হত্যা, নির্যাতন, দমন-পীড়ন, যুদ্ধপ্রীতি- শব্দগুলো যেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নামের সমার্থক হয়ে উঠেছে। রাজপরিবারে প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমন, ‘বিপজ্জনক ইসলামিস্ট’ তকমা লাগিয়ে সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যা, কারাগারে নির্যাতনের মাধ্যমে ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যা, সৌদি আরবের সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা সাদ আল-জাবরিকে হত্যাচেষ্টা- ঘটনাগুলো নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছেন মোহাম্মদ বিন সালমান, সংক্ষেপে এমবিএস।
বলা হয়, ট্রাম্পের আস্কারা পেয়ে এতদিন কোনো কিছুই তোয়াক্কা করেননি তিনি। সাদ আল-জাবরিকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় এমবিএসকে দায়মুক্তি দেওয়ার কথাও ভাবছেন ট্রাম্প। ইয়েমেন যুদ্ধ, কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ, ইসরাইলের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক- সবই রচিত হয়েছে ট্রাম্পের সঙ্গে তার প্রশ্নবোধক সম্পর্ককে কেন্দ্র করে। তিনি শুধু সৌদির সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্কই তৈরি করেননি, সৌদি প্রভাবাধীন দেশগুলোকে সে সম্পর্ক তৈরির পথও করে দিয়েছেন। এক কথায়, আরব ঐক্যকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন তিনি।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কি তাকে প্রশ্রয় দেবেন? এককথায় ‘না’। বাইডেন বলে দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবকে ‘জবাবদিহিমূলক’ দেখতে চায়। দেশটি বেপরোয়া আচরণ করলে পরিণতি অপেক্ষা করছে।
এমবিএসের দমন-পীড়নের তালিকায় সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে আরও কিছু ঘটনা, যার ফলে সৌদি আরবকে ‘সমাজচ্যুত’ রাষ্ট্র হিসেবে এবং এমবিএসকে ‘ভয়ঙ্কর’ হিসেবে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে বিশ্ব।
এই তো কদিন আগে সৌদি আরবের পরিচিত নারী অধিকারকর্মী লুজাইন আল-হাথলুলকে প্রায় ৬ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে দেশটির আদালত। সঙ্গত কারণেই তার এ সাজা যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সৌদি আরবের সন্ত্রাসবাদবিরোধী আইনের আওতায় হাথলুলকে এ সাজা দেওয়া হয়েছে বলে সৌদি সংবাদ মাধ্যমগুলো জানিয়েছে। ৩১ বছর বয়সী এ নারীর বিরুদ্ধে সৌদি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে পাল্টাতে চাওয়া এবং জাতীয় নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার অভিযোগ আনা হয়েছিল। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর আদালত তাকে মোট ৫ বছর ৮ মাসের কারাদণ্ড দেয়। রায় ঘোষণার সময় কাঁদতে থাকা হাথলুল আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন।
এক বিবৃতিতে তার বোন লিনা বলেছেন, ‘আমার বোন সন্ত্রাসী নয়, তিনি অধিকারকর্মী। তাকে তার এ কাজের জন্য সাজা দেওয়ার ভেতর দিয়ে মোহাম্মদ বিন সালমান এবং সৌদি রাজতন্ত্র গর্বের সঙ্গে যেসব সংস্কারের কথা বলছেন, সেগুলো যে আসলে ভণ্ডামি ছাড়া কিছুই নয়, তা-ই প্রমাণ হয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেছেন, হাথলুলের সাজার খবরে তারা ‘উদ্বিগ্ন’। বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্ব নিতে যাওয়া জেইক সালিভান টুইটারে লিখেছেন, রিয়াদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসন মানবাধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়কে বেশি প্রাধান্য দেবে। হাথলুলকে কেবল তার বিশ্বজনীন অধিকার চর্চার কারণে সাজা দেওয়া অন্যায্য ও যন্ত্রণাদায়ক। যেমনটা আমরা বলেছি, যেখানে যেখানে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হবে, বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসন তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা হাথলুলের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে ‘জালিয়াতিপূর্ণ’ বলে অ্যাখ্যা দিয়েছিলেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় সৌদি আদালতের রায়কে ‘গভীর উদ্বেগজনক’ অ্যাখ্যা দিয়ে হাথলুলের দ্রুত মুক্তির দাবি জানিয়েছে।
হাথলুল শুধু একজন নন, তার মতো শত শত রাজনৈতিক বন্দি রয়েছেন, যাদের একই অভিযোগে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করেছে সৌদি। রিয়াদের যে বিশেষায়িত অপরাধ আদালতে হাথলুলকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়, সেই আদালতে বিচারাধীন প্রভাবশালী অধিকারকর্মী সালমান আলাউদা’র অবস্থা বর্ণনা করেছেন তার ছেলে সৌদি স্কলার ও অধিকারকর্মী আবদুল্লাহ আলাউদা। নিউইয়র্ক টাইমসে এক মতামত নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পরিবারকে তার সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি, এমনকি ফোনও রিসিভ করতে দেওয়া হয়নি। এরপর যখন তারা দেখার অনুমতি পান, তাদের মাঝখানে একটা কাঁচের দেয়াল ছিল।
তিনি বলেন, ইসলামি আইনের ওপর পিএইচডি স্কলার আমার ৬৩ বছর বয়সী পিতাকে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে নির্জন কারাবাসে পাঠানো হয়। সৌদি আরব, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মিসর যখন কাতারে অবরোধ আরোপ করে, তখন মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি ভালো চোখে দেখেননি আমার পিতা। তিনি এক টুইটে এ অবরোধের বিরোধিতা করে দেশগুলোর মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক স্থাপনের আগ্রহ প্রকাশ করেন। এর কয়েক মাস পর তাকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়।
অভিযোগ ছাড়াই এক বছর আটকে রাখার পর তার বিরুদ্ধে বেশকিছু অভিযোগ আনে সৌদি কর্তৃপক্ষ। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে রিয়াদের একটি অফ-ক্যামেরা আদালতে তার বিচার শুরু হয়। সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে উস্কে দেওয়া, সরকার পরিবর্তনের আহ্বান থেকে শুরু করে নিষিদ্ধ বই রাখার অভিযোগও ছিল এর মধ্যে। সৌদি আরবের অ্যাটর্নি জেনারেল সৌদ আল-মোজেব ৩৭টি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমার পিতার মৃত্যুদণ্ডের আবেদন করেন।
২০১১ সালের আরব বসন্তে নির্বাচনের মাধ্যমে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে উত্তরণ, মৌলিক স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের দাবিতে হাজার হাজার সৌদি যে আবেদনে স্বাক্ষর করেছিলেন, আমার পিতা তার হাইপ্রোফাইল সমর্থক ছিলেন। এ কারণে তার বিদেশ ভ্রমণেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
বাদশাহ সালমান দায়িত্ব গ্রহণের তিন মাস পর তার ছেলে ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স এমবিএস ‘সৌদি ভিশন ২০৩০’ উপস্থাপন করেন। সেখানেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের অঙ্গীকার করেন তিনি। দুই বছর পর ২০১৭ সালে যখন এমবিএস যুবরাজের দায়িত্ব পান, তখন রাজনৈতিক সংস্কার ও বৃহত্তর মানবাধিকার মরীচীকায় পরিণত হয়।
এরপর, এমবিএস বিশাল রাজকীয় পরিবারে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর দমন অভিযান চালিয়ে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। মতপার্থক্যের জায়গাটি ধুলোয় মিশিয়ে দেন তিনি। তার নেতৃত্বে ইয়েমেনে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে সৌদি আরব। কাতারে অবরোধ আরোপ করা হয়।
মাস দেড়েক আগে যখন সালমান আলাউদাকে আদালতে তোলা হয়, তখন তাকে বেশ দুর্বল ও ক্ষীণকায় দেখা গেছে। কারাগারেই তিনি শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলেন। তিনি অসংলগ্ন ছিলেন এবং দেখতে ও শুনতে তার অসুবিধা হচ্ছিল। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে লোকটাকে নিয়ে অধিকারকর্মীরা গর্ব করতেন, তাকে আজ্ঞাবহ মনে হচ্ছিল। তিনি মাথানত করে সবকিছুতে সম্মতি দিচ্ছিলেন। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ কল্পনা করে বাধ্য হয়ে তিনি হয়তো কোনো স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে স্বাক্ষর করেছেন।
নির্যাতন এবং একাকীত্বের কারণে তিন বছরে আলাউদার শরীর ও মন ভেঙে পড়েছে। জেদ্দার ধাহবান কারাগারে সেল থেকে জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে আনা-নেওয়ার সময় রক্ষীরা শিকল দিয়ে তার পা বেঁধে রাখতেন। আশপাশ যাতে দেখতে না পান, সেজন্য চোখ বেঁধে রাখা হতো। সাক্ষাতের সময় তিনি পরিবারকে জানিয়েছেন, জিজ্ঞাসাবাদকারীরা তাকে ঘুমাতে দেন না, ওষুধ নিতে দেন না।
কারাগার মানেই নির্যাতনের স্টিমরোলার। ওষুধ নিতে না দেওয়া এবং দুর্ব্যবহার সৌদি কারাগারগুলোতে স্বাভাবিক একটি বিষয়। ২০২০ সালের এপ্রিলে দেশটির বিখ্যাত সংস্কারপন্থী আবদুল্লাহ আল-হামিদকে নির্যাতন করে হত্যার জন্য সৌদি সরকারকে দায়ী করা হয়। কারাগারে নির্যাতনের শিকার হয়ে কোমায় চলে গিয়েছিলেন তিনি। তিনি যে দীর্ঘমেয়াদি ‘কার্ডিয়াক ক্যাথেটারাইজেশন’-এ ভুগছিলেন, সেকথা অস্বীকার করছিল সৌদি আরব। তার সহকর্মীরা অ্যামনেস্টিকে জানিয়েছেন, তিনি রিয়াদের আল-হাইর কারাগারের মেঝেতে পড়ে যান, হাসপাতালে নেওয়ার আগে তিনি কয়েক ঘণ্টা সেখানেই পড়ে ছিলেন।
আল-হামিদের মৃত্যুর তিন মাস পর, বিখ্যাত সাংবাদিক সালেহ আল-শেহি কারামুক্তির পরপরই অজানা রোগে মারা যান। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। যুবরাজের অফিসের সমালোচনা এবং দুর্নীতির অভিযোগ আনার পর ‘রাজকীয় আদালতকে অপমানের’ অপরাধে তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
কারাগারগুলোতে এমন নির্যাতন করা হয়, বন্দিদের ওপর এতে গভীর ও বিপজ্জনক প্রভাব পড়ে। প্রিজন সেলের অন্ধকারে এমন আচরণ করা হয়, বন্দি ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হন। কারা কর্মকর্তারা প্রকাশও করেন না, বন্দিদের কী খাওয়ানো হচ্ছে, তারা কী ওষুধ নিচ্ছেন।
এ প্রেক্ষাপটে সৌদি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার জন্য বিশ্বের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির অধিকারকর্মীরা। অধিকার নিয়ে কথা বলার কারণে আটক শত শত রাজনৈতিক বন্দির মুক্তিতে বিশেষ পদক্ষেপ চেয়েছেন তারা।
এমবিএসের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আস্কারা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার অন্ত নেই। সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যার পর ট্রাম্প উচ্চবাচ্য করলেও তার জামাতা জারেড কুশনারের সঙ্গে এমবিএসের আলোচনার পর বিষয়টা অন্যদিকে মোড় নেয়। এরপরই সাদ আল-জাবরিকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। এখন তাকে দায়মুক্তি দেওয়ার কথাও ভাবছে ট্রাম্প প্রশাসন। সৌদি আরব চাচ্ছে, ২০ জানুয়ারি বাইডেনের শপথ নেওয়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিক।
এখন দায়মুক্তি না পেলে সৌদি যুবরাজের জন্য কঠোর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনে রদবদল ঘটার পর নতুন প্রশাসনের কাছে তেমন সুনজর যে তিনি পাবেন না, সেটা প্রায় নিশ্চিত। এই দায়মুক্তি পেয়ে গেলে সৌদি রাজপরিবারের কড়া সমালোচক ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যার অভিযোগ থেকেও রেহাই পাবেন তিনি।
সৌদি আরবের ক্ষমতা এমবিএসের নিয়ন্ত্রণে আসার পর সবকিছু যেন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। পাল্টে যাচ্ছে দেশটির ভাবগম্ভীর চেহারাও। তার নেতৃত্বে দেশটির ভবিষ্যৎ কী, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশ্লেষকরা।