ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একেবারে 'সুবোধ ছেলে' হয়ে গেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। এখন তারা যা চাইবে, তা-ই যেন দিতে প্রস্তুত আমেরিকা। সম্প্রতি আমিরাতের কাছে অত্যাধুনিক অস্ত্র বিক্রি অনুমোদন করেছে আমেরিকা। এ অত্যাধুনিক অস্ত্র হচ্ছে ড্রোন। এটাও ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করারই পুরস্কার।
অনেকে ভেবে পাচ্ছেন না, আমিরাত কেন আমেরিকান ড্রোন পেতে চাইছে। কারণ, তার ভান্ডারে তো এখনই চীনের তৈরী কয়েক ডজন ড্রোন আছেই। অপরদিকে আমেরিকাই বা কেন এগুলো বিক্রি করতে চাইছে।
মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার রণাঙ্গনগুলোতে চীনের তৈরী সশস্ত্র ড্রোনগুলোর ব্যাপক কার্যকারিতা সবার চোখে ধরা পড়েছে। এগুলোর সাহায্যে ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহী নেতাদের এবং সিনাইয়ে আইএস-এর মদদপুষ্ট জঙ্গিদের হত্যা করা সম্ভব হয়েছে। তাছাড়া লিবিয়ার জঙ্গি নেতা খলিফা হাফতার কিছু দিনের জন্য যুদ্ধের ময়দানে বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতেও সক্ষম হয়েছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে ঐতিহ্যগতভাবে তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্রব্যবস্থা বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানায়, চীনের সেরকম কোনো অসুবিধা নেই। ফলে তারা মধ্যপ্রাচ্য থেকে আফ্রিকা - সবখানেই অবাধে ড্রোন রফতানি করে চলেছে।
চীনের কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়ে পাকিস্তান, সউদি আরব ও মিয়ানমারে কারখানায় নির্মিত হচ্ছে চীনা আর্মড ড্রোন। চীনা ড্রোনের রফতানি এত বেশি যে, কেবল এর সুবাদেই চীন অস্ত্র রফতানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। প্রশ্ন হলো, চীনের ড্রোন কেন এত জনপ্রিয় আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই বা কেন এখন পর্যন্ত তাদের মানুষবিহীন আকাশযান বিক্রিতে এত অনিচ্ছুক?
এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় , মাত্র কয়েক বছরে চীন তার আর্মড ড্রোন নিয়ে গবেষণা, উৎপাদন ও মানোন্নয়নে সক্ষম হয়েছে। তাদের ড্রোনগুলো এখন যে-কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে সামরিক ভারসাম্য রক্ষায় সক্ষম।
চীনের দু' ধরনের কমব্যাট ড্রোন এখন রফতানির জন্য প্রস্তুত। উভয় ধরনের ড্রোনেরই সাফল্যের রেকর্ড রয়েছে। প্রথম ধরনের ড্রোন হলো চাই হং রেইনবো সিরিজ। সিএইচ-৪ নামে পরিচিত এসব ড্রোন নির্মাণ করেছে চাইনিজ অ্যারোস্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি কর্পোরেশন। জনপ্রিয় এসব ড্রোন কিনেছে মিশর, ইরাক ও জর্দান। এ জাতীয় ড্রোনের আগের ভারসনটি ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে নাইজেরিয়ায়; সরকারি বাহিনীর সাথে বোকো হারাম জঙ্গিদের যুদ্ধে।
রফতানির জন্য প্রস্তুত চীনের দ্বিতীয় ধরনের ড্রোন হচ্ছে উইং লিং সিরিজ। এগুলো বানিয়েছে চেংদু এয়ারক্র্যাফট ইনডাস্ট্রি গ্রুপ। এগুলো লিবিয়ায় সরকারি বাহিনীর সাথে জঙ্গি নেতা হাফতারের বাহিনীর যুদ্ধে ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে। এগুলো ব্যবহারের সুবিধা নিয়ে হাফতারের বাহিনী এক পর্যায়ে সরকারি বাহিনীকে প্রায় কোণঠাসা করে ফেলতেও সক্ষম হয়।
উভয় ধরনের ড্রোনের কিছু অভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা ক্রেতারা চায়। যেমন এর রয়েছে উল্লেখযোগ্য রেঞ্জ, যা অন্যান্য কমব্যাট ড্রোনের নেই। এ বৈশিষ্ট্যটি এ ড্রোনের আক্রমণসক্ষমতা অনেক বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে। এগুলো উঁচুতে বসেও পরিচালনা করা যায়। প্রতিযোগীদের চাইতে বেশি টেকসই। এছাড়া এসব ড্রোন অনেক বেশি বোমা ও মিসাইল বহনে সক্ষম। সবচাইতে বড় কথা হলো, এগুলো দামেও বেশ সস্তা। আমেরিকার তৈরি একটি রিপার এমকিউ-৯ ড্রোনের দাম যেখানে ১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, সেখানে চীনের তৈরী একটি সিএইচ-৪ কমব্যাট ড্রোন পাওয়া যায় এর চার ভাগের এক ভাগ দামে, অর্থাৎ মাত্র চার মিলিয়ন মার্কিন ডলারে।
চীনা ড্রোনের এতসব সুবিধা সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশ কেন এখনও মার্কিন অস্ত্রব্যবস্থা কিনতে চায়। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই বা কেন এখন ঘনিষ্ঠ মিত্র ছাড়া অন্যদের কাছেও তার অত্যাধুনিক অস্ত্র বিক্রি না-করার সনাতনী নীতি থেকে সরে আসতে চাইছে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনা ড্রোনগুলো বেশ কাজের বটে, তবে পারফেক্ট অপারেশনাল রেকর্ড থেকে এখনও অনেক দূরেই সেগুলোর অবস্থান। সেগুলোর স্যাটেলাইট কম্যান্ড ও কন্ট্রোল এখনও সম্পূর্ণ নিখুঁত নয়। সেগুলো যখন উপর দিয়ে উড়ে যায়, তখন এমন উপর দিয়ে যেতে পারে না, যা নিচে থেকে আক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে পারে। এর ফলে চীনের তৈরী বেশ ক'টি কমব্যাট ড্রোনকে নিচে থেকে গুলী করে ভূপাতিত করা সম্ভব হয়েছে। আর তুলনামূলক সস্তা হলেও এসব ড্রোন কিনতে কয়েক মিলিয়ন ডলার তো লাগেই। তাছাড়া বেশ সময়ও লেগে যায়। এসব কারণে যারা এসব ড্রোন ব্যবহার করছে, যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের বেশ বিপাকেই পড়ে যেতে হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরী এমকিউ-৯ রিপার ড্রোনের হামলা সক্ষমতা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। এর অপারেশনাল রেকর্ডও চমৎকার। এসব ড্রোন আক্ষরিক অর্থেই পৃথিবীর অর্ধাংশ থেকে চালানো যায়। মোটের ওপর রিপার হচ্ছে বিশ্বের প্রথম ডেডিকেটেড হান্টার-কিলার ড্রোন, যা অনেক বেশি ও ভারি প্রেসিশন-গাইডেড বোমা ও মিসাইল বহনে সক্ষম। এসব প্রিমিয়ার কমব্যাট ড্রোন বিক্রি করবে কি করবে না, তা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিধা যেন কাটছেই না।
যুক্তরাষ্ট্রের ভয়, যারা কিনবে তারা এগুলোর অপব্যবহার করতেও পারে অথবা এগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্ব›দ্বী কোনো দেশের হাতে গিয়েও পড়তে পারে। যেমন, চীন। চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ তো বেশ পুরনোই।
অত্যাধুনিক ড্রোন প্রযুক্তি বিক্রি নিয়ে চীনের কিন্তু এসব সমস্যার বালাই নেই। বরং এটাকে তারা দেখছে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রভাব বৃদ্ধি হিসেবে। যারা চীনের এসব ড্রোন কিনবে তাদের প্রয়োজন হবে চীনা উপদেষ্টাদেরও। ওই উপদেষ্টারা ক্রেতা দেশের কর্মীদের এগুলোর ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ শেখাবেন। এসব ড্রোনে বহনের উপযোগী বোমা ও মিসাইলও আনতে হবে চীন থেকেই। যারা ইতিমধ্যে এগুলো ব্যবহার করছে তাদের পক্ষে নতুন চীনা সিস্টেমের সাথে সমন্বিত হওয়াও সহজই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একে দেখছে চীনের এক ধরনের প্রভাব বিস্তার হিসেবে এবং হচ্ছে উদ্বিগ্ন।
যেসব দেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত, চীন সেসব দেশে তার সামরিক প্রযুক্তি রফতানি করতে বেশি আগ্রহী। কারণ, এ উদ্যোগের সাথে জড়িয়ে আছে অনেক সমুদ্রবন্দর, মহাসড়ক ও রেললাইন নির্মাণের কাজ। সবই নিকট-ভবিষ্যতে কাজে লাগবে চীনের।
এছাড়া বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই-এর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত দেশগুলোর সাথে দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরক্ষা সহযোগিতায়ও চীনের আগ্রহ আরো বেশি। সম্প্রতি প্রকাশিত লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস ফরেইন পলিসি থিঙ্ক ট্যাঙ্কের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন তার সামরিক প্রযুক্তি সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশের কাছেই বেশি বিক্রি করছে, যারা বিআরআই-এর সাথে বেশি করে যুক্ত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের এক ধরনের ড্রোন আমীরাতের কাছে বিক্রির অনুমতি দিয়েছে। এসব ড্রোন অস্ত্রসজ্জিত নয়। কিন্তু আমীরাত এতে খুশি নয়। তারা আমেরিকার কাছ থেকে অনেক দিন ধরে চেয়ে আসছে রিপার, যা আমিরাতের অস্ত্রভান্ডারকে সমৃদ্ধ করবে। আমীরাত মনে করে তারা আমেরিকার শত্রুদের সাথে লড়াই করছে আর তাই আমেরিকার উচিত তার অত্যাধুনিক অস্ত্রের ভাগ আমীরাতকেও দেয়া।
দেন দরবার করেও যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন না -পেয়ে তারা ঝুঁকেছে চীনের দিকে। আর চীন তো আমিরাতকে সাহায্য করতে পেরেই খুশি। এমন এক অবস্থায় আমিরাত-ইসরাইল শান্তিচুক্তি হলে পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টে যায়। আমিরাতের কাছে এফ-৩৫ ও বহুকাঙ্খিত রিপার ড্রোন বিক্রির অনুমতি দেয় মার্কিন কংগ্রেস। ইসরাইল এ নিয়ে প্রথম দিকে বেশ হাউমাউ করেছিল এই বলে যে এতে করে ওই অঞ্চলে সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব হারাবে তারা। পরে অবশ্য দেশটি চুপ করে যায়। এটা ঠিক, এফ-৩৫ আমিরাতের সামরিক সক্ষমতা যতোটা বাড়াবে, রিপার ঠিক ততোটা নয়। তাছাড়া ২০০৭ সাল থেকে চলে আসা এ কর্মসূচি বদলানোরও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্র।
এখন কমব্যাট ড্রোন দরকার এমন, যা বেশিদিন টিকে থাকবে, বেশি অস্ত্রসজ্জিত হবে, অনেক উঁচু দিয়ে অনেক দ্রæত গতিতে চলবে এবং ''নিজে নিজেই চিন্তা করতে'' করতে পারবে। এ রকম কিছু ড্রোন ইতিমধ্যেই এসেও গেছে। একবার আদেশ দিলে মানুষের নির্দেশনা ছাড়াই তারা মিশন সম্পন্ন করতে সক্ষম।
তাছাড়া এমন ড্রোন দরকার, যা হবে আরো সস্তা, নেটওয়ার্কযুক্ত এবং প্রতিকূল আবহাওয়ায়ও চলতে সক্ষম। চীন ও আমেরিকা এ ধরনের ড্রোন নিয়ে কাজ করছে। চীন যদি এ রকম ড্রোন উদ্ভাবন করে ফেলতেই পারে, তবে তারা তা তাদের মিত্র দেশগুলোর কাছে বিক্রি করতে দেরি করবে না।
এখন আমীরাতের কাছে রিপার বিক্রি করবে আমেরিকা। ওগুলো হাতে পাওয়ার পর লিবিয়া ও ইয়েমেনের আকাশে ওড়াতে ও হামলা চালাতে আমিরাত একটুও দেরি করবে বলে মনে হয় না। কারণ, এর সাথে জড়িয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের লড়াই। এখন কেবল দেখার পালা, এ লড়াইয়ে কে হারে, কে জেতে।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে