয় মিশন হাফতারকে পুরস্কৃত করছে আর জাতিসংঘ স্বীকৃত লিবিয়ার সরকারকে শাস্তি দিচ্ছে।
তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ওইসব দেশ এবং তাদের কোম্পানিগুলো আকাশ ও স্থলপথ ব্যবহার করে নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত ভঙ্গ করে হাফতারের কাছে অস্ত্র পাঠাচ্ছে। যার শুরু করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। এটা উপেক্ষা করে বৈধ সরকারকে সহায়তা পাঠানোকে নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। এটা পরিষ্কারভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পক্ষপাতদুষ্ট।
তুরস্কের কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ ছাড়াও ইউরোপীয় ইউনিয়ন লিবিয়ার দুই নাগরিক ও আরও দুটি কোম্পানি কাজাখস্তানের সিগমা এয়ারলাইন্স এবং জর্ডানের মেড ওয়েভ শিপিংয়ের বিরুদ্ধেও একই ব্যবস্থা নিয়েছে। তুরস্কের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘পূর্ব ভূমধ্যসাগরে উত্তেজনা নিরসনে যখন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে তখন এ ধরনের সিদ্ধান্ত দুর্ভাগ্যজনক।’
তুরস্কের সঙ্গে লিবিয়ার বহুমাত্রিক সম্পর্ক যে অটুট থাকছে তার প্রমাণ মিলছে দুই দেশের যৌথ সামরিক কর্মসূচির ঘোষণায়। লিবিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সালাহ উদ্দিন নামরুশ বলেছেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির সামরিক বাহিনী পুনর্গঠনে সহায়তা দেবে তুরস্ক ও কাতার।
এক বিবৃতিতে নামরুশ বলেছেন, লিবিয়ার সশস্ত্র বাহিনী, আকাশ প্রতিরক্ষা, নৌবাহিনী, বিশেষ অভিযান ইউনিট ও সন্ত্রাসদমন ইউনিট পুনগর্ঠনে দুই দেশের মধ্যে নানা ধরনের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। গত আগস্টের মাঝামাঝি এ নিয়ে তুরস্ক ও কাতারের সঙ্গে লিবিয়া সরকারের চুক্তি হয়। তুরস্ক লিবিয়ায় সেনাবাহিনীকে নিয়মিত বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠায় সামরিক সহায়তা ও প্রশিক্ষণ দেবে।
আর্মেনিয়ার আগ্রাসনের মুখে ১৯৯৩ সালে সাক্ষরিত এক চুক্তির মাধ্যমে আজারবাইজানের সেনাবাহিনী গড়ে তোলায় মুখ্যভূমিকা পালন করেছিল তুরস্ক। সেই মডেলই অনুসরণ করা হবে লিবিয়ায়। এখন আজারবাইজানের সামরিক বাহিনী আর্মেনিয়ার চেয়েও শক্তিশালী বলে মনে করা হয়।
লিবিয়া পরিস্থিতিতে নতুন এক ভূরাজনৈতিক সমীকরণের উদ্ভব ঘটেছে। ইসরাইলের সঙ্গে আমিরাত ও বাইরাইনের চুক্তির ফলে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে ইরান ও তুরস্ক পরস্পরের আরও কাছাকাছি আসার প্রয়োজন অনুভব করছে। লিবিয়াতে তুরস্কের অবস্থানকে সমর্থন করছে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ইরান। সম্প্রতি আঙ্কারা সফরে গিয়ে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ বলেছেন, লিবিয়া ও ইয়েমেন ইস্যুতে তুরস্কের অবস্থানকে সমর্থন করে ইরান।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে