মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার চারটি দেশ সম্প্রতি ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এরপর জল্পনা শুরু হয়েছে যে প্রভাবশালী চারটি মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়াও সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে পারে। ইসরাইলি এক মন্ত্রীর বক্তব্যে গুজব আরও ডালপালা মেলেছে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যস্ততায় ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছে আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো ও সুদান। এরপর ইসরাইরের আঞ্চলিক সহযোগিতামন্ত্রী অফির আকুনিস একটি টিভি চ্যানেলকে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিদায় নেওয়ার আগেই আরও দুটি মুসলিম দেশ ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করবে।
তিনি বলেন, এর একটি উপসাগরীয় দেশ। তবে সেটি সৌদি আরব নয়। অপরটি একটি বড় মুসলিম দেশ। তার এ বক্তব্যে জল্পনা ছড়িয়ে পড়ে যে ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ কিংবা মালয়েশিয়া থাকতে পারে নতুন তালিকায়। বিশেষ করে নাম আসে বিশে^র বৃহত্তম মুসলিমপ্রধান দেশ ইন্দোনেশিয়ার। তবে এসব দেশ বিভিন্ন সময় ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছে।
তা সত্ত্বেও ইসরাইলি মন্ত্রীর ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য, ইহুদিবাদী দেশটির গণমাধ্যমের কয়েকটি প্রতিবেদন এবং আমেরিকার একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার ইন্দোনেশিয়াকে আর্থিক প্রলোভন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
এরই মধ্যে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করলে ইন্দোনেশিয়াকে কয়েকশত কোটি ডলার সহায়তা দেয়ার লোভনীয় প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির বিদেশে বিনিয়োগ বিষয়ক সরকারি সংস্থা ডিএফসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অ্যাডাম বোয়েলার এই তথ্য জানিয়েছেন।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লমমবার্গকে ২১ ডিসেম্বর এক সাক্ষাৎকারে বোয়েলার বলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কে গড়লেই তার সংস্থা থেকে ইন্দোনেশিয়াকে দ্বিগুণ অর্থ সহায়তা দেয়া হতে পারে। বর্তমানে মুসলিম দেশটিকে ১০০ কোটি ডলার দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ, মার্কিন শর্তে রাজি হলেই বিশ্বের বৃহৎ এই মুসলিম দেশটিকে ২০০ কোটি ডলার বা তারও বেশি অর্থ সহায়তা দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।
তিনি আরো জানান, এ বিষয়ে আমরা ইন্দোনেশিয়া সঙ্গে কথা বলছি। তারা যদি প্রস্তুত থাকে, তাহলে আমরা তাদের স্বাভাবিকভাবে যে অর্থ সহায়তা দেই, খুশি মনে তার চেয়েও বেশি দেব। এক্ষেত্রে, ইন্দোনেশিয়ার জন্য ডিএফসির অর্থ বরাদ্দ ১০০ বা ২০০ কোটি ডলার বাড়লেও অবাক হবেন না বলেও উল্লেখ করেন বোয়েলার।
তবে গত মাসের শেষদিকে ইন্দোনেশিয়া ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার পক্ষে আবারও দৃঢ় সমর্থন জানিয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসাবে ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানই ইন্দোনেশিয়ার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য বলে জানিয়েছে জাকার্তা।
১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে গড়ে ওঠা ইসরাইলের সাথে ইন্দোনেশিয়ার কোনও আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই। ফিলিস্তিনকে সমর্থনের জন্য জাকার্তা দেশটি থেকে আমদানিতে শুল্ক ছাড় দিয়েছে।
ইন্দোনেশিয়া খুব শিগগিরই ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে বলে এর আগে জেরুজালেম পোস্টসহ দেশটির বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ করেছে। তবে তা নাকচ করে দিয়েছে জাকার্তা।
ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তেউকু ফাইজাসিয়া এক বিবৃতিতে বিষয়টি স্পষ্ট করে জানান, ইন্দোনেশিয়া ইহুদীবাদী ইসরাইলকে কিছুতেই স্বীকৃতি দেবে না।
ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, ইসরাইলের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কোনো সম্ভাবনা নেই এবং ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কখনোই ইসরাইলের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।
দীর্ঘদিন ধরে ইন্দোনেশিয়া স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমর্থক। দেশটি সবসময় ইসরাইলের সঙ্গে যেকোনো ধরনের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কথা নাকচ করে এসেছে। গত ৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো ফিলিস্তিনের প্রতি তার দেশের অকুণ্ঠ সমর্থনের কথা পুর্ণব্যক্ত করেন।
সম্প্রতি আমিরাত ও সৌদি সরকার ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে জাকার্তাকে চাপ দিয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে। এ দেশ দুটির সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিমপ্রধান দেশ ইন্দোনেশিয়ায় উত্থান ঘটছে রাজনৈতিক ইসলামের। দেশটিতে ইসলামপন্থী সংগঠনগুলো এখন রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। এর ফলে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রনীতিতেও এসেছে দৃশ্যমান পরিবর্তন। মুসলিম ইস্যুতে সরব হয়ে উঠেছে জাকার্তা। ভারতে মুসলিম নিধন, রোহিঙ্গা গণহত্যা, ফিলিস্তিনে ইসরাইলের বর্বরতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ হয়েছে ইন্দোনেশিয়ায়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ইন্দোনেশিয়া বিষয়ক গবেষক এবং ‘পিস, ইসলাম অ্যান্ড পাওয়ার’ গ্রন্থের লেখক অ্যান্ড্রেস হারসোনো বলেছেন, গত দুই দশকে ইন্দোনেশিয়ায় রাজনৈতিক ইসলাম ব্যাপকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ফলে মধ্যপন্থী প্রেসিডেন্ট উইদোদের পক্ষে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব নয়।
এরপর পাকিস্তানের নামও উঠে আসে আলোচনায়।
যেসব মুসলিম দেশের সঙ্গে ইসরাইল সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে তার মধ্যে পাকিস্তানের নাম নেই বলে জানিয়েছে ইহুদিবাদী দেশটির মন্ত্রী অফির আকুনিস।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি বলেন, ফিলিস্তিন সংকট নিরসনের আগে ইসলামাবাদ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেবে না।
সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর এক উপদেষ্টা ইসরাইল সফর করেন বলে খবর প্রকাশ হয়। খবরে বলা হয়, আমিরাত ও সৌদি আরবের চাপে পড়ে ইসরাইলকে স্বীকৃতি এবং দেশটির সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে যাচ্ছে ইসলামাবাদ। পরে পাকিস্তান স্পষ্ট করেই জানায়, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া ইসরাইলের সাথে কোনো সম্পর্ক নয়।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নিজেই ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের বিষয়টি নাকচ করেছেন । এমন খবরকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলেও আখ্যায়িত করেছেন তিনি।
নূর দাহরি নামে যুক্তরাজ্যভিত্তিক এক গবেষক দাবি করেছেন, পাকিস্তান সরকার ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ তথ্য প্রকাশের পরপরই পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান একে ভিত্তিহীন ও মিথ্যা বলে নাকচ করেন।
তিনি পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, ইসরাইলকে যেহেতু ইসলামাবাদ স্বীকৃতিই দেয় না, তা হলে কেন তাদেও মন্ত্রী কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তেলআবিব সফর করবেন? এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন প্রতিবেদন।
গত আগস্টেও ইমরান খান বলেছিলেন, ইহুদিবাদী ইসরাইলের ব্যাপারে পাকিস্তানের নীতি অত্যন্ত স্পষ্ট এবং ‘আমরা কখনই ইসরাইল সরকারকে স্বীকৃতি দেব না।’ পাক প্রধানমন্ত্রী ‘দুনিয়া নিউজ’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহর নির্দেশ অনুযায়ী আমাদের নীতি নির্ধারিত হয়েছে। জিন্নাহ ইসরাইল সরকারের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিন জাতিকে সমর্থন জানাতে বলে গেছেন।’
তবে সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য কয়েকটি আরব দেশের চাপ থাকার কথা পরোক্ষভাবে স্বীকার করেন।
ইসরাইলি ওই মন্ত্রীর দাবির পর বাংলাদেশ সরকারও জানিয়েছে যে ইহুদিবাদী ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আগ্রহী নয় ঢাকা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। খবরে বলা হয়, ঢাকায় ওই কর্মকর্তা বলেছেন, ‘ইসরাইল-ফিলিস্তিÍন ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান আগের মতোই আছে।’ অর্থাৎ ফিলিস্তিনিদের অধিকার, স্বাধীনতা এবং মুক্তির পক্ষেই বাংলাদেশ।
গত মাসে ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সংহতি দিবসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ পৃথক বার্তা দিয়েছেন। এতে প্রধানমন্ত্রী তলেছেন, ‘পূর্ব জেরুজালেম-আল কুদস আল শারিফকে রাজধানী রেখে দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্বের আঙ্গিকে ১৯৬৭ সালের সীমানাভিত্তিক একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে আমরা আমাদের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করছি।’
শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাংলাদেশ নিজে স্বাধীনতার জন্য অনেক সংগ্রাম করেছে। তাই স্বাধিকারের প্রশ্নে বিশ্বের যেকোনো জাতির সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জানানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা রয়েছে।’
মালয়েশিয়াও একই ইঙ্গিত দিয়েছে। দেশটির উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ফিলিস্তিন ইস্যুতে আমাদের অবস্থান অপরিবর্তনীয়। মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ ইসরাইলের এক কড়া সমালোচক ছিলেন।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সামরিক প্রযুক্তি ও শক্তিমত্তায় ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যের বড় শক্তি হলেও দেশটি তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা রেখে নির্ভার হতে পারছে না। ইরান ও তুরস্কের মত বড় শক্তি তার অব্যাহত মাথাব্যথার কারণ।
আরবের স্বৈরশাসকরা ইসরাইলকে মেনে নিলেও জনগণের মধ্যে দেশটি সম্পর্কে তীব্র বিদ্বেষ রয়েছে। এরকম বৈরি পরিবেশে টিকে থাকতে ইসরাইলকে প্রতিনিয়ত গলদঘর্ম থাকতে হয়। ইসরাইলের পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকার তালিকায় তাই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মুসলিম দেশগুলোর স্বীকৃতি আদায়। এটা সম্ভব হলে দেশটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ঝুকি অনেকটাই কমে যাবে বলে করছে তেল আবিব।