যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু সিনেটর সংযুক্ত আরব আমীরাতের কাছে এফ থার্টি ফাইভ যুদ্ধ বিমান বিক্রি নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। এ নিয়ে দেখা দিয়েছে জটিলতা। যুক্তরাষ্ট্র কী ইসরাইলের মতো আরব আমিরাতকে কৌশলগত মিত্র ও নিরাপত্তা সহযোগী হিসাবে বিবেচনা করতে পারে কিনা তা নিয়ে দেখা দিয়েছে বির্তক।
মার্কিন এসব আইন প্রনেতাদের মতে, আমিরাতকে এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমানগুলো দেয়া ঠিক হবে না কারণ ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যে সামরিকভাবে শক্তিশালী রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। আমিরাতের কাছে বিমান চলে গেলে ইসরাইলের সে একক আধিপত্য আর অক্ষুন্ন থাকবে না। তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ইসরাইলকেই এককভাবে এ সুযোগটি তারা কেন দিতে চাইছেন তা পরিস্কার নয়।
অনেক খ্যাতনামা সিনেটর এমনকি ডেমোক্র্যাট সিনেটর ইলহান ওমরও ইসরাইলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন যা রীতিমতো বিস্ময়কর। এ সিনেটররা ইসরাইলের নিরাপত্তা ও আধিপত্য নিয়ে উদ্বিগ্ন। অথচ তারা ভুলে যান যে, ইসরাইল নিজেই আমীরাতকে এ সুবিধা দিতে রাজি হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমীরাতকে শর্ত দিয়েছিল যে, এফ থার্টি ফাইভ বিমান পাওয়ার বিনিময়ে আমীরাতকে ইসরাইলের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ককে স্বাভাবিক করতে হবে। ইসরাইলও তা মেনে নিয়েছিল। শর্তানুযায়ী আমীরাত ইসরাইলকে স্বীকৃতিও দিয়ে দিয়েছে। তাহলে বিমান দেয়া নিয়ে কেন এই গড়িমসি?
আমিরাতি নীতিনির্ধারকরা যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে হতাশ হয়ে পড়েছে। তাদের মতে এফ থার্টি ফাইভ বিমান বিক্রি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির সঙ্কট ধরা পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই বিশেষ একটি দেশকে বাড়তি সুবিধা দিয়ে গেছে। যা নৈতিক ভাবে গ্রহনযোগ্য নয়। যুক্তরাষ্ট্রের এই পক্ষপাতিত্বের বৈদেশিক নীতির উদহারন দিতে গিয়ে তার বলছে ২০০৯ সালে ইরানে যখন নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে সংকট তৈরি হয় তখন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইরানকে আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে এ সংকটের সমাধান করার আহবান জানান। কিন্তু দু বছর পর যখন মিশরে হোসনী মোবারকের বিরুদ্ধে জনগন রাস্তায় নেমে আসে, তখন যুক্তরাষ্ট্র আলাপ আলোচনা বা সংলাপের কোনো সুপারিশ করেনি। বরং তারা জানিয়েছিল হুসনি মোবারকের অবিলম্বে সরে যাওয়া উচিত।
বারাক ওবামা যে এমন নীতি নিয়েছেন এমন নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার স্বৈরশাসক কিম জং উনের সাথে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। অথচ সে যুক্তিতে ইরানের সাথে আলোচনায় বসার কোনো আগ্রহ তিনি দেখাননি। এমনকি ন্যাটো বা ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশগুলোর সাথেও তিনি স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পারেননি। আরব আমীরাতের কাছে এফ থার্টি ফাইভ বিমান বিক্রি নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র ঠিক একই রকমের দ্বিমুখী ভূমিকা পালন করছে বলে মনে করেন আমিরাতের বিশ্লেষকরা।
আরব আমিরাত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে আস্থাভাজন মিত্রদেশগুলোর মধ্যে একটি। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে আমীরাত সিরিয়ায় সেনা পাঠিয়েছিলো। আফগানিস্তানেও ন্যাটো সেনাদের পাশাপাশি আমীরাতের বিমান বাহিনীর পাইলটরাও দায়িত্ব পালন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র আর আমীরাতের বন্ধুত্বের এমন আরো অনেক দৃষ্টান্তই আছে। অথচ এরপরও যুক্তরাষ্ট্র আমীরাতকে বন্ধুত্বের প্রতিদান দিতে অনীহা দেখাচ্ছে।
আমিরাত এই যুদ্ধ বিমান পাওয়ার জন্য মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ওয়াশিংটনের বহু নীতি নির্ধারকই মনে করে আমীরাতের কাছে এ বিমানটি হস্তান্তর করলে ইসরাইলের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। ইসরাইলকে খুশি রাখতে আমিরাত সব প্রচেষ্টা গ্রহন করেছে। এরই মধ্যে ইসরাইলতে শুধু স্বীকৃতিই দেয়নি বরং দুদেশের ব্যবসায়িক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরস্পরের সাথে বানিজ্যিক সম্পর্ক তৈরি করেছে। দু’দেশ বৈদেশিক বিনিয়োগেও সম্মত হয়েছে। দুদেশের মধ্যে এরই মধ্যে একটি বিমানের নিয়মিত যাতায়াতও শুরু হয়েছে। দুবাই এর একটি হোটেল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইসরাইলে খুব শীঘ্রই জমি কিনে সেখানে ব্যবসা শুরু করার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে।
কিন্তু আমিরাতের কাছে এখনও বোধগম্য নয় ইসরাইলের জন্য এত ছাড় দেয়ার পরও কেন ইসরাইলের নিরাপত্তার জন্য আমিরাতকে হুমকি মনে করছে? সম্ভবত আমিরাত এখন এফ-৩৫ পাওয়ার জন্য ইসরাইলে লবিং শুরু করেছে। যাতে ইসরাইল প্রস্তাব করে ,আমিরাতকে এফ-৩৫ দেয়া হোক। অবিশ্বাস্য মনে হলেও আমিরাত ইসরাইলের আস্থা অর্জনের জন্য এখন সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে রাজি আছে বলে মনে হচ্ছে। আমিরাতের এখন যুক্তি হচ্ছে ইসরাইলের নিরাপত্তাকে সুসংহত করার জন্য এবং ইরানকে দমন করার জন্য আমীরাতকেও সামরিকভাবে সমৃদ্ধ করা প্রয়োজন।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নিয়ে আমিরাতের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। তাদের মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে বন্ধুত্বকে অমর্যাদা করে এবং শত্রুদের সাথে আড়ালে নাটক রচনা করে- তার একটি ইতি টানা উচিত। বন্ধু হিসেবে আমীরাত নিজেকে যদি সামরিকভাবে শক্তিশালী করতে চায় তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত তাকে সহযোগিতা করা।
আমীরাতের বন্ধুরাষ্ট্র থেকে এবার আসা যাক প্রতিপক্ষ দেশ ইরানের দিকে। ইরানের পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে ইরান চাইলে শিয়া জনগোষ্টী অধ্যুষিত প্রতিবেশি সব দেশে কম বেশি অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। এরমধ্যে ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা এবং ইসলামিক রিভোলিউশনারি গার্ড কর্পসের সিনিয়র কমান্ডার মুসলিম শাহদানকে সিরিয়া-ইরাক সীমান্তে বিমান হামলায় হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু কারা এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে তা জানা যাচ্ছে না।
একটি অজানা ধরনের বিমান এসে সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় দেইর এজ জোর প্রদেশে মুসলিম শাহদান ও তার ৩ দেহরক্ষীকে লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায়। কয়েকদিন আগেই ইরানের শীর্ষ পরমানু বিজ্ঞানী মোহসিন ফাখরিজাদেহও আততায়ীদের হাতে নিহত হন। এ প্রদেশটি দিয়েই ইরাক ও জর্ডানের মধ্যে বেশ কয়েকটি পাইপ লাইন ও বানিজ্য রুটও পরিচালিত হয়। যেটি এখন রাশিয়ার সমর্থন নিয়ে বাশার আল আসাদ নিয়ন্ত্রন করছে। ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াদের বড়ো একটি অংশও থাকে এ প্রদেশেই।
নভেম্বরের ২৭ তারিখ ইরানের শীর্ষ পরমানু বিজ্ঞানী মোহসিন ফাখরিজাদেহ নিহত হওয়ার পর ইসরাইলী মিডিয়ায় এ হত্যাকান্ডের ব্যাপক প্রশংসা করা হয়েছে। একজন ইসরাইলী কর্মকর্তা নিউইয়র্ক টাইমসকে এমনও বলেছেন যে, সারা বিশ্বের বরং ইসরাইলকে ধন্যবাদ দেয়া উচিত কারণ তারা ইরানের মতো সন্ত্রাসী দেশের শীর্ষ বিজ্ঞানীকে গিলে ফেলেছে।
ফাখরিজাদেহ’র এ হত্যাকান্ডের ঘটনা এমন একটি সময়ে ঘটলো যখন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু কয়েকটি আরব দেশ সফর করছেন।
ধারণা করা হচ্ছে, ইরানের সাথে উত্তেজনা বৃদ্ধি এবং সে উত্তেজনাকে কাজে লাগিয়ে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমীরাত থেকে বাড়তি সুবিধা পাওয়ার খায়েশ থেকেই ইসরাইল এ হত্যাকান্ডগুলো ঘটাচ্ছে। এসব হত্যাকান্ডের আরেকটি লক্ষ্য হতে পারে, ইরানকে সামরিক ভ‚মিকায় নিয়ে আসতে প্ররোচিত করা। তাহলে হয়তো ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রকেও ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক কোনো পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করতে পারবে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইল যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে তা চূড়ান্ত পরিণতিতে ইসরাইলের ওপর ক্ষতিকারক প্রভাবই ফেলবে। আপাতদৃষ্টিতে ইসরাইল এভাবে গুপ্ত হত্যা চালিয়ে সাময়িক লাভ হলেও র্দীঘমেয়াদে এর জন্য ইসরাইলকে চড়া মাসুলও দিতে হতে পারে। আর্ন্তজাতিকভাবে ইসরাইলের জন্য তা সুখকর হবে না।
এ ধরনের হত্যাকান্ডের তীব্র সমালোচনা করছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। জাতিসংঘ ছাড়াও খোদ যুক্তরাষ্ট্রের নানা মহলেও এসব হত্যাকান্ডকে কেউ ইতিবাচকভাবে দেখছে না। ইসরাইলী শীর্ষ কর্মকর্তা এবং ইসরাইলী মিডিয়া কেউই বুঝতে পারছে না যে, এসব গুপ্তহত্যা ইসরাইলের বিষয়ে বিশ্বজুড়ে একটি নেতিবাচক ভাবমুর্তি তৈরি করছে। ইসরাইল তার বৈদেশিক নীতি বাস্তবায়নে অন্যায় করতেও দ্বিধাবোধ করে না পশ্চিমারা এই সত্য এখন অনুধাবন করতে পারছে।
সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত উভয়দেশই সাম্প্রতিক সময়ে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করেছিল। সে সম্পর্ককে আরো এগিয়ে নেয়ার সুযোগ ছিল ইসরাইলের। কিন্তু একদিকে যখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ইসরাইলকে সমর্থন দেয়া নিয়ে তীব্র জনরোষের মুখে আছে ঠিক তখুনি গুপ্ত হত্যা মিশনে নামায় শেষ পর্যন্ত গোটা মধ্যপ্রাচ্যেই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে এমনও হতে পারে, কাগুজে চুক্তিতে ইসরাইলের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়লেও ইসরাইলকে এ দেশগুলোর পক্ষে কখনোই হয়তো আপন করে নেয়া সম্ভব হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এ গুপ্তহত্যা নিয়ে এখনো কোনো কথা বলেননি। কিন্তু তার ঘনিষ্টজনেরা বিশেষ করে সাবেক ওবামা প্রশাসনের নিরাপত্তা কর্মকর্তা ব্রেনান ইসরাইলের সমালোচনা করেছেন। ধারনা করা হচ্ছে, বাইডেনের পক্ষে ইরানের সাথে পরমানু চুক্তিতে ফিরে যাওয়ার সুযোগ আরো বেড়ে গেলো। ইসরাইলের এ জাতীয় হঠকারী ভূমিকার কারণে ইরানের বিরুদ্ধে কৌশুলী যুদ্ধে যাওয়ার চেয়ে হয়তো কুটনৈতিক সমাধানের দিকেই বাইডেনকে এখন যেতে হবে। সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ফাখরিজাদেহকে হত্যা করার পরিণতিতে ইরান তার পরমানু প্রকল্পও বন্ধ করবে না। উল্টো ইসরাইলের এসব নৃশংস হত্যাকান্ড ইরানকে এ কাজে আরো উৎসাহিত করতে পারে।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে