তুরস্কে অবস্থানরত ইরানি ভিন্ন মতাবলম্বীদের অবিশ্বাস্যভাবে হত্যা ও অপহরণ করছে ইরানি গোয়েন্দারা। এরকম কয়েকটি রহস্যময় ঘটনা উদ্ঘাটন করেছে তুর্কি কর্তৃপক্ষ। ওয়াশিংটন পোস্টের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে শ্বাসরুদ্ধকর সেসব কাহিনী।
সুইডেনে নির্বাসিত ইরানের বিরোধী রাজনীতিক হাবিব শাব বন্ধুদের কাউকে না জানিয়েই গত অক্টোবরে তুরস্কে গিয়েছিলেন। হাবিবের বন্ধু ফৌদ আল-কাবি বলেন, আমরা জানলে তাকে তুরস্কে যেতে দিতাম না। কারণ ইরানি গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্টদের উর্বরক্ষেত্র হয়ে উঠেছে তুরস্ক। আর হাবিব ছিলেন একটি সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর নেতা। ফলে তেহরানের মোস্ট ওয়ান্টেট ছিলেন তিনি।
যেমনটা আশঙ্কা বন্ধুরা করতেন, শেষ পর্যন্ত তাই ঘটল। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে পৌছার পরই হাবিবকে গুম করা হয়। এর দুদিন পর ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, হাবিবকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বলা হয়, দুই বছর আগে ইরানের একটি সামরিক কুচকাওয়াজে ভয়াবহ হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। ওই কুচকাওয়াজে বন্দুকধারীদের হামলায় দুই ডজনের বেশি লোক মারা যায়। তবে তাকে কিভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে সে সম্পর্কে কোনো তথ্য দেয়নি ইরান সরকার।
তুরস্কের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এ রহস্যের জট উদ্ঘাটনে নেমে পড়ে বলে তুরস্কের একজন কর্মকর্তা জানান। তুরস্কের ওই কর্মকর্তা ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিকের কাছে হাবিবকে অপহরণের কাহিনী তুলে ধরেন। তিনি জানান, এক নারী প্রেমের ভান করে হাবিবকে ইস্তাম্বুলে যেতে প্ররোচিত করেন। কিন্তু ইস্তাম্বুলে যাওয়ার পর হাবিব ওই নারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তাকে অপহরণ করা হয়। এরপর তাকে ইরানে পাচার করা হয়।
ইরানি গোয়েন্দাদের তদারকিতে হাবিবকে অপহরণের দায়িত্বে ছিল তুরস্কের একটি কুখ্যাত মাদক পাচার চক্র। এর হোতা ছিলেন ইরানি বংশোদ্ভুত মাদক পাচারকারী নাজি শরিফি জিন্দেস্তি।
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে হাবিব অপহরণে জড়িত বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে তুরস্ক কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে তদন্ত এখনো চলছে। তাই কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে বেশি কথা বলতে চান না।
হাবিবের অপহরণের এ ঘটনাটি দুই বছর আগে ইস্তাম্বুলে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে অপহরণের পর হত্যার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। দুটো ঘটনার মধ্যে বেশ মিল রয়েছে। সেই ঘটনাটি ইস্তাম্বুলে ঘটিয়েছিল সৌদি গোয়েন্দা সংস্থা। ইস্তাম্বুল শহরটি আন্তর্জাতিক বিমান ভ্রমণের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র এবং এ অঞ্চলের ভিন্ন মতাবলম্বীদের আশ্রয়স্থল।
হাবিবের এই অপহরণের ঘটনার সঙ্গে ইরান সাম্প্রতিক আরেকটি গুমের ঘটনার মিল রয়েছে। হতভাগ্য ওই অপহৃতের নাম রুহুল্লাহ জাম। ভিন্ন মতাবলম্বী ওই সাংবাদিক ফ্রান্সে নির্বাসিত জীবন কাটাতেন। গত বছর তাকে প্রলুব্ধ করে ইরাকে নিয়ে যাওয়ার পর তিনিও হাবিবের মতই গুম হন। তিনি সামাজিক গণমাধ্যমে একটি জনপ্রিয় চ্যানেল পরিচালনা করতেন। কয়েক দিন আগে তাকে ফাঁসি দিয়েছে ইরান সরকার।
২০১৭ সালে ইরানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে এই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। তার ফাসির নিন্দা জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
হাবিবের অপহরণের ঘটনাটি নিয়ে গত কয়েক বছরে ইরান তুরস্কে হাই প্রোফাইল তিনটি গুমের ঘটনা ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ এই ঘটনায় ইরানের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে পারে।
আঞ্চলিক প্রতিযোগী ইরান ও তুরস্কের মধ্যে বাণিজ্য, জ্বালানি ও অন্যান্য বিষয়ে সহযোগিতা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে বৈরিতাও রয়েছে। ইরান এর আগেও তুরস্কে অবস্থানরত তাদের ভিন্ন মতাবলম্বীকে হত্যা করেছে। ২০১৭ সালে ইরানের এক মিডিয়া মুগলকে ইস্তাম্বুলে চলন্ত গাড়ি থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাকে কারাদন্ড দিয়েছিল ইরান সরকার। সেই হত্যাকান্ড ঘটায় জিন্দেস্তির মাদক পাচার চক্র।
গত বছর মাসুদ মোলাভি ভারদানজানি নামের ইরানের একজন সাবেক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাকে ইস্তাম্বুলে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনিও ইরান সরকারের সমালোচক হয়ে উঠেছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, ইরানি কনস্যুলেটে নিয়োজিত গোয়েন্দা কর্মকর্তা মাসুদকে হত্যা করে।
হাবিব সুইডেনে থেকে দ্য আরব অস্ট্রাগল মুভমেন্ট ফর দা লিবারেশন অব আবভাজ বা এএসএমএলএ নামের একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন পরিচালনা করতেন। কয়েক দশক করে সংগঠনটি ইরানের তেলসমৃদ্ধ দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের স্বাধীনতার জন লড়ছে। সংখ্যালঘু আরবদের বিরুদ্ধে ইরান সরকার বৈষম্য করছে বলে তাদের অভিযোগ। সংগঠনটির নেতারা ইউরোপে নির্বাসনে রয়েছেন। তবে তাদের অনুসরারীরা ইরানের অভ্যন্তরে থেকে হামলা চালায়।
তুরস্কের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হাবিব গত ৯ অক্টোবর সুইডেন থেকে ইস্তাম্বুলে যান। সাবেরিন এস নামের এক নারী তাকে প্ররোচিত করে সেখানে নিয়ে যান। হাবিবের ইস্তাম্বুলে পৌছানোর আগেই ওই নারী ভুয়া ইরানি পাসপোর্টে ইস্তাম্বুল পৌঁছান। হাবিব পৌঁছানোর পর তাকে অপহরণে জড়িত টিমের সদস্যরা ইস্তাম্বুলের একটি হার্ডওয়ারের দোকান থেকে প্লাস্টিকের রশি কেনেন। সেদিন সন্ধ্যায় হাবিব ইস্তাম্বুলে পৌছেই স্থানীয় একটি গ্যাস স্টেশনে যান ওই নারীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য। সেখানে একটি গাড়িতে অবস্থান করছিলেন ওই নারী।
গাড়িটিতে হাবিব ঢোকার পরপরই তার হাত-পা বেধে ফেলা হয়। এরপর তাকে পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ ভ্যানে নিয়ে যাওয়া হয় ওই গাড়িতে। পরে তাকে জিন্দেস্তির মানবপাচারকারী দলের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর তাকে সীমান্ত পার করে ইরানে পৌছে দেয় ওই পাচারকারী দলটি। পরে সাবেরিনও ইরানে চলে যান।
এ ঘটনায় জড়িত ১১ জনকে গ্রেফতার করেছে তুরস্কের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। তারা সবাই তুরস্কের নাগরিক। তবে অপহরণের মূল হোতা জিন্দেস্তি ইরানে পলাতক আছেন বলে জানিয়েছে কর্মকর্তারা।
জিন্দেস্তি এর আগে তুরস্কে গ্রেফতার হয়ে জেল খেটেছেন। তার বিরুদ্ধে মাদক পাচারের অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ আছে, তুরস্কের কর্মকর্তারাও তার থেকে সুবিধা নেন। ২০১৪ সালে তার এক মেয়েকে ইস্তাম্বুলে গুলি কওে হত্যা করা হয়। প্রতিপক্ষ এ হত্যায় জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
দুই বছর আগে জিন্দেস্তিকে যখন সর্বশেষ তার ইস্তাম্বুলের বাসা থেকে হত্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয় তখন সেখানে অতিথি ছিলেন দুজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা। তাদেরকেও গ্রেফতার করা হয়। তখন ৬ মাস জেল খেটেই ছাড়া পান জিন্দেস্তি। অভিযোগ রয়েছে তুরস্কের প্রেসিডেন্টের একজন উপদেষ্টার হস্তক্ষেপে তিনি ছাড়া পান। তবে বুরহান কাজু নামের ওই উপদেষ্টা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। চলতি বছর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বুরহান।
জিন্দেস্তি কবে থেকে ইরানের গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করেছেন তা স্পষ্ট নয়। তার বাড়ি ইরানে। মাদক সংক্রান্ত মামলায় তরুণ বয়সেই তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। পরে ২০ বছর বয়সে ইরান থেকে পালিয়ে তুরস্কে চলে আসেন। জিন্দেস্তিকে নিয়ে তুর্কি ভাষায় বইও লেখা হয়েছে। তুরস্কের গণমাধ্যমেও তাকে নিয়ে লেখা হচ্ছে।
জিন্দেস্তির আত্মীয় বাহতিয়ার ফিরাতকে গত অক্টোবরে ইরান যাওয়ার সময় গ্রেফতার করে তুর্কি কর্মকর্তারা। তবে ফিরাতের স্ত্রী এশরা দাবি করেছেন, তার স্বামী ইরানে আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। তিনি সেখানে দাতের ডাক্তার দেখাতে চাচ্ছিলেন। তবে ফিরাত জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন যে হাবিবের গুমের আগে জিন্দেস্তি ইরানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন।
ইরানি কর্মকর্তারা বলছেন, হাবিবের সংগঠন ইরানের প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে টাকা পায়। তারা ইরানকে অস্থিতিশীল করতে কাজ করছে। তবে ইরানের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে দেশটির তেলের ৮০ ভাগ মজুত থাকলেও সেখানে ব্যাপক দারিদ্র রয়েছে। সরকারের বৈষম্য ও অবহেলার বিরুদ্ধে সেখানে অসন্তোষ রয়েছে।
হাবিবদের সংগঠন এএসএমএলএ সেখানে ব্যাংক, তেলের পাইপলাইন ও সরকারি অফিসে হামলা চালায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এই সংগঠনের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর আহভাজের একটি সামরিক কুচকাওয়াজে ভয়াবহ হামলা চালানোর অভিযোগ আছে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরানের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে বৈষম্য থাকলেও সেখানকার সংখ্যালঘু আরবদের মধ্যে হাবিবদের সংগঠনটির তেমন জনসমর্থন নেই। তা সত্ত্বেও ইরান সরকার তাদেরকে হুমকি হিসেবে দেখে থাকে। ২০১৭ সালে নেদারল্যান্ডের হেগে এএসএমএলএর একজন নেতাকে তা বাড়ির বাইরে গুলি করে হত্যা করা হয়। আহমদ মোলা নিসা নামের ওই নেতাকে হত্যায়ও ইরানি কর্মকর্তারা জড়িত বলে নেদারল্যান্ড সরকার অভিযোগ করেছে।
হাবিবও ১৪বছর ধরে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছিলেন বলে তার বন্ধু কাবি জানান। এএসএমএলএ সংগঠনের সহযোগী আহভাজি ডেমোক্রেটিক পপুলার ফ্রন্টের মুপপাত্র কাবি অভিযোগ করেন, হাবিবের কাছ থেকে নিপীড়ন করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে। তিনি ওই বলেন, সামরিক কুচকাওয়াজে হামলার কথা স্বীকার করেছে জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট।
হাবিবের সহকর্মীরা বলছেন, তারা সন্দেহ করছেন যে সাবেরিন নামের যে নারীর প্ররোচনায় তিনি ইস্তাম্বুলের ছুটে যান, অপহরণে ওই নারীর ভূমিকা থাকতে পারে। কাবি বলেন, তারা জানতেন হাবিবের স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে এবং হাবিব চার বছর আগে সাবেরিনকে গোপনে বিয়ে করেছেন।
হাবিব চরমভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ওই নারী তাকে এক কোটি টাকা বা এক লাখ ইউরো ধার দিয়েছিলেন। হাবিবের বন্ধুরা জানান, তারা শুনেছিলেন ওই নারী আরও টাকা ধার দেওয়ার কথা বলে হাবিবকে ইস্তুাম্বুলে যেতে প্ররোচিত করেন। তারা বলেছেন, কাতারে গিয়ে ওই নারীর সঙ্গে হাবিবের দেখা করার কথা ছিল। তবে তিনি হাবিবকে কিভাবে ইস্তাম্বুলে যেতে প্ররোচিত করেন, তা তারা জানতেন না। ইস্তাম্বুলের কথা শুনলে তারা হাবিবকে সেখানে যেতে দিতেন না।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে