আরব বসন্তের ১০ বছর: যে স্বপ্ন এখনো অধরা

আরব বসন্ত - ইন্টারনেট

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ২৪ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:২৬

মোহাম্মদ বোয়াজিজি নামের তিউনিসিয়ার ২৬ বছরের তরুণ এক ফল বিক্রেতা ১০ বছর আগে নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলো। সে আগুন দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ভূমধ্যসাগরের তীর ঘেষে থাকা সবগুলো দেশে। মরক্কো থেকে তিউনিসিয়া পর্যন্ত বিদ্রোহ আর অভ্যুত্থানের ঢেউ লাগে সর্বত্র। প্রতিটি দেশেই জনবহুল পাবলিক স্কয়ারগুলোকে জনগন তাদের দীর্ঘ বছরগুলোর ক্ষোভ, অভিমান, বঞ্চনা আর হতাশা প্রকাশের জন্য বেছে নেয়। কিন্তু এরপর একযুগ পার হলেও আন্দোলনরত মানুষের চাওয়া বা স্বপ্নের কতটুকুই বা পূরণ হয়েছে?

বোয়াজিজি নিজের শরীরে আগুন দিয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অব্যহত দুর্নীতি ও নৃশংসতার প্রতিবাদ হিসেবে। কিন্তু বোয়াজিজি এখন তিউনিসিয়ার জন্য নিছকই একটি ইতিহাস। তার মৃত্যু যে বিপ্লবের সূচনা করেছিল তাও এখন মৃতপ্রায়। বোয়াজিজির পরিবার এ ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে বহু আগেই চলে গেছে কানাডায়। বোয়াজিজির বাড়ির আশপাশের এলাকাটির নাম সিদি বাওজিদ। কিন্তু এখন সে এলাকার সাথে তার পরিবারেরই কোনো সম্পর্ক আর অবশিষ্ট নেই। যে বোয়াজিজি একটা সময়ে অনেকের কাছেই ছিল স্বপ্নের নায়ক, এখন অনেকের কাছেই সে অভিশাপ। স্থানীয় নাগরিকেরা প্রায়ই তার ছবির দিকে তাকিয়ে বলেন, আমরা এ ছবিটিকে আর ধারণ করতে চাই না। ও আমাদের জীবনটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।

বোয়াজিজির চাচাতো ভাই, কায়েস বোয়াজিজিও আক্ষেপ করে বলেন, তাদের এ বংশীয় উপাধিটি একটা সময়ে তিউনিসিয়ার মানুষের জন্য গর্বের প্রতীক ছিল। এখন তা যেন ভোগান্তি আর অপমানের কারণ হয়ে উঠেছে। ১০ বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে, তিউনিসিয়ায় কাগজে কলমে গণতন্ত্র আছে ঠিকই, কিন্তু গুপ্তহত্যা, সন্ত্রাসী হামলাও চলছে আগের মতোই। বাহ্যত দেশটি যেন আবার একটি কর্তৃত্বপরায়ণ প্রশাসনের দিকেই চলে যাচ্ছে। মিশর, সিরিয়া, ইয়েমেন বা লিবিয়াতেও একইচিত্র। শান্তির পায়রা কোথাও আর দৃশ্যমান নেই।

তিউনিশিয়ার জনগণ আগে সরকারের সমালোচনা করতে যতটা ভয় পেতো, এখন তার চেয়েও অনেক বেশি ভয় পায়। হতাশাগ্রস্ত হয়ে জনগনের অনেকেই এখন নানা ধরনের উগ্রবাদি সংগঠনে যোগ দিচ্ছে। তিউনিশিয়ার গড় আয়ের পরিমাণও বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় আশংকাজনকভাবে কমে যাওয়ায় দেশটি থেকে নিয়মিতভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লোকজনের ইতালিতে পালিয়ে যাওয়ার সংখ্যা বাড়ছে।

কেন আরব বসন্ত থেকে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া গেলো না? এর পেছনে রয়েছে নানা কারন। আরব বসন্তের পর মধ্যপ্রাচ্যের দুটো প্রভাবশালী দেশ সংযুক্ত আরব আমীরাত ও সৌদি আরব নিজেদের মতো করে খেলা খেলে যাওয়ায় জনগণের বিপ্লব বহু আগেই জনগণের কাছ থেকে হাইজ্যাক হয়ে গেছে। ঘটনা প্রবাহ বলছে, আরব আমীরাত ও সৌদি আরব বিপ্লবের সময় দৃশ্যত চুপ থাকলেও কার্যত তারা সবসময়ই কায়েমী স্বার্থের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। যে দেশগুলোতে আরব বসন্তের প্রভাবে বিপ্লব হয়েছে, সেখানকার গনতন্ত্র বিরোধী প্রশাসকদেরকেই সৌদি ও আমীরাত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহায্য করে গেছে।

আরব বসন্তের দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক কোনো প্রশাসন যাতে আসতে না পারে সে জন্য সৌদি আরব ও আরব আমিরাত সব চেষ্টা করে গেছে। এ কাজটি করেছে শুধুমাত্র নিজেদের রাজতান্ত্রিক গদিকে সামাল দেয়ার জন্যই। জ্বালিয়ে রেখেছে অশান্তির আগুন।

শুধু তাই নয়, যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এসব বিপ্লবের নেপথ্যে কাজ করেছে বা বিপ্লব পরবর্তী নির্বাচনে যে দলগুলো জনগনের সমর্থন পেয়েছে, তাদেরকেই নানাভাবে কোনঠাসা করেছে সৌদি আরব ও আমীরাত। তিউনিশিয়ায় যেমন আন নাহদা প্রথম নির্বাচনের পর পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে আর খুব বেশি ভালো করতে পারেনি। অন্য দেশগুলোতেও তাই। অভিযোগ আছে, সংযুক্ত আরব আমীরাত তিউনিশিয়াতে বেশ কয়েকবার সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করেছে। তিউনিশিয়ায় কোনো শক্তিশালী গনতান্ত্রিক কাঠামো যেন গড়ে উঠতে না পারে সে জন্যই আমীরাত এমনটা করছে।

এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে মুসলিম ব্রাদারহুডের। মিশরে আরব বসন্তের ফল হিসাবে দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসক হোসনী মোবারকের পতন হয়। প্রথম গনতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত হন মোহাম্মাদ মুরসি। কিন্তু প্রথমদিন থেকেই মুরসির বিরুদ্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে চক্রান্ত শুরু হয়। সৌদি আরব ও আরব আমীরাতের কারনে মধ্যপ্রাচ্যর দেশগুলো থেকে প্রত্যাশিত সহযোগিতা পাননি মুরসি। এ সময় মিশরের প্রধান সালাফী পন্থী দলটিকে যেমন মুরসির বিরুদ্ধে নামিয়ে দেয়া হয় আবার ফিলিস্তিন ইস্যুতে বেশি সরব হওয়ায় মুরসিকে পশ্চিমাদের কাছে ভিলেন হিসেবে উপস্থাপনের অপপ্রয়াস চালানো হয়। এক পর্যায়ে ২০১৩ সালে সেনা ক্যু’র মাধ্যমে মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।

আরব আমীরাত ও সৌদি আরব প্রকাশ্যে মিশরের স্বৈরাচারী সেনা শাসক আব্দুল ফাত্তাহ সিসিকে সমর্থন দিয়ে যায়। এখনো পর্যন্ত অর্থকড়ি ও অনুদান দিয়ে সিসিকে এ দুদেশই টিকিয়ে রেখেছে। কিন্তু যে স্বৈরাচারী শাসক মোবারকের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মিশরের জনগন সংগ্রাম করেছিল। ১০ বছর পরে এসে তাদেরকে একই স্বৈরাচারী শাসনের অধীনেই থাকতে হচ্ছে। শুধুমাত্র শাসকের নাম পাল্টেছে। সংযুক্ত আরব আমীরাত ও সৌদি আরব উভয় দেশই মুসলিম ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে এবং দলটির নেতাকর্মীরা অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

লিবিয়াতেও সৌদি আরব ও আমীরাত একই কৌশল নিয়েছে। মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর থেকেই লিবিয়া পরিস্থিতিকে নিজেদের হাতে নেয়ার জন্য এ দুদেশ বেপরোয়া হয়ে যায়। তারা প্রকাশ্যে জেনারেল খলিফা হাফতারকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছে। এরপরও হাফতার সামরিক বাহিনীর সমর্থন নিয়ে রাজধানী দখল করে শাসনভারকে নিজের হাতে নিতে পারেননি। লিবিয়ায় একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকার বর্তমানে কাজ করে যাচ্ছে। এ সরকারকে সমর্থন করায় তুরস্কের সাথে আরব আমীরাত নিজেদের সম্পর্ককে নষ্ট করেছে। কিন্তু তারপরও তারা ঐকমত্যের সরকারকে সমর্থন করেনি।

গণতান্ত্রিকভাবে কার্যকর কোনো সরকারকে সমর্থন করার দৃষ্টিভঙ্গি আরব আমীরাত বা সৌদি আরব কেউই লালন করে না। তুরস্ক যেভাবে এখন উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর ওপর নিজের প্রভাব বিস্তার করছে তা এ দুটো দেশ মোটেও মানতে পারছে না।

অন্যদিকে, সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন জোট ইয়েমেনে আগ্রাসন চালিয়ে দেশটিতে নতুন করে এক গৃহযুদ্ধের সূচনা করেছে। ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীদের দমন করতে গিয়ে এখন দেশটি ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো মানবিক সংকটের মুখে পড়েছে। ২০১৫ সালের ২৬ মার্চ থেকে দেশটিতে যে গৃহযুদ্ধ ও সংঘাতময় পরিস্থিতির সূত্রপাত হয়েছে আজও তার কোনো সমাপ্তি ঘটেনি। সৌদি আরব ও আমীরাতের নিজেদের আভ্যন্তরীন অবস্থাও মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়।

সংযুক্ত আরব আমীরাতে সরকার বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির যেসব ব্যক্তিত্ব ও সংস্থা রাষ্ট্রীয় সংস্কারের দাবি তুলেছিল তাদের সবাইকেই রাষ্ট্রের জন্য হুমকি আখ্যা দিয়ে জেলে নেয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন থেকেই আমীরাতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বলা হলেও সেদিকে আমীরাতি নীতি নির্ধারকদের ন্যুনতম আগ্রহ না থাকায় প্রত্যাশিত নির্বাচনও আর করা যায়নি।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো সৌদি আরবের বিরুদ্ধেও একইভাবে বিরোধী চিন্তাধারার লোকদেরকে আটক ও মৃত্যুদন্ড দেয়ার অভিযোগ তুলেছে। বেশ কয়েকজন প্রথিতযশা ইসলামী চিন্তাবিদকে বন্দী করা হয়েছে কারণ তারা সরকারের পক্ষে কথা বলতে রাজি হননি। কাবা শরীফের একাধিক ইমামকেও চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে কারণ তারা দেশটির ক্রাউন প্রিন্সের নানা কর্মকান্ডের সমালোচনা করেছিলেন। রিয়াদ বিরোধী মতের লোকদের বিরুদ্ধে কতটা বর্বর হতে পারে তার প্রমাণ হলো সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যাকান্ড। ইস্তানবুলের সৌদি কনসুলেটে ২০১৮ সালের অক্টোবরে একদল ভাড়াটে খুনী রিয়াদ থেকে উড়ে গিয়ে খাসোগীকে হত্যা করে। পরবর্তীতে এ হত্যার পেছনে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন সালমানের সংশ্লিষ্টতাও প্রমাণ হয়।

আরব বসন্তের কফিনে পেড়েকটি ঠুকেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনল্ট ট্রাম্প। আরব বসন্ত হয়েছিল যাদের বিরুদ্ধে সেই স্বৈরশাসকদেরকে ট্রাম্প শুধু সমর্থনই করেননি বরং শক্তিশালী করে গেছেন। কায়রোর তাহরীর স্কয়ার যেন আজ চোখের পানি ফেলে, যখন দেখে ইসরাইলের মতো একটি স্বৈরাচারী শাসকের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের একের পর এক দেশের নেতারা গিয়ে চিরস্থায়ী বন্ধুত্বের ঘোষনা দিচ্ছেন।

আরব দেশগুলোর জনগণের মধ্যে এখনো দুটি ব্লকের লড়াই নিয়েই সংশয়ে থাকতে হয়। একটি হলো ইরানের সাথে উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর বিরোধ। এ বিরোধের চূড়ান্ত খেসারত দিতে হচ্ছে লিবিয়া ও সিরিয়াকে। আর দ্বিতীয় বিরোধটি হলো মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে আরবের রাজতান্ত্রিক সরকারগুলোর বিরোধ। এ দুটো বিরোধকেই ভেতর থেকে উস্কানি দিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। তারা একেক সময় একেকটি কার্ড ব্যবহার করে এ বিরোধে ফায়দা হাসিল করতে চায়। এরই অংশ হিসেবে সৌদি আরব ও ইসরাইল মিলে ইরানের বিরুদ্ধে একটি পারমানবিক বোমা বানানোর গল্প রচনা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে গল্পে বিশ্বাস রেখে ২০১৫ সালে ইরানের সাথে একটি চুক্তিও করে- যা মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রনের বাইরে নিয়ে যায়।

মধ্যপ্রাচ্যে এখন স্থায়ী মেরুকরণের প্রক্রিয়া চলছে। যেকোনো দেশকে দিয়ে পছন্দসই চুক্তি করার জন্য চাপের অংশ হিসেবে কিংবা কোনো দেশ আমীরাত ও সৌদি নির্দেশনার বাইরে গেলে তার বিরুদ্ধে অবরোধ জারি করার নীতি নেয়া হয়েছে। ২০১৭ সালে সৌদি আরব ও এর মিত্রদেশগুলো কাতারকে অবরোধের ঘোষণা দিয়েছিল। কাতারের বিরুদ্ধে তখন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা করার অভিযোগ আনা হয়েছিল।

২০০৯ সালে ভূমধ্যসাগরে নতুন করে গ্যাস ফিল্ডের সন্ধান পাওয়ার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যকে ঘিরে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের ডালপালা মেলতে শুরু করে। আরব বসন্তের ১০ বছর পর এসে বলা যায়, আরব বসন্ত নিয়ে উৎসব করার মতো খুব কম কিছুই এখন অবশিষ্ট আছে। প্রত্যাশাগুলো অনেকটাই হারিয়ে গেছে।

আরব দেশগুলোতে পুরনো কৌশল আর নিপীড়নের ইতিহাসটাই একটু রং বদলে যেন আবার ফিরে এসেছে। আবারও সেই অস্ত্র চুক্তি, জ্বালানী উৎস নিয়ে কাড়াকাড়ি আর স্বৈরশাসকের বর্বরতায় দীর্ঘশ্বাস শোনা যাচ্ছে গোটা আরব আর উত্তর আফ্রিকা জুড়ে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে