ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি তার ছেলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন বলে খবর ছড়িয়ে পড়েছে। বলা হচ্ছে খামেনি প্রোস্ট্রেট ক্যান্সারে ভুগছেন। এ খবরে মধ্যপ্রাচ্যে ভূ-কম্পন শুরু হয়েছে। আসলেই খামেনি কী ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছেন? ইরানে কিভাবে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে এবং খামেনির উত্তরসূরি কে হতে পারেন?
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম ক্ষমতাশালী ও গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ ইরানে ৮১ বছর বয়সী খামেনি তিন দশক ধরে রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষে আছেন। তার নেতৃত্বে ইরান একটি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। কাজেই তার উত্তরসূরি কে হতে যাচ্ছেন, সেটা ইরানের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ। তেমনি তা গোটা অঞ্চল এবং বাকি বিশ্বের জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের কিছু গণমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে খামেনি মারা গেছেন এবং তিনি তার ছেলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন। ইরানের একজন সাংবাদিক এ ধরনের টুইট করার পর তাই হয়ে দাঁড়ায় এসব খবরের উৎস। তবে খামেনির মৃত্যু ও পদ ছেড়ে দেওয়ার খবর বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি কারো কাছে। অবশ্য খামেনি অনেক দিন ধরে অসুস্থ। তাকে জনসমক্ষে দেখা যাচ্ছে না। তবে ইরান সরকার দাবি করেছে, তিনি সুস্থ আছেন।
ইরানে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার পদে কে থাকবেন তা নির্ধারণ করেন বিশেষজ্ঞমÐলী বা অ্যাসেম্বলি অফ এক্সপার্টস নামে ৮৮ জন ধর্মীয় নেতার একটি পরিষদ। ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর খামেনি দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার পদে আসীন দ্বিতীয় ব্যক্তি। ১৯৮৯সাল থেকে তিনি এ পদে আছেন।
এই বিশেষজ্ঞমন্ডলী সদস্যদের নির্বাচন করা হয় প্রতি আট বছর পরপর। কিন্তু কারা এর সদস্য পদের জন্য প্রার্থী হতে পারবেন তা নির্ভর করে দেশটির গার্ডিয়ান কাউন্সিল নামে একটি কমিটির অনুমোদনের ওপর। আর এই গার্ডিয়ান কাউন্সিলের সদস্যদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্বাচন করেন দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা।
এই দুটি পরিষদ বা মন্ডলীর ওপর সর্বোচ্চ নেতার প্রভাব থাকে। গত তিন দশক ধরে খামেনি নিশ্চিত করেছেন যে বিশেষজ্ঞ মন্ডলীর নির্বাচিত সদস্যরা যেন রক্ষণশীল হয় - যারা তার উত্তরসূরি নির্বাচনের সময় তারই নির্দেশ মেনে চলবে। ইরানের প্রভাবশালী বিশেষজ্ঞ মন্ডলী সর্বোচ্চ নেতাকে নিয়োগ করেন এবং তাকে অপসারণের ক্ষমতাও তাত্তি¡কভাবে তাদেরই হাতে। নির্বাচিত হবার পর, সর্বোচ্চ নেতা তার পদে আজীবন বহাল থাকতে পারেন।
ইরানের সংবিধান অনুযায়ী, সর্বোচ্চ নেতা হতে হবে একজন আয়াতুল্লাহকে, অর্থাৎ যিনি একজন শীর্ষস্থানীয় শিয়া ধর্মীয় নেতা। কিন্তু খামিনিকে যখন নির্বাচন করা হয়েছিল, তিনি আয়াতুল্লাহ ছিলেন না। তিনি যাতে এই দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন, সে সময় তার জন্য আইন পরিবর্তন করা হয়।
কাজেই প্রয়োজনে আইন আবার পরিবর্তন করা সম্ভব। যখন নতুন নেতা নির্বাচনের সময় আসবে, তখন রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে আইন পরিবর্তনের রাস্তা খোলা রয়েছে।
ইরানে চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা বা আয়াতুল্লাহ। দেশটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে তার নির্দেশই শেষ কথা। দেশটির নীতিমালার রূপকার তিনি, বর্হিবিশ্বের সাথে ইরানের সম্পর্কের মূল নির্দেশকও তিনি। দেশটির অর্থনীতি ও রাজনীতিরও নিয়ন্ত্রক তিনি।
ইরান বিশ্বের সবচেযে প্রভাবশালী শিয়া মতাবলম্বী দেশ এবং আলি খামিনির নেতৃত্বে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে।
ইরানের রাজনৈতিক ক্ষমতা কাঠামোর শীর্ষে আছেন সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা। কাজেই খামেনির মৃত্যু গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। শুধু তাই নয়, গোটা বিশ্বে এর ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে।
ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের বৈরিতার ফলে বহু বছর ধরে অস্থিতিশীলতা ও উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এর প্রধান কারণ এই দুটি দেশের ব্যাপারে খামেনির ব্যক্তিগত অপছন্দ। তিনি পাশ্চাত্যকে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বাস করেন না। পাশ্চাত্যের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে তিনি আগ্রহী নন বলে মনে করা হয়।
ছয় জাতির সঙ্গে ইরানের পরমাণু চুক্তিরও বিরোধী তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফাভাবে ওই চুক্তি থেকে সরে গেলে তিনি বলেছিলেন, আমি শুরু থেকেই বলেছিলাম যে আমেরিকাকে বিশ্বাস করতে নেই। তিনি ইসরাইলের একজন ঘোর বিরোধী। ইহুদিবাদী ইসরাইলের অস্তিত্বেই তিনি বিশ্বাস করেন না। তিনি হলোকস্ট বা ইহুদিনিধনের সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন এসব কারণে তিনি দেশে এবং বিদেশেও অনেকের কাছে প্রিয়।
ইরানে সর্ব্বোচ্চ নেতা নির্বাচনের স্পষ্ট প্রক্রিয়া রয়েছে। ফলে এটা স্পষ্ট যে আলী খামেনির জায়গায় যিনিই আসুননা কেন তিনি আলি খামেনির নির্ধারিত পথেই চলবেন। ইসলামী প্রজাতন্ত্রটির রাজনৈতিক উপদলগুলো পরবর্তী উত্তরসূরি কেমন হবেন তা নিয়ে গভীরভাবে আগ্রহী মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ।
খামেনির অনুগত মহলে তার বড় ধরনের বড় প্রভাব রয়েছে। তাদের বেশিরভাগই ইরানের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী বাহিনী রেভল্যুশনারি গার্ডের সদস্য। রেভল্যুশনারি গার্ড ইরানের সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রধান চালিকাশক্তি। রেভল্যুশনারি গার্ড যদি কোন প্রার্থীকে পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা হিসাবে দেখতে না চায়, বা তারা যদি কোন প্রার্থীকে অপছন্দ করে, তাহলে তাকে ঠেকানোর চেষ্টা তারা করতে পারে।
খামেনি এই বাহিনীকে ব্যাপক শক্তিধর বাহিনীতে পরিণত করেছেন। এই বাহিনীর সাবেক প্রধান কাসেম সোলায়মানি ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সোলায়মানিকে যুক্তরাষ্ট্র হত্যা করলে খামেনি প্রকাশ্যে কেঁদেছিলেন।
এমন গুজবও আছে যে খামেনির উত্তরসূরির সম্ভাব্য প্রার্থীদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে যা অতি গোপনীয়। ঐ তালিকায় কাদের নাম আছে তা জানার কোনো উপায় নেই।
তবে বিভিন্ন ঘটনার নিরিখে বলা হচ্ছে যে খামেনির পছন্দের উত্তরসূরি হতে পারেন তার ছেলে মোজতবা অথবা বিচার বিভাগের প্রধান এব্রাহিম রাইসি। রাইসির পূর্বসূরি সাদেক লারিজানি এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিও পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতার দায়িত্ব গ্রহণে আগ্রহী বলে ধারণা করা হয়।
খামেনির ৫১ বছর বয়সী ছেলে মোজতবা সম্পর্কে ধোঁয়াশা আছে। ধর্মীয় শহর মাশহাদে তার জন্ম এবং বাবার মত তিনিও একজন ধর্মীয় নেতা।তার জন্ম ১৯৬৯ সালে। তিনি খামেনির ছয় সন্তানের একজন এবং ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয়। ১৪ বছরের বিবাহিত জীবনে মোজতবা তিন সন্তানের জনক। ইরানে ২০০৯ সালে বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর যে প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয, তা সহিংসভাবে দমনের দায়িত্বে ছিলেন মোজতবা।
খামেনি কোনো বাদশাহ নন, কাজেই উত্তরসূরি হিসাবে সন্তানের হাতে সিংহাসন তুলে দেওয়ার কোন প্রথা এখানে কাজ করবে না। কিন্তু তার বাবার কট্টরপন্থী ঘনিষ্ঠ মহলে মোজতবার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। এমনকি সর্বোচ্চ নেতার দপ্তর ও সাংবিধানিক প্রভাবশালী দপ্তরেও তার ব্যাপক দাপট রয়েছে।
রেভল্যুশনারি গার্ড মোজতবাকে সমর্থন করলে নির্বাচনে তাকে জতানোর পক্ষে তারা কাজ করতে পারে। অনেকের ধারণা এব্রাহিম রাইসিই খামেনির উত্তরসূরি পদে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় প্রার্থী। ষাট বছর বয়সী এই ধর্মীয় নেতার জন্মও মাশহাদে।
তিনি ইরানের পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা হতে আগ্রহী বলে আলোচনা বা গুজব চলছে। তিনি কখনও তা নাকচ করেননি। তার বহু কার্যকলাপ ও পদক্ষেপ থেকে মনে হয় তাকে এই পদের জন্য তৈরি করা হচ্ছে।
বিচার বিভাগে তিনি বেশ কিছু পদে কাজ করেছেন এবং তিনি সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচনের বিশেষজ্ঞ মন্ডলীতে সহ-সভাপতি।
তবে ১৯৮৮ সালে রাজনৈতিক বন্দীদের গণহারে হত্যায় তার ভূমিকার জন্য তিনি সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় নেতা নন। ২০১৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজয় সত্ত্বেও দেশটির সর্বোচ্চ নেতা খামেনি তাকেই বিচার বিভাগের প্রধান হিসাবে নিয়োগ করেন।
খামেনির মতই রাইসিও ইরানের ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তির বিরুদ্ধে এবং রেভল্যুশনারি গার্ডের খুবই ঘনিষ্ঠ। তবে ইসলামি বিপ্লবের নেতা রুহুল্লাহ খোমেনি এবং বর্তমান শীর্ষ নেতা আলি খামেনির নেতৃত্বে ইরান আজকে মধ্যপ্রাচ্যের একটি বড় শক্তি। ইরানের প্রভাব আন্তর্জাতিক পরিমÐলেও ছড়িয়ে পড়েছে। তাই দেশটির সর্বোচ্চ এই পদেও প্রতি অনেকেরই আকাঙ্খা রয়েছে।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন ইরানের পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচন নিয়ে পর্দার আড়ালে জটিলতা এমনকি দ্বন্দ্বও তৈরি হতে পারে। তবে তা যে প্রকাশ্যে আসবে না, সেকথা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে