সময়টা এখন খুবই খারাপ যাচ্ছে সৌদি শাসকদের। একের পর এক ছায়াযুদ্ধে তুরস্কের সাফল্যে চাপে পড়েছে সৌদি নেতৃত্বাধীন উপসাগরীয় দেশগুলো। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনের বিজয় সৌদি রাজপরিবারের জন্য বিনা মেঘে বজ্রপাত। এমন পরিস্থিতিতে সৌদি সরকার আঞ্চলিক শক্তি তুরস্কের সঙ্গে তিক্ততার অবসান ঘটিয়ে উষ্ণ সম্পর্ক গড়তে চাইছে। বিপরীত মেরুতে অবস্থানরত দুই দেশের বৈরিতার অবসান ঘটার সম্ভাবনা কতটা।
অনেকটা নাটকীয়ভাবেই গত ২০ নভেম্বর সৌদি বাদশাহ সালমান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোয়ানকে টেলিফোন করেন। এ সময় বাদশা সালমান দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনের উপায় নিয়ে আলোচনা করেন। এর কয়েকদিন পরই নাইজারে ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকের ফাকে মিলিত হন সৌদি ও তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তারাও সম্পর্ক উষ্ণ করার বার্তা দেন। এর কয়েক দিন পরই সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
এসব ঘটনায় বিশ্লেষকরা মনে করছেন , সৌদি আরব অবশেষে তুরস্কের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বৈরিতার অবসান চাচ্ছে। তবে এটা সৌদি শাসকদের শুভবোধের প্রতিফলন নয়। বস্তুত তাদের নিষ্ঠুর রাজতান্ত্রিক শাসন টিকিয়ে রাখার জন্যই সৌদিকে আপোষের পথে যেতে হচ্ছে।
গত কয়েক বছরে মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বে সৌদি আরবের প্রভাব ও শক্তি লক্ষ্যণীয়ভাবে কমেছে। এর শুরুটা হয়েছিল মিশরের প্রথম নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতে তাদের সর্বাত্মক সমর্থনদানের মাধ্যমে। সেখানে একটি বর্বর স্বৈরাচারী সরকারের সবচেয়ে পৃষ্টপোষক সৌদি রাজ পরিবার। এতে মুসলিম বিশে^ সৌদি আরবের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়। এরপর সৌদি রাজপরিবার একের পর এক ভুলের চোরবালিতে পা রেখেছে।
সৌদি রাজপরিবার অবরোধ চাপিয়ে দিয়েছে কাতারের ওপর। সৌদি আগ্রাসনে দারিদ্রপীড়িত ইয়েমেন পরিনত হয়েছে নরকপুরীতে। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নির্দেশে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে হত্যা করা হয় প্রখ্যাত সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে।
সৌদি শাসকদের অপরিনামদর্শী কর্মকান্ড এখানেই শেষ নয়। আগের অবস্থান পাল্টে সিরিয়ায় আসাদ সরকারকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে রিয়াদ। লিবিয়ার যুদ্ধবাজ নেতা খলিফা হাফতারেরও অন্যতম পৃষ্টপোষক সৌদি সরকার। সর্বশেষ ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিকে কবর দিয়ে সৌদির মদতে তিনটি দেশ সম্প্রতি ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে।
এসব প্রতিটি ঘটনার বিপরীত মেরুতে রয়েছে তুরস্ক। কার্যত তুরস্কের কূটনীতি আর সমরনীতির কাছে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে সৌদি সমর্থক গোষ্ঠীগুলো। সৌদি রাজপরিবারের ওপর সর্বশেষ আঘাত এসেছে যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পালাবদল। এ অবস্থায় যুদ্ধংদেহী পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হচ্ছে সৌদি সরকার।
জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যার বদলা নেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। তিনি সৌদির সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের কথা বলেছেন। ইয়েমেনে সৌদি আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন বাইডেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেটও সৌদি আরবকে ছাড় দেবেন না। তিনি ইরানের পরমাণু চুক্তির ঘোর সমর্থক। ওয়াশিংটনের নতুন এই নেতৃত্ব সৌদি রাজপরিবারের, বিশেষ করে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বা এমবিএসের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। কারণ সৌদি পররাষ্ট্রনীতি আমূল বদলে দেওয়ার মূল হোতা তিনি। তুরস্কেও সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানের জন্য তিনিই দায়ী। এমন পরিস্থিতিতে এরদোয়ানকে ফোন করে বাদশা সালমান দুই দেশের মধ্যে সংলাপের পথ উন্মুক্ত রাখার ওপর জোর দেন।
সৌদি আরব ও তুরস্কের মধ্যে এতটা বৈরি সর্ম্পক সাম্প্রতিক সময়ে ছিলো না। এমনকি সিরিয়ায় আসাদ সরকারকে উৎখাতে দুই দেশ একযোগে কাজও করেছে। তবে এমবিএস সেখান থেকে সরে যান। এরপর কাতারের সঙ্গে সৌদি আরবের বিরোধে তুরস্ক প্রকাশ্যে কাতারের পক্ষে অবস্থান নেয়। অবরোধ মোকাবিলায় শুধু সাদ্য সাহায্য নয় সামরিক সাহায্য পাঠায়। স্থাপন করে সামরিক ঘাটি। তুরস্কের কারণে কাতার দখলে সৌদি আরবের পরিকল্পনা ভন্ডুল হয়ে যায়।
তুরস্কের জোরালো অবস্থানের কারনে সৌদি নেতৃত্বাধীন দেশগুলো বিরোধপূর্ন দেশগুলোর কোথাও সুবিধে করতে পারেনি। ক্ষুদ্ধ সৌদি আরব শেষ পর্যন্ত তুর্কি পণ্য বয়কটের মত অবিমৃশ্যকারী কাজ করে বসে। তুরস্কের বিরুদ্ধে সৌদি জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলারও চেষ্টা করেছেন যুবরাজ। এর অংশ হিসেবে সৌদি গণমাধ্যমে তুর্কি বিরোধী প্রপাগান্ডা চালানো হয়। উসমানীয় খেলাফতের সমালোচনা করে সৌদির পাঠ্যপুস্তকে একে উসমানীয় দখলদারিত্ব হিসেবে বর্ণনা করা হয়। অথচ উসমানীয় খেলাফত নিয়ে বেশিরভাগ মুসলিমই গর্ববোধ করেন। একই সাথে সৌদি যুবরাজ ইসলামের পবিত্রভূমিকে পাশ্চাত্যের ভাবধারায় নিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। এসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে সৌদি আরবের অর্থনৈতিক মন্দা।
সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মত সালমানের নীতির কারনে দেশের ভেতরে ও আন্তর্জাতিক পরিমÐলে সৌদি সরকার নানামুখী চাপে পড়তে হচ্ছে। খোদ সৌদি রাজতন্ত্র অনেকটা বিপন্ন হওয়ার ঝুকিতে রয়েছে। এখন নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই সৌদি আরবকে নমনীয় নীতি গ্রহন করতে হচ্ছে। তুরস্কের সাথে সর্ম্পক ঘনিষ্ট করার প্রচেষ্টা এর অংশমাত্র।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন উচ্চাকাঙ্খী ও হটকারী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে বিশ্বাস করা তুরস্কের পক্ষে কঠিন। যুবরাজের এই অবস্থান বদল কোনো আদর্শিক পরিবর্তনের ফল নয়, নেহাতই স্বার্থতাড়িত। ফলে তুরস্ক সন্দেহমুক্ত হতে পারছে না। এ কারণে আঙ্কারা সৌদিও সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করতে পারে।
তুরস্কের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, সৌদি বাদশা ফোন দিলেও সম্পর্কের নতুন অধ্যায় এখনই শুরু হচ্ছে না। আমাদেরকে দেখতে হবে তারা কোথায় যেতে চায়। তবে তুরস্ক চাচ্ছে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে।
তুরস্কের সঙ্গে সৌদির এই বিরোধ শুরু হয়েছিল আরব বসন্তের পর থেকেই। তখন এরদোয়ানের গণতান্ত্রিক সরকার বিপ্লবীদের সমর্থন দেয়। অন্যদিকে সৌদি সরকার পক্ষ নেয় প্রতি বিপ্লবীদের।
এখন সৌদি আরব তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ করতে চাইলে মুসলিম ব্রাদারহুডের ব্যাপারে রিয়াদকে অবস্থান বদলাতে হবে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ইসলামী সংগঠনকে সৌদি সরকার সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করেছে। যদি পাশ্চাত্যের কোনো দেশেই মুসলিম ব্রাদারহুড সন্ত্রাসী সংগঠন নয়। অন্যদিকে তুরস্ক ও তার মিত্র কাতার মুসলিম ব্রাদারহুডের বড় পৃষ্টপোষক।
অনেকে মনে করেন, মুসলিম ব্রাদারহুড সৌদি রাজতন্ত্র উৎখাতের চেষ্টা করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিলে রিয়াদ তাদের ব্যাপারে অবস্থান বদলাতে পারে। আরব বসন্তের এরকম সমঝোতাই ছিল।
তবে এটা স্পষ্ট যে এরদোয়ান সরকার মুসলিম ব্রাদারহুডের ব্যাপারে পিছু হটবে না। অন্যদিকে বাইডেন প্রশাসন আরব দুনিয়ায় গণতন্ত্র বিকাশের উদ্যোগ নিলে মুসমিল ব্রাদারহুডকে বাদ দেওয়া সম্ভব নয়।
নানা ইস্যুতে সৌদি আরবের বিপরীত মেরুতে থাকালেও তুরস্ক চাইবে রিয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ হোক। নাইজারে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগ্লু এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তুরস্ক ও সৌদি আরবের সম্পর্ক উষ্ণ হলে তা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার পক্ষে সহায়ক হবে।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, সৌদি -তুরস্কের সম্পর্ক উন্নয়নে বাধা হয়ে দাড়াতে পারে সংযুক্ত আরব আমিরাত। এক সময় আমিরাত সৌদির অনুগত হলেও এখন ব্যাপারটা ঠিক উল্টো বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ বা এমডিজেড আসলে সৌদি যুবরাজের বড় পরামর্শক।
আমিরাতের পররাষ্ট্রনীতি এখন সৌদি আরবের চেয়েও বেশি আগ্রাসী এবং আরও বেশি তুর্কিবিরোধী। আমিরাত চাইবে না, সৌদি-তুর্কি সম্পর্ক উষ্ণ হোক। আমিরাত তুরস্কের পাশাপাশি কাতারেরও ঘোর বিরোধী।
আমিরাতের প্রভাবশালী কূটনীতিক ইউসুফ আল ওতাইবা সম্প্রতি ইসরাইলি টিভিকে বলেছেন, তুরস্ক ও কাতারের সঙ্গে সৌদি জোটের সঙ্গে বৈরিতা খুব তাড়াতাড়ি মিটবে বলে তিনি মনে করেন না।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, আমিরাতের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন রাজনৈতিক ইসলামের উত্থানকে দমন করে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদেও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। তাদের এ লক্ষ্য পূরণের পথে বাধা তুরস্ক ও কাতার। তবে শেষ পর্যন্ত সৌদি-তুরস্কের সম্পর্কে উন্নতি হলে আমিরাত তা মেনে নিতে বাধ্য হবে।
মধ্যপ্রাচ্য গবেষক জনাথন ফেন্টন হার্ভে এক নিবন্ধে লিখেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা ফেরাতে চাইলে বাইডেন প্রশাসনকে আমিরাতের ব্যাপারেও কঠোর মনোভাব দেখাতে হবে। পর্দার আড়ালে এ ধরনের নানামুখী বাধা সত্বেও সৌদি আরবের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক জোরদার হতে পারে। তবে এ কথাও সত্য যে এরদোয়ান তার দেশের স্বার্থ রক্ষা এবং আঞ্চলিক দাবি আদায় না করে রিয়াদেও সঙ্গে মাখামাখিতে যাবেন না।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এমরি কালিসকান মনে করেন , এরদোয়ানও সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে চাচ্ছেন। আরব বসন্তের আগে দুই দেশের সম্পর্ক খুবই ভালো ছিল। এখন দুই দেশকেই ভিন্ন এজেন্ডার মধ্যে একযোগে কাজ করা শিখতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে এরদোয়ান হচ্ছে বাস্তববাদী নেতার সেরা উদাহরণ।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে