১৩ মুসলিম দেশের ভিসা স্থগিত, ইসরাইলের মিশন বাস্তবায়নে আমিরাত

কয়েক মাস আগেও ইসরাইলের ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা ছিল আরব আমিরাতের, সে পথ থেকে ইউটার্ন নিয়ে দেশটি এখন ইসরাইলের অবৈধ বসতি স্থাপনের পক্ষে সক্রিয় হবে - ইন্টারনেট

  • মুরশিদুল আলম চৌধুরী
  • ১০ ডিসেম্বর ২০২০, ০৭:২৭

সংযুক্ত আরব আমিরাতে মুসলিমদের প্রবেশ কি ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে? দৃশ্যত, তাই। খবরে বলা হয়েছে, ১৩টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের নাগরিকদের ওয়ার্ক ও ভিজিট ভিসা স্থগিত করেছে দেশটি। কেউ বলছেন, কোভিড-১৯ কে ঘিরে এ সিদ্ধান্ত। কেউ বলছেন, সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের প্রেক্ষিতে দেশটির নিরাপত্তা রক্ষায় এ কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আসল কারণ কী?

মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলকে ঘিরে রাজনীতির যে নতুন মেরুকরণ তৈরি হয়েছে, তাতে কোভিড কিংবা নিরাপত্তা ইস্যুকে সাদামাটা কারণ হিসেবে বিবেচনা করছেন অনেকে। তাহলে কি ইসরালের স্বার্থ রক্ষায় তাদের চাওয়া অনুযায়ী এ সিদ্ধান্ত? বার্তা সংস্থা রয়টার্স আরব আমিরাতের অভিবাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি প্রতিবেদনের সূত্র ধরে ভিসা স্থগিতের এই খবরটি দিয়েছে । বাণিজ্যিক অঞ্চলে সক্রিয় সব কোম্পানির কাছে এমন নির্দেশমূলক নথি পাঠানো হয়।

১৩টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের নাগরিকদের নতুন ভিসা প্রদানের ওপর স্থগিতাদেশ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তটিকে সাময়িক পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ‘বিজনেস পার্ক’-এর মাধ্যমে রয়টার্স যে নথিটি পেয়েছে, তাতে জানা গেছে, গত সপ্তাহ থেকে সিদ্ধান্তটি কার্যকর হয়েছে। অনেকটা হঠাৎ করেই ভিজিট ভিসা বন্ধ করেছিল দেশটি। নতুন ঘোষণায় নিশ্চিত হওয়া গেছে, এমপ্লয়মেন্ট ভিসাও বন্ধ করা হয়েছে। এমপ্লয়মেন্ট ভিসা কেন বন্ধ করা হলো, সংবাদমাধ্যমের ভাষায় তা ‘অজানা’।

যেসব দেশের নাগরিকদের জন্য ভিসা বন্ধের সিদ্ধান্ত এসেছে, সেগুলো হলো- ইরান, তুরস্ক, সোমালিয়া, আলজেরিয়া, কেনিয়া, ইরাক, লেবানন, পাকিস্তান, তিউনিসিয়া, আফগানিস্তান, লিবিয়া ও ইয়েমেন। দেশগুলোর কোনো নাগরিক বিশেষ বিবেচনায় নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে থাকবেন কিনা সেটা স্পষ্ট নয়। এ ব্যাপারে দেশটির ফেডারেল অথরিটি ফর আইডেন্টিটি অ্যান্ড সিটিজেনশিপ তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছে।

যেদিন আরব আমিরাতের ইমিগ্রেশন থেকে অনানুষ্ঠানিক এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়, সেদিনই পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, কোভিড-১৯ এর প্রেক্ষাপটে পূর্বসতর্কতা হিসেবে ভিসা প্রক্রিয়া বন্ধের সিদ্ধান্ত এসেছে বলে তারা মনে করছে। এদিকে, আমিরাতের নথিতে দেখা গেছে, নিরাপত্তাজনিত কারণেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ভিসা স্থগিতের বিষয় নিয়ে সরকারি তরফে আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি আসেনি। ফলে সন্দেহের আবর্তে ঘুরছে সিদ্ধান্তটি। এর পেছনে আঞ্চলিক রাজনীতি কিংবা মার্কিন প্রশাসনে ক্ষমতার পালাবদলও কাজ করতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। হঠাৎ লুকোচুরি করে নেওয়া এ সিদ্ধান্তের কারণে ওই ১৩ দেশের সঙ্গে দেশটির কূটনৈতিক সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটা এখন বেশ বড় বিষয়।

যে দেশগুলো নিয়ে এ সিদ্ধান্ত এলো, এসব দেশের বিপুল নাগরিক বাস করেন আরব আমিরাতে। বিশেষ করে, পাকিস্তান, ইরান, সিরিয়া, লেবানন ও আফগানিস্তানের বিপুল নাগরিক রয়েছেন সেখানে। তালিকায় থাকা অন্য দেশগুলোর নাগরিকের সংখ্যাও কম নয়।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যখন জানাল যে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বা পরে তাদের বিষয়টি জানানো হয়নি, তখন দেশগুলোতে কিংবা বহির্বিশে^ আরব আমিরাতের এ কঠোরতা নিয়ে কী কূটনৈতিক বার্তা পৌঁছাল?

কেউ কেউ মনে করেন, গত মাসে সৌদি আরবে সংঘটিত দুটি হামলার প্রেক্ষাপটে এটি একটি পূর্বসতর্কতামূলক পদক্ষেপ। অতিসম্প্রতি সেখানে ফ্রান্স দূতাবাস আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে গ্রেনেড হামলাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অবশ্য, হামলাকারীর পরিচয় এখনও জানা যায়নি।

এর আগের ঘটনাও ঘটেছে ফ্রান্সের নাগরিকদের লক্ষ্য করে। ইসলাম নিয়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাকোঁর বিতর্কিত মন্তব্যকে কেন্দ্র করে এ হামলা ঘটে থাকতে পারে। এ ঘটনায় হামলাকারী ছিলেন এক সৌদি নাগরিক।

এ সাময়িক স্থগিতাদেশের পেছনে আরো বড় একটি ইস্যু কাজ করতে পারে। সেটা হলো, ইসরাইলের সঙ্গে আরব আমিরাতের নতুন সম্পর্ক। টাইমস অব ইসরাইলের ভাষ্যমতে, এ সপ্তাহের শেষের দিকে ইসরাইলের নাগরিকদের আরব আমিরাতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে। দেশ দুটি ভিসা ওয়েবার প্রোগ্রামে সম্মত হয়েছে, যার অধীনে এক দেশের নাগরিক অন্য দেশে ভিসা ছাড়াই প্রবেশ করতে পারবে।

চুক্তি অনুযায়ী প্রোগ্রামটি শিগগির কার্যকর হবে। অনেকে অবাক হয়েছেন যে, আরব আমিরাত ইসরাইলের সঙ্গে এমন একটি চুক্তি করেছে, যা ইসরাইলের সবচে ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রও করেনি। যে ১৩টি দেশের বিরুদ্ধে এ সাময়িক নিষেধাজ্ঞা এলো, তাদের ১১টি দেশই ইসরাইলের সঙ্গে আরব আমিরাতের ঘনিষ্ঠ মিত্রতার বিরুদ্ধে সরব; এ চুক্তির নিন্দা করেছেন । ইরান, লেবানন, তুরস্ক, ইরাক ও পাকিস্তানসহ কয়েকটি দেশ থেকে এ মিত্রতার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিবৃতিও এসেছে।

সম্পৃক্ত পক্ষগুলো কথিত ‘আব্রাহাম চুক্তিকে’ শান্তি প্রতিষ্ঠায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করলেও, বাস্তবতা হলো, এর মাধ্যমে এ অঞ্চলে উত্তেজনার নতুন অধ্যায় সূচিত হবে। রাজনৈতিক বিভাজন আরও তীব্র হবে। উপসাগরীয় অঞ্চল, আরব এবং বৃহত্তর মুসলিম বিশ্বে রাজনীতির নতুন মেরুকরণ তৈরি হবে।

স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য ফিলিস্তিনিদের আন্দোলনে মুসলিম বিশে^র সমর্থন জোরালো। ধর্মের বিষয়টিও এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মুসলিম দেশগুলোর জনগণও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে। ইসলামের পবিত্র স্থান আল-আকসা মসজিদকে কেন্দ্র করে মুসলিম বিশে^র যে ধর্মীয় অনুভব, কথিত ‘শান্তিচুক্তি’ এ মনোভাবকে আরও তীব্র করেছে।

সাম্প্রতিক এক খবরে জানা গেছে, আল-আকসা সফরের জন্য জেরুজালেমে প্রবেশকারী আরব আমিরাতের নাগরিকদের একটি দল ক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনিদের বাধার মুখে পড়েন। সেখানে এক পর্যায়ে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা এমন মন্তব্যও করেন যে, ‘আমরা আল-আকসা সফর করব। এটি শুধু তোমাদের নয়, সব মুসলিমের।’

এক অনলাইন বিতর্কে এক সৌদি আইনজীবী বলেন, ‘ফিলিস্তিনিদের হাত থেকে ভ্রমণকারীদের রক্ষা করতে আরব আমিরাত ও বাহরাইনের উচিত আল আকসা মসজিদকে স্বাধীন করার পথ বের করতে ইসরাইলের সঙ্গে আলোচনা করা। তিনি ফিলিস্তিনিদের হাত থেকে আল-আকসাকে স্বাধীন করার কথা বলেছেন। ফিলিস্তিনিদের ‘গুন্ডা’ বলেও অভিহিত করেন এ আইনজীবী।

ইসরাইলের মিশন বাস্তবায়নে আরব আমিরাত এবং সৌদি আরবের একটি গোষ্ঠি মাঠে নেমে পড়েছে। তারা ফিলিস্তিনিদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে ইসরাইলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে সাবলীল করার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। যা সহজে বোঝা যাচ্ছে।

এসব পরিকল্পিত মন্তব্যের বিপরীতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ থেকেও মন্তব্য এসেছে। তারা বলেছেন, আল-আকসা মসজিদকে নিয়ে ফিলিস্তিনিদের যে চাওয়া, তা নস্যাত করার জন্য আরব আমিরাত বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের পথে এগোচ্ছে।

রাজনৈতিক হোক, কিংবা নিরাপত্তাজনিত সাবধানতা হোক, অথবা দুটি বিষয়ই এর সঙ্গে জড়িত থাকুক, খুব সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, ১৩টি দেশের ভিসা স্থগিত করে আরব আমিরাত যে পথে এগোনোর চেষ্টা করছে, তা বড়সড় সমস্যার সৃষ্টি করবে। এছাড়া, ভিসা নিষিদ্ধ হওয়া দেশগুলোর সাধারণ মানুষের জন্যও এ সিদ্ধান্ত সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

কয়েক মাস আগেও ইসরাইলের ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা ছিল আরব আমিরাতের, সে পথ থেকে ইউটার্ন নিয়ে দেশটি এখন ইসরাইলের অবৈধ বসতি স্থাপনের পক্ষে সক্রিয় হবে। এর ফলে তাদের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক থাকা মুসলিম বিশ্বের মৈত্রিতে যে ফাটল ধরবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন দেখার বিষয় নতুন বন্ধুদের নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত কতদূর যেতে পারে? ইসরাইলের সাথে নতুন বন্ধনে ভর করে তারা কত পুরোন বন্ধুকে ত্যাগ করতে পারে?

মুসলিম দেশগুলো আশা করে , আরব আমিরাতের ১৩টি দেশের নাগরিকদের ভিসা স্থগিত করার এই সিদ্ধান্ত কেবলই একটি অস্থায়ী পদক্ষেপ হয়। এছড়া দেশটি যেনো মুসলিম বিশ্বের ওপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের ইচ্ছা থেকে যেনো এমন সিদ্ধান্ত নেয়া না হয়। কারন এর পরিণতি কোনো পক্ষের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে