কাতারের ওপর উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের আরোপিত অবরোধ যে ব্যর্থ হতে যাচ্ছে তা অন্যরা আগে বুঝলেও সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের বুঝতে সাড়ে তিন বছর লেগেছে। প্রতিবেশী একটি স্বাধীন দেশের উচ্চকণ্ঠ থামিয়ে দিতে সৌদি আরব ও তার মিত্ররা কাতারে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছিল। শেষ পর্যন্ত কাতারের ওপর অবরোধ তুলে নিয়ে বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন যেভাবে কুয়েত দখল করেছিলেন, সৌদি আরব ও তার মিত্ররাও একইভাবে কাতার দখল করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের এই পরিকল্পনার কথা জেনে যান তৎকালীন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন। তেল ব্যবসায় জড়িত থাকার সুবাদে কাতারের সাথে টিলারসনের ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। শীর্ষ এই দুই মার্কিন কর্মকর্তা কাতারে হামলার সৌদি পরিকল্পনা বাতিল করতে যুবরাজ সালমানকে চাপ দেন। ফলে সৌদি আরব হামলার পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়।
এরপর যতই সময় গড়াতে থাকে কাতারের অবস্থান ততই শক্তিশালী হতে থাকে। এরইমধ্যে তুরস্কের সৈন্যরা কাতারে এসে পৌঁছে একটি শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করে, যাতে সৌদি বাহিনী দ্রততার সাথে কাতরে প্রবেশ করতে না পারে। ইরান তার আকাশপথ ব্যবহারের অনুমতি দেয় কাতারকে। ফলে কাতারের ওপর আরোপিত অবরোধ অকার্যকর হয়ে যায়। এই অবরোধের কারণে কাতারের অবস্থান আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে তুরস্ক ও ইরানের পররাষ্ট্রনীতিও কাতারকে ঘিরে নতুন মাত্রা লাভ করে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত কাতারের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ আল ওতাইবা ওয়াশিংটনের সরকারি মহলের সাথে যোগাযোগ বাড়িয়ে দেন। তিনি সেখানে সৌদি আরবের পক্ষে কাজ করা লবিস্টদের হটিয়ে দিয়ে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেন। ফলে ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে কাতারের সম্পর্ক আরও জোরালো হয়ে ওঠে এবং কাতারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনও বেড়ে যায়। কিন্তু তারপরও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কাতারের ওপর আরোপিত জিসিসি’র অবরোধের প্রতি তার সমর্র্থন জানান। অথচ কাতারের আল ওবেইদে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন বাহিনীর সবচেয়ে বড় বিমান ঘাঁটিটি রয়েছে। মার্কিন সামরিক বাহিনীও ট্রাম্পের এই পদক্ষেপকে ভালোভাবে নেয়নি।
সৌদি যুবরাজ সালমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রভাবের বিষয়টিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছিলেন এবং মার্কিন সামরিক বাহিনীর হাতেও যে অনেক ক্ষমতা আছে সেটাকে উপেক্ষা করেছিলেন। কাতারকে উচিত শিক্ষা দিতে গিয়ে যুবরাজ সালমান যে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলেন তা তিনি আগে বুঝতে পারেননি। যখন বুঝতে পারলেন তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ততদিনে কাতারের হাত অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়ে গেছে। কাতার ততদিনে তার মিত্রের সংখ্যা বাড়িয়ে নিজের অবস্থান শক্ত করে ফেলেছে।
ইতিমধ্যে ট্রাম্পেরও মেয়াদ শেষের পথে চলে এসেছে এবং নির্বাচনেও পরাজিত হয়েছেন। ক্ষমতায় আসছেন ডেমোক্রেট দলের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সৌদি যুবরাজের নানা রকম বিতর্কিত কর্মকান্ডকে বাইডেন কখনোই ভালোবাবে দেখেননি। বাইডেন ক্ষমতায় আসায় বাধ্য হয়েই যুবরাজ সালমানের হুশ ফিরেছে এবং তিনি দ্রুত কাতারের সাথে সমঝোতায় আসার ও অবরোধ প্রত্যারের সিদ্ধান্ত নেন।
সৌদি আরবে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের শীর্ষ সম্মেলন শুরু হবার আগের দিনই তড়িঘড়ি করে কাতারের সাথে সমঝোতা চুক্তি করেন। অবরোধ প্রত্যাহারের জন্য কাতারকে যে ১৩টি শর্ত দেয়া হয়েছিল তার একটিও কাতার মেনে না নিলেও শেষ পর্যন্ত চুক্তি করা হয়। মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যদেরকে কাতারে আশ্রয় দেয়া বন্ধ করা ও পররাষ্ট্র নীতির পরিবর্তন কোনটিই করেনি কাতার। আলজাজিরা বন্ধের দাবিও মানা হয়নি। তুরস্ক ও ইরানের সাথে কাতারের সম্পর্কও আগের চেয়ে আরো জোরদার হয়েছে।
নিজ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অবিচল থাকায় কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সম্মান ও মর্যাদা তার দেশের জনগণের কাছে হাজার গুণ বেড়েছে। কাতারের জনগণের মধ্যে বেড়েছে জাতীয়তাবাদী চেতনাও। অবরোধের আগে কাতারের যে অবস্থা ছিল তার চেয়ে এখন দেশটির আত্মবিশ্বাস বহুগুণে বেড়ে গেছে।
সাড়ে তিনবছর আগে কাতারের ওপর অবরোধ আরোপের কট্টর সমর্থক ছিলেন দুবাইয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আব্দুল খালেক আব্দুল্লাহ। এখন তিনি বলছেন, ‘আপনারা বলতে পারেন কাতারই জিতেছে’। ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘লড়াই করতে গিয়ে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। কিন্তু এখন সবাই এটা অনুধাবন করতে পারছে যে, কাতার হচেছ জিসিসি পরিবারের একটি দুষ্ট ছেলে, তাকে মেনে নিয়েই সবাইকে চলতে হবে। জিসিসি’র ইতিহাসে এই সাড়ে তিন
কাতারের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে কি জিসিসি’র ঐক্য আবারো জোরদার হয়েছে? কিংবা বিভেদের চিহ্ন দূর হয়ে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আরো সুদৃঢ় হয়েছে? তা অবশ্য কোনভাবেই বলা যাবেনা। কারণ এই শীর্ষ সম্মেলনে আবুধাবীর যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ যেমন আসেননি, তেমনি অনুপস্থিত ছিলেন বাহরাইনের বাদশাহ হামাদ ও মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাতাহ আল সিসি। সৌদি বাদশাহ সালমানও সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না।
কাতারের সাথে বাহরাইনের সীমান্ত নিয়ে তিক্ততা রয়েছে। অন্যদিকে মিসর কাতারের সাথে নতুন করে সম্পর্ক জোড়া লাগাতে ই”ছুক নয়। কারণ কায়রো মনে করে কাতার মিসরের বর্তমান শাসকদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে। তারা মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতাদের আশ্রয় ও নানাভাবে সহায়তা দিয়ে যা”েছ।
সৌদি যুবরাজ সালমানের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাতের যুবরাজ বিন জায়েদেরও বিরোধ চলছে নানা বিষয় নিয়ে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ইয়েমেন ইস্যু। ইয়েমেনে ২০১৫ সালের মার্চে শুরু করা সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের হামলার নেতৃত্বে সৌদি আরব নাকি সংযুক্ত আরব আমিরাত রয়েছে তা নিয়েও রয়েছে অস্পষ্টতা। ইয়েমেনের দক্ষিনাংশের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে আমিরাতের অনুগত ও অর্থায়নে পরিচালিত মিলিশিয়া বাহিনীর হাতে। অন্যদিকে উত্তর ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীদের সাথে লড়াই করছে সৌদি আরব।
উত্তেজনার দ্বিতীয় ইস্যুটি হচ্ছে ইসরাইল। আমিরাত ইসরাইলের সাথে দ্রুত সম্পর্ক স্বাভাবিক করে ইতিমধ্যেই পারস্য উপসাগরীয় এলাকায় ইহুদি রাষ্ট্রটির ঘনিষ্ঠ মিত্রে পরিণত হয়েছে। এই দু’টি দেশেরই রয়েছে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী। বাহরাইনের সাথেও ইসরাইলের সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে। তাদের মধ্যে অতিরিক্ত সখ্যতা সৌদি আরব ও মিসরের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি করেছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত উপসাগরীয় অঞ্চলে নিজেকে ইসরাইলের প্রধান মিত্র দেশ হিসেবে যে দাবি করে থাকে তা সৌদি আরবের ভবিষ্যৎ শাসক অর্থাৎ যুবরাজ সালমানের জন্যও সমস্যা তৈরি করতে পারে।
কাতারের সাথে সম্পর্ক স্থাপন বা সমঝোতার ক্ষেত্রে যুবরাজ সালমানের উদ্দেশ্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটানো। আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে কাতার নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া বিশেষ করে বহুল প্রচারিত আলজাজিরার আরবি চ্যানেলের মাধ্যমে বৃহত্তর আরব জনগোষ্ঠির কাছে পৌছানো। কেননা আরব জনগণের কাছে আল জাজিরার আরবি চ্যানেলের বিরাট গ্রহনযোগ্যতা রয়েছে।
সাধারণ আরবরা মনে করেন, আল জাজিরা স্বাধীনভাবে তাদের রিপোর্ট বা খবর প্রচার করতে পারে। এতে সত্য তথ্যটা জানা যায়। কিন্তু সৌদি আরব, মিসর বা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের মিডিয়া সরকারের নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় সেগুলোর প্রতিবেদনে প্রকৃত তথ্য উঠে আসেনা। যুবরাজ সালমান আলজাজিরার এই গ্রহনযোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে নিজের ইমেজকে বাড়াতে চাইছেন। এরই এক পর্যায়ে তিনি তার পিতা বাদশাহ সালমানকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই সিংহাসনে বসতে চান। এছাড়া তিনি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের মতো ইসরাইলের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করে এক পর্যায়ে দেশটিকে স্বীকৃতি দিতে চান। ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘ দিনের সংগ্রাম ও স্বার্থ রক্ষা এক্ষেত্রে তার কাছে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
যুবরাজ সালমান তার এই উদ্দেশ্য দুটি পূরণের এখনই উপযুক্ত সময় বলে মনে করছেন। ক্ষমতার মসনদে বসার জন্য তিনি চেষ্টা শুরু করেন। প্রথম থেকেই তিনি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু ও ট্রাম্পের উপদেষ্টা ও জামাতা জারেড ক্রুশনারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন। জারেড কুশনার সৌদি আরবে জিসিসি শীর্ষ সম্মেলনও উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে তার উপস্থিতি অনেকের মধ্যেই নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে।
ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়টি নিয়ে সৌদি প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায় থেকে নিম্ন স্তর পর্যন্ত মারাত্মক বিভাজন তৈরি হয়েছে। রাজপরিবারের পররাষ্ট্র নীতির যারা নির্ধারক তারা তো প্রকাশ্যেই ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিরোধিতা করছেন। বিশেষ করে দেশটির সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী প্রিন্স তুর্কি আল ফয়সাল কোনভাবেই ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পক্ষে নন। বাদশাহ সালমান নিজেও এর বিপক্ষে। ইসরাইলের সথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ সৌদি আরবের সাধারণ জনগণের মধ্যেও মারাত্মক বিরুপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে।
বিন সালমান এখন চেষ্টা করছেন ইসরাইলের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়টি নিয়ে আরব মিডিয়া বা গণমাধ্যম যেন সমালোচনামূখর বা সরব না হয়। তিনি তার এই উদ্যোগের ব্যাপারে এসব মিডিয়ার নীরব ভূমিকা দেখতে চান।
বিশেষ করে কাতারের আলজাজিরা যেন এ ব্যাপারে সোচচার না হয় সে জন্যই তিনি প্রায় বিনাশর্তে কাতারের সাথে সমঝোতা করেছেন। ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার বিন সালমানের উদ্যোগ সফল হলে খুব খুশিই হবেন নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। কিন্তু এটা আরব বিশ্বে যে বড় ধরনের বিতর্ক ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।