রাশিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-ফোর হান্ডেড কেনার কারণে তুরস্কের ওপর অবরোধ আরোপ করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ন্যাশনাল ডিফেন্স অথোরাইজেশন এ্যাক্টের আওতায় ৩০ দিনের মধ্যে অবরোধ কার্যকর হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নতুন এ অবরোধ আরোপের কারণে তুরস্ক বেশ চাপে পড়ে যাবে। এর আগে বেশ কয়েকদিন ধরেই আর্মড সার্ভিস কমিটিতে থাকা মার্কিন হাউস ও সিনেটের সদস্যরা এ নিয়ে আলোচনা করেন।
কংগ্রেস সদস্যরা আরো আগে থেকেই তুরস্কের বিরুদ্ধে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাজি না হওয়ায় তা কার্যকর করা যায়নি। এখন ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হওয়ায় কংগ্রেস এবার তার চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু করবে। রাশিয়া থেকে আকাশ নিরাপত্তাব্যবস্থা কেনার কারণে তুরস্ককে জবাবদিহিতার আওতায় আনার চেষ্টা করা হবে। একইসাথে ট্রাম্প বিদায় নেয়ার আগেই তার কাছ থেকে সাড়ে ৪ হাজার পৃষ্ঠার বিশাল নথিপত্রে সাক্ষর করিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবে।
কংগ্রেস বিলটি অনুমোদন করলে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে তা একটি আইনে পরিণত হবে। এরপর প্রেসিডেন্টকে ১২ ধরনের অবরোধের প্রক্রিয়া থেকে কমপক্ষে ৫টি অবরোধ আরোপ করতে হবে। কাউন্টারিং আমেরিকাস এডভার্সারিস থ্রু স্যাংকশন এ্যাক্ট বা কাটসাতে এ অবরোধগুলোর তালিকা করা হয়েছে।
কাটসা অবরোধ আরোপ হলে সংশ্লিষ্ট দেশ নানা ধরনের সমস্যার মুখে পড়তে হবে। যেমন অবরোধ আরোপ করা দেশটির নাগরিকেরা যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ব্যাংকের সাথে লেনদেন করতে পারবে না। সম্পদ কেনা বেচা করতে পারবে না। এ সব দেশের নাগরিক সহজে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবে না। অবরোধের মুখে থাকা প্রতিষ্ঠান গুলোতে মার্কিন কোনো প্রতিষ্ঠান অর্থ বিনিয়োগও করতে পারবে না।
কাটসার আওতায় ইচ্ছে করলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সরকারকে এমন নির্দেশনা দিতে পারেন, অবরোধ আরোপ করা দেশটিকে কোনো বিশেষ লাইসেন্স দেবে না অথবা কোনো অনুমতি বা কর্তৃত্বও দেবে না। অবরোধের আওতায় থাকা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে কোনো পণ্য ও প্রযুক্তি রফতানি করতে পারবে না।
তুরস্কের ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রি বিষয়ক নির্বাহী কমিটির প্রেসিডেন্ট ইসমাইল দেমির সবার আগে এ অবরোধের ভিকটিম হতে পারেন। তিনি সরাসরি রাশিয়ার কাছ থেকে এস-ফোরহান্ড্রেড নিরাপত্তা কেনার এ প্রক্রিয়াটি তদারক করেছেন। তুরস্কের অর্থনীতি এমনিতেই চাপের মুখে আছে। তার মধ্যে এ অবরোধটি যুক্ত হলে তুরস্কের অর্থনীতি হয়তো আরো কোনঠাসা হয়ে যাবে। দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতি দেখা হবে। ইতোমধ্যেই ডলারের বিপরীতে লিরার দাম আশংকাজনকভাবে কমে যাওয়ায় তুরস্কের রিজার্ভ ফান্ডও বেশ চাপের মুখে আছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান ফরেন পলিসি সেন্টারের রিসার্চ ফেলো ইমরে ক্যালিস্কান বলেন, এর সবচেয়ে নেতিবাচক দিক হলো, সম্ভবত এ অবরোধের কারণে তুরস্ক অন্য দেশে প্রতিরক্ষা যন্ত্রাংশ ও প্রযুক্তি রফতানি করতে পারবে না। তেমনটা হলে তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প বড়ো আকারের ঝাঁকুনি খাবে। তুরস্কের প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর কিছু পণ্যের জন্য নির্ভরশীল। বিশেষ করে, ইঞ্জিন, অপটিকাল সেন্সর, কিংবা ড্রোন নির্মানের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যামেরা সিস্টেম তুরস্ক আমদানি করে থাকে। সেক্ষেত্রে নতুন এ অবরোধ তুরস্কের প্রতিরক্ষা খাতের বিকাশের ক্ষেত্রে বিরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।
তুরস্কের ওপর একবার এ অবরোধ আরোপ হওয়ার পর যদি এ থেকে বেরিয়ে আসতে হয় তাহলে তাদেরকে নিশ্চিয়তা দিতে হবে যে, রাশিয়ার নিরাপত্তা ব্যবস্থা কখনো ব্যবহার ও প্রয়োগ করবে না। তবে এর আগেও তুরস্ককে এ অবরোধের হুমকি দেয়া হলেও তুরস্ক এস-৪০০ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেনি। ইতোমধ্যে এই আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সফল পরীক্ষাও চালিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ আরোপের এই প্রক্রিয়ার মধ্যে তুরস্ক তার পুরনো কৌশলে থাকবে নাকি ভিন্ন কিছু চিন্তা করবে তা এখন দেখার বিষয়।
সৌদি আরব দাবি করছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানের সাথে পারমানবিক চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করতে চায় তাহলে উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে পরামর্শ করে নেয়া উচিত। তা না হলে যুক্তরাষ্ট্রের এ চুক্তি কার্যত সফলতার মুখ দেখবে না। এ চুক্তি স্থায়ীও হবে না বলেও সৌদি আরব সতর্কবার্তা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইংগিত দিয়েছেন তিনি ২০১৫ সালে ওবামা সরকারের সময়ে সাক্ষরিত চুক্তিটি আবারও সচল করতে চান। ডোলাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তি থেকে বেড়িয়ে এসেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানের সাথে এ চুক্তিতে ফিরে আসে তাহলে ইউরোপের মার্কিন মিত্র দেশগুলো খুশী হবে। অপরদিকে উপসাগরীয় বেশ কয়েকটি দেশ নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠায় পড়ে যাবে। মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশগুলো কখনোই তেহরানের সাথে ওয়াশিংটনের সম্পর্ককে ইতিবাচকভাবে নিতে পারেনি।
বাইডেন এবার শুধু চুক্তি কার্যকর করারই উদ্যেগের কথা বলেননি, তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, এবার চুক্তি করলে তিনি বরং মধ্যপ্রাচ্যে থাকা মার্কিন মিত্রদেশগুলোকে এ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করবেন। ইরানের প্রতিপক্ষ দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের মূল ক্রীড়ানক সৌদি আরবকে বাইডেন এবার চুক্তি প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে চাইছেন।
তবে, সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান বলেছেন, আমরা আশা করি, আমেরিকা আমাদের সাথে এবং আমাদের অন্যন্য আঞ্চলিক মিত্রদেশগুলোর সাথে পরামর্শ করবে। ইরানের সাথে যদি যুক্তরাষ্ট্র কোনো সমঝোতা উদ্যেগ নেয় তাহলে এ ব্যাপারে আমাদেরকে যেন অন্ধকারে না রাখা হয়। যুক্তরাষ্ট্র যদি এ চুক্তিকে কার্যকর ও স্থায়ী করতে চায় তাহলে চুক্তিপূর্ব আলোচনার কোনো বিকল্প নেই। বাহরাইনের রাজধানী মানামায় একটি নিরাপত্তা সম্মেলনে অংশ নিয়ে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
প্রিন্স ফয়সাল বলেন, ইরানের সাথে এর আগে যুক্তরাষ্ট্র যে পারমানবিক চুক্তি করেছিল তার সাথে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কোনো দেশকে সম্পৃক্ত না করার পরিণতি আমরা সবাই দেখেছি। মূলত, সেই একপেশে চুক্তি গোটা অঞ্চলের দেশগুলোর মাঝেই অবিশ্বাস ও অনাস্থা তৈরি করেছিলো। ফলে জরুরি অনেক বিষয় অবহেলিত রয়ে গেছে যা আঞ্চলিক নিরাপত্তাকেও ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
এদিকে জার্মানী বলছে, ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপনাস্ত্র প্রকল্পের লাগাম টেনে ধরার জন্য পরমানু চুক্তিকে আরো স¤প্রসারন করা প্রয়োজন। ২০১৫ সালে যেভাবে চুক্তি করা হয়েছিল তা এখন আর যথেষ্ট নয়। জার্মানী এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। জার্মানীর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ মন্তব্যও সৌদি আরবের অবস্থানকে আরো সংহত করেছে।
প্রিন্স ফয়সাল বলেছেন, ওবামা প্রশাসন ইরানের সাথে যে পরমানু চুক্তিটি করেছিল তা খুবই স্বল্পমেয়াদি। ১০-১৫ বছরের জন্যই এ চুক্তিটি করা হয়- যা দিয়ে পরিস্থিতির কোনো কার্যকর উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাছাড়া ইরানের মিসাইল প্রোগ্রাম, বিভিন্ন প্রক্সি গ্রæপ পরিচালনা এবং পরমানু নিরস্ত্রকরণের বিষয়ে চুক্তিতে যথেষ্ট চাপ দেয়ার ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি। ইরান সা¤প্রতিককালে খুব দ্রæত সময়ের মধ্যে ইউরেনিয়ামের মজুদ বৃদ্ধি করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। তাই দেশটির পারমানিবক বোমা বানানোর ক্ষমতাকে খর্ব করে দেয়ার জন্য এ চুক্তি যথেষ্ট নয়।
সৌদিআরব দাবি করছে, তাদের ভুখন্ডের ওপর বিগত বছর থেকে বেশ কয়েকবার ব্যালিস্টিক মিসাইল ও ড্রোন হামলা চালানো হয়েছে। পাশাপাশি, দেশের উত্তরাঞ্চলে আরামকো স্থাপনাতেও হামলা চালানো হয়েছে। ফলে, সৌদি আরবে পরিশোধিত তেলের উৎপাদন একটা পর্যায়ে কিছুদিনের জন্য অর্ধেকে নেমে এসেছিল। এ হামলাগুলো চালানো হয় ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের পক্ষ থেকে। ধারণা করা হয়, হুথিদের পৃষ্টপোষকতায় তেহরানের হাত আছে। অন্যদিকে, সৌদি আরব ইয়েমেনের বর্তমান আন্তর্জাতিক মদদপুষ্ট সরকারকে সমর্থন করছে।
বাইডেন প্রশাসন বরাবরই সৌদি আরবের বিষয়ে কঠোর মানসিকতা লালন করে। কারণ বাইডেন মনে করেন, সৌদি আরবের ভেতরে ও পররাষ্ট্রনীতিতে মানবাধিকার ও মানবিক মর্যাদার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। সাংবাদিকরা এ বিষয়ে প্রিন্স ফয়সালকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এগুলো বাইডেনের নির্বাচনী কথাবার্তা। সব কথাকে এত সিরিয়াসলি নেয়ার কোনো কারণ নেই। তিনি এ সময় ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে সৌদি সরকারের গভীর সম্পর্কের কথা স্মরণ করেন এবং বলেন ট্রাম্প ক্ষমতার বাইরে থাকলেও তাদের মধ্যে যোগাযোগ থাকবে। বিশেষ করে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন সালমানের সাথে ট্রাম্পের মেয়ে জামাই ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক উপদেষ্টা জারেড কুশনারের সম্পর্ক চলমান থাকবে বলেও তিনি আশা করেন।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে