ইরানি বিজ্ঞানী হত্যা : যুক্তরাষ্ট্র-ইরান আলোচনা কোন পথে

আগামী দিনে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার আলোচনার পট কীভাবে তৈরি হয়, দুই দেশের সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, বৈশ্বিক রাজনীতি কোনদিকে আবর্তিত হয়, তা দেখার জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে - ইন্টারনেট

  • মুরশিদুল আলম চৌধুরী
  • ১২ ডিসেম্বর ২০২০, ০৮:১৯

ইরানের শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফখরিযাদেহ আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যেকার কূটনীতি ফের শুরু করা যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জন্য বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়াল। ২০ জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাওয়া বাইডেন বলেছিলেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ২০১৫ সালে করা আন্তর্জাতিক চুক্তিতে ফিরে যেতে চান তিনি। ইরানি পরমানু বিজ্ঞানী হত্যকান্ডের কারন ও পরবর্তী পরিস্থিতি কেমন হতে পারে আজ জানাবো সেই বিশ্লেষন।

ফখরিযাদেহকে হত্যার পেছনে করা, তা পরিষ্কার না হলেও ইরানি কর্মকর্তারা ইসরাইলের দিকেই আঙ্গুল তুলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ইসরাইলই ইরান সরকারের বিরুদ্ধে ট্রাম্পকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে উৎসাহ যুগিয়েছিল। মার্কিন থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক কুইন্সি ইনস্টিটিউটের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ত্রিতা পার্সির ভাষায়, ‘ভেবে দেখুন, ইসরাইল কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইরান যদি এমন কিছু করত, তাহলে তাদেরকে আলোচনায় বসানো সম্ভব হতো কিনা।’

পার্সি বললেন, ‘ফাখরিযাদেহ হত্যাকান্ড ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য ‘উইন-উইন’ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এখন ইরান সরকার যদি এ নিয়ে প্রতিশোধের পথে যায়, তাহলে নেতানিয়াহু ওয়াশিংটনকে তেহরানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারেন। আর, ইরান যদি সংযমও প্রদর্শন করে, নেতানিয়াহু এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করলেন, যাতে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতি আরও জটিল রূপ ধারণ করল।’

গত ১০ বছরে পাঁচ ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানী হত্যার সঙ্গে জড়িত বলে যে দেশকে অভিযুক্ত করা হয়, সেই ইসরাইল ফখরিযাদেহ হত্যাকান্ড নিয়ে তাৎক্ষণিক মন্তব্য করেনি।

এক দশকে যে পাঁচজন ইরানি বিজ্ঞানি গুপ্তহত্যার শিকার হন, তাদের মধ্যে আছেন মাসুদ আলিমোহাম্মাদি। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে নিহত এ বিজ্ঞানী তেহরান ইউনিভার্সিটির পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। মটরসাইকেলে লাগানো রিমোট কন্ট্রোল বোমায় হত্যা করা হয় তাকে।

এর ১১ মাস পর দেশটির আণবিক শক্তি সংস্থার বড় একটি প্রকল্প তত্ত্বাবধানকারী বিজ্ঞানী মাজিদ শাহরিয়ারিকে হত্যা করা হয়। বোমাসংযুক্ত একটি মটরসাইকেল নিয়ে হামলাকারী শাহরিয়ারির গাড়িতে আঘাত করে, এ বিস্ফোরণে নিহত হন তিনি।

২০১১ সালের জুলাইয়ে গুপ্তহত্যার শিকার হন আরেক ইরানি বিজ্ঞানী দারিয়ুশ রেজাইনেজাদ। এক শনিবার বিকালে মটরসাইকেলে চড়ে দুই বন্দুকধারী রেজাইনেজাদকে লক্ষ্য করে মুহূর্মুহূ গুলি ছুড়তে থাকে। এতে তার বুক ঝাঁজরা হয়ে যায়।

এরপর এক বছর সময়ও পার হয়নি। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে পরবর্তী গুপ্তহত্যার টার্গেট হন মোস্তাফা আহমাদি রোশান। এবারও হামলার বাহন মটরসাইকেল। ম্যাগনেটিক বোমা নিয়ে রোশানের গাড়ির ওপর উঠে যায় হামলাকারী। নিহত হন ওই বিজ্ঞানী ও তার গাড়িচালক। তেহরানের টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ছিলেন তিনি। নাতাঞ্জের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্লান্টের দেখভাল করার দায়িত্ব ছিল তার।

সর্বশেষ হত্যার শিকার হলেন শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফখরিযাদেহ। ফখরিযাদেহ ছিলেন সর্বাধিক খ্যাতিমান ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানী এবং অভিজাত ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কোরের সিনিয়র অফিসার। তার ব্যাপারে পশ্চিমা গোয়েন্দা সূত্রগুলো দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে যে, ফখরিযাদেহ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির অত্যন্ত শক্তিশালী এবং সহায়ক একজন ব্যক্তি।

২০১৮ সালে ইসরাইলের কাছ থেকে পাওয়া গোপন নথি অনুযায়ী, তিনি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির একটি কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সে সময় ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বিনইয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, তিনি ফখরিযাদেহকে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির প্রধান বিজ্ঞানী বলে মনে করেন এবং তার ‘এই নামটি মনে রাখার’ আহŸান জানিয়েছিলেন তিনি।

২০১৫ সালে, নিউইয়র্ক টাইমস তাকে তুলনা করেছিলেন জে রবার্ট ওপেনহেইমারের সঙ্গে, এই পদার্থবিজ্ঞানী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ম্যানহাটন প্রকল্পের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তৈরি করেছিলেন প্রথম পারমাণবিক অস্ত্র।
ফখরিযাদেহ ‘আমাদ’ প্রকল্পের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। এটি ছিল ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি গোপন কর্মসূচি, যেখানে পারমাণবিক বোমা তৈরির সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা হতো।

কুইন্সি ইনস্টিটিউটের ত্রিতা পার্সি বললেন, ‘নেতানিয়াহুর দিক থেকে যদি বলি, ফখরিযাদেহ হত্যার মাধ্যমে তিনি বাইডেনকে কিছুটা হলেও খাটো করতে পেরেছেন। সে অর্থে, বাইডেনই এ হত্যাকান্ডে টার্গেট।’

ইরানকে রুখতে নেতানিয়াহুর দৃঢ় সংকল্প, যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পালাবদল এবং ইসরাইলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর নতুন বন্ধুত্বের প্রেক্ষাপটে এ হত্যাকাÐের খবর বেশ গুরুত্ব বহন করে।

২০১৫ সালে ছয়টি বিশ্বশক্তির সাথে এক চুক্তিতে ইরান তাদের ইউরেনিয়ামের উৎপাদন সীমাবদ্ধ করার কথা বলেছিল। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার পর, ইরান চুক্তির শর্তগুলো মানছিল না পশ্চিমাদের অভিযোগ।

ইসরাইলের দীর্ঘদিনের বিরোধিতার পরও জো বাইডেন জানুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ইরানের সঙ্গে পুনরায় যুক্ত হওয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষরা এ হত্যাকান্ড নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। তারা বলছেন, ইরান এবং মধ্যপ্রাচ্যে তার মিত্রদের অস্থিতিশীল করতে প্রশাসনের শেষ সপ্তাহগুলোতে মরণ কামড় দিতে পারেন ট্রাম্প। তার অফিস ছাড়ার পর বাইডেন প্রশাসন যাতে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে, এর চেষ্টা করে যাবেন তিনি। ফখরিযাদেহ হত্যাকান্ডের সঙ্গে এর যোগসূত্রকে তাই বড় করেই দেখা হচ্ছে।

বাইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হতে যাওয়া টনি বিøঙ্কেন আগস্টে এক সম্মেলনে বলেছিলেন, তিনি আশা করেন, ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু চুক্তির যে নবায়ন করতে যাচ্ছে, তা হবে ‘সুদৃঢ় এবং দীর্ঘস্থায়ী’। কিন্তু, এ হত্যাকাÐ অনেক কিছুই বদলে দিতে পারে।

এমন পরিস্থিতিতে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্ক মেরামত করতে হলে বাইডেনকে দ্রুত কূটনীতি শুরু করতে হবে, অবরোধ তুলে নিতে হবে এবং দ্রুত পরমাণু চুক্তিতে ফিরে যেতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানি কর্মকর্তারা আশা করেছিলেন, আরও কিছু বিষয়, যেমন ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, আঞ্চলিক রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করবেন। কিন্তু ফখরিযাদেহ হত্যাকান্ডটি সবকিছুকে জটিল করে দিল। মনে হয়েছিল, ইরানিরা আপসের টেবিলে খোলা মন নিয়ে বসবেন। কিন্তু সবকিছু ভেঙেচুরে গেল।

এদিকে, পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেছেন, এ ঘটনা তাদের দেশের পরমাণু কর্মসূচির গতি ধীর করতে পারবে না।

হাসান রুহানি বলেন, এই হত্যাকান্ডে ইরানের শত্রুদের গভীর ‘ঘৃণা ও হতাশা’ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

রাষ্ট্রীয় টিভিতে প্রচারিত এক বিবৃতিতে রুহানি ‘ইহুদিবাদী শাসকচক্রের রক্তরঞ্জিত অশুভ হাতের’ উপমা দেন, যা সাধারণত ইসরাইলকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।

দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সামরিক উপদেষ্টা হোসেইন দেঘান বলেছেন, এই হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের ওপর বজ্রের মতো আঘাত হানা হবে।

ফখরিজাদেহ হত্যাকান্ড নিয়ে ট্রাম্প কিংবা বাইডেন সরাসরি মন্তব্য করেননি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) সাবেক প্রধান জন ব্রেনান বলেছেন, ওই বিজ্ঞানীর হত্যাকান্ড একইসঙ্গে ‘অপরাধমূলক’ এবং ‘অত্যন্ত বেপরোয়া’, যা ওই অঞ্চলে সংঘাতের ঝুঁকি তৈরি করেছে।

একাধিক টুইটে জন ব্রেনান বলেছেন, ফখরিযাদেহ-এর মৃত্যু নতুন করে আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব উস্কে দেওয়ার পাশাপাশি প্রাণঘাতী লড়াইয়ের ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেছেন, ইরানি নেতাদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে দায়িত্বশীল আমেরিকান নেতৃত্ব কী করছে, তা দেখা পর্যন্ত অপেক্ষা করা। সময়টা যখন উত্তেজনায় ঠাসা, তখনই এ হত্যাকান্ড সংঘটিত হলো।

যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ট্রাম্প তার সিনিয়র উপদেষ্টাদের বলেছিলেন অফিস ছাড়ার আগে নাতান্জের পরমাণু গবেষণা স্থাপনায় হামলার উপায় খুঁজে বের করতে। তখন ইরান সরকারের মুখপাত্র সতর্ক করে বলেছিলেন, ইরান হামলার শিকার হলে ভয়াবহ জবাব দেওয়া হবে।

২১ নভেম্বর ইউএস সেন্ট্রাল কমান্ড জানায়, আগ্রাসন প্রতিহত করতে এবং মিত্রদের আশ্বস্ত করতে মার্কিন বিমানবাহিনী নর্থ ডেকোডা ঘাঁটি থেকে দূরপাল্লার বি-৫২ বোমারু বিমান পাঠিয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশে। এখন এবং বাইডেন প্রশাসনের মধ্যবর্তী সময়টাতে প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষেত্রে ইরান নমনীয় হতে পারে, কারণ, তারা মনে করবে, এতে করে নাতান্জে ট্রাম্প একতরফা হামলা চালাবে। ইসরাইলিরা হিসাব-নিকাশ করে দেখেছে, এ ধরনের হামলার জন্য এটাই সুবিধাজনক সময়। কিন্তু এই ঘটনার পর আগামী কয়েকটা মাস হয়ে উঠবে বেশ উত্তেজনাকর।’

আগামী দিনে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার আলোচনার পট কীভাবে তৈরি হয়, দুই দেশের সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, বৈশ্বিক রাজনীতি কোনদিকে আবর্তিত হয়, তা দেখার জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে