বিশ্ববাসী বেশ অবাকই হয়েছিল, যখন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ঘোষণা করেন, চলতি বছরই ফিলিস্তিনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, ফিলিস্তিনের প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মাঝে বিরোধ কমিয়ে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসার জন্যেই তিনি নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন।
ফিলিস্তিনে সর্বশেষ সংসদ নির্বাচন হয়েছে ১৫ বছর আগে। আর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর ১৬ বছর পার হয়ে গেছে। সর্বশেষ ফিলিস্তিনের মানুষ ইয়াসির আরাফাতের উত্তরসুরী নির্ধারণের জন্যই ভোট প্রদান করার সুযোগ পেয়েছিল। তারপর অনেকটা সময় চলে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও ঘটনা প্রবাহও অনেকটা পাল্টে গেছে।
২০০৪ সালের শেষদিকে যখন আরাফাত মারা যান, তখনও ইরাক যুদ্ধের চূড়ান্ত পরিণতি স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। এর দুই বছর পর হামাসের সাথে ইসরাইলের রক্তক্ষয়ী সংঘাত শুরু হয়। আর ২০১০ সালে আরব বসন্তের হাওয়া লাগে মধ্যপ্রাচ্যে। বর্তমানে ফিলিস্তিনসহ গোটা অঞ্চলে যে নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে আদৌ এ বছর নির্বাচনের আয়োজন করা যাবে কিনা তা পরিষ্কার নয়।
সত্যি যদি নির্বাচন হয় তাহলে গণতান্ত্রিক একটি রূপান্তরের পথ শুধু উন্মুক্ত হবে না, আব্বাসের মতো মেয়াদোত্তীর্ণ একটি প্রজন্মও দম ছাড়ার সুযোগ পাবেন। আব্বাসের বর্তমান বয়স ৮৫ বছর। তার বয়সের সাথে সেকেলে চিন্তার লোকের সরে যাওয়াটা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে আগামী মে বা জুলাই মাসে এ নির্বাচন হতে পারে। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের গণতান্ত্রিক কর্মকৌশলের ফায়দা নিতে চাইছেন বলেই মনে হচ্ছে। তিনি গণতান্ত্রিক নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রশাসনের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করছেন বলেও বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
বাইডেনের নয়া প্রশাসনও ফিলিস্তিনে নতুন নির্বাচন প্রত্যাশা করেছিল। মাহমুদ আব্বাসের মেয়াদ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়েছে ২০০৯ সালে। তার প্রশাসনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগও রয়েছে। তিনি দুই রাষ্ট্র তত্বের কথা বললেও কার্যত তার সময়ে ফিলিস্তিনিরা সবচেয়ে বেশি ভূমি হারিয়েছে আর স্বাধীন ও স্বার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কোনো সম্ভাবনাও আপাতত দেখা যাচ্ছে না।
এবারের এই নির্বাচনেও হয়তো মাহমুদ আব্বাসই ফাতাহ’র প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। তার বয়স ৮৫ পার হয়েছে। ফলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মাদ শাত্তেহ যদি প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়াতে চান তাহলেও তিনি ভালো সমর্থন পাবেন। এর আগে ২০১১ সালে হামাসের সাথে সমঝোতায় ব্যর্থ হওয়ার পর আব্বাস ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি আর প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করতে আগ্রহী নন। অন্য অনেক প্রতিশ্রুতির মতো এই প্রতিশ্রুতিও আব্বাস রক্ষা করতে পারেননি। ফিলিস্তিনিরা আব্বাসকে এ পদে দেখতে আর আগ্রহী নন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমলে আব্বাসের দুমুখো কথাবার্তা দেখে জনগণ ছিলো অনেকটাই হতাশ।
মাহমুদ আব্বাস এবং তার প্রশাসন দুই রাষ্ট্র তত্বের ওপর ভর করেই ফিলিস্তিনকে পরিচালনা করার চেষ্টা করেছে। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির মধ্য দিয়ে এ ধারণার আবির্ভাব হলেও এটি কখনো ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের জনগনের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ফলে এ চিন্তাধারা অনেক আগেই রাজনৈতিক উপযোগিতা হারিয়ে ফেলেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ ইসরাইলের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করায় অসলো চুক্তি বা দুই রাষ্ট্রের ধারণা এখন অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়েছে। বিগত বছরগুলোতে দুই রাষ্ট্র তত্ব বাস্তবায়নে মাহমুদ আব্বাসের চেয়ে বেশি আগ্রহী রাজনীতিবীদ ফিলিস্তিন বা ইসরাইল কোথাও আর দেখা যায়নি। ১৫ বছর আগে তিনি ইয়াসির আরাফাতের রেখে যাওয়া কাজটিকে এগিয়ে নেয়ার বলিষ্ঠ ঘোষণা দিলেও আজ অবধি শান্তি প্রক্রিয়াকে কার্যকর করতে পারেননি। তিনি এখনও সেই পুরনো ধারনার ওপর ভর করেই আরেকবার চেষ্টা চালাতে চান। কিন্তু নতুন প্রজন্ম আর এ ভাবনাকে ধারণ করতে চাইছে না। তারা এ বছরের মধ্যেই নিজেদের হাতে দায়িত্ব তুলে নিয়ে ফিলিস্তিন ইস্যুকে নতুন করে সমাধান করতে চায়।
আব্বাসের হাত থেকে ক্ষমতা চলে গেলে দুই দেশের রাজনৈতিক কৌশল ও উদ্দেশ্যেই ব্যাপক পালাবদল আসতে পারে। নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন কেউ ক্ষমতা পাওয়ার বিষয়টিকে প্রাথমিকভাবে একে খুব সাদামাটা মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে ফিলিস্তিনের জন্য এ বদলটি নতুন একটি রাজনৈতিক ভুমিকম্পের সূচনাও করতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ফিলিস্তিন বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গিতেও বিগত তিন যুগে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। অথচ ফিলিস্তিনের জনগণ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এসব কর্মকান্ডের কোনো ফায়দা পাচ্ছে না। সবাই শুধু রাজনীতিই করে গেছে, কিন্তু জনগনের ভাগ্যে প্রত্যাশিত সেই পরিবর্তন আজও আসেনি।
মাহমুদ আব্বাস সম্ভবত ফিলিস্তিনের সর্বশেষ নেতা যিনি অসলো চুক্তির ওপর ভরসা রাখেন। কিন্তু তিনি এর বাস্তবায়ন করতে পারেননি, ভবিষ্যতেও পারবেন বলে মনে হয় না। যদি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব থেকে তাকে সরে যেতে হয় তাহলে নতুন প্রজন্মের নেতা এসে সম্ভবত অসলো চুক্তিকে নিয়ে এগুতে চাইবেনা। বরং এক রাষ্ট্রকেন্দ্রিক একটি সমাধানের পথেই তিনি হাটতে চাইবেন। ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের অভ্যন্তরে, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যে বা আন্তর্জাতিক কাঠামোতেও নিশ্চয়ই কিছু মানুষ এখনও আছেন যারা অসলো চুক্তির সমাপ্তি টানতে চান। কিন্তু বিষয়টা খুব সহজ নয়।
ইসরাইলে কিছু ডানপন্থী রাজনীতিবীদ আছেন যারা মনে করেন, অসলো চুক্তি অকার্যকর হয়ে পড়লে তারা ফায়দা পাবেন। আরো কিছু সেনা মোতায়েন করবেন। ফিলিস্তিনের মাটিতে চেকপয়েন্টের সংখ্যা বৃদ্ধি করবেন। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে জেরুজালেম ছাড়া অন্য কোনো এলাকাকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করবেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ফিলিস্তিনের মানুষ আর ম্যানেজড হতে চায় না। বরং তারা সুনির্দিষ্ট সমাধান ও প্রস্তাবনা চায়। যদি পরবর্তী প্রজন্মের নেতৃত্ব তাদেরকে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিকল্প কোনো ধারনা দিতে পারে তাহলে ফিলিস্তিনের জনগণ যে তা লুফে নেবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
পশ্চিম তীরের রাস্তায় রাস্তায় যে ব্যারিকেড ও চেকপয়েন্টগুলো এখন দেখা যাচ্ছে এর সবটাই অসলো চুক্তির পরিণতি। ২৭ বছর আগে এ চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে, এর মধ্যে কাজের কাজ এটুকুই হয়েছে যে, ইসরাইল সাময়িক নজরদারির নামে দখলকৃত এলাকায় শুধু নিজেদের নিয়ন্ত্রনই প্রতিষ্ঠা করেছে। ফিলিস্তি নি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্টের পদটি অনেকটা কর্তৃত্বপরায়ণ অবস্থানের মতোই। আন্তর্জাতিক পরিসরেও মাহমুদ আব্বাসের এখন আর কোনো ইতিবাচক ভাবমূর্তি নেই। তাই বাইরের দেশগুলো থেকে ফিলিস্তিনে অর্থ সাহায্য যাওয়ার পরিমানও বিগত বছরগুলোতে অনেকটাই কমে গেছে।
আন্তর্জাতিক তহবিল থেকে টাকা না আসলে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে যায়। আব্বাসের সময়ে বিগত কয়েক বছরে তেমনটাই ঘটেছে। আবার যখন টাকা আসে, তখন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ দখলদারদের প্রতিরোধের শ্লোাগান থামিয়ে দিয়ে কুটনীতির কৌশলের ওপর আস্থা রাখে। আর কুটনৈতিক ক্ষেত্রে অসম চুক্তির জেরে দিন শেষে লাভের পুরোটা যায় ইসরাইলের পকেটে আর ফিলিস্তিনের লোকসানের পাল্লা শুধু ভারীই হয়ে যায়।
মাহমুদ আব্বাসের বিগত ১৫ বছরের শাসনামলে দেখা গেছে তার সকল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আস্থায় নেয়ার উদ্দেশ্যেই হয়েছে। কিন্তু ফিলিস্তিনের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো চাহিদাই আজ অবধি পূরণ হয়নি। আব্বাস ফিলিস্তিনের স্বার্থ রক্ষা তো করতে পারেননি, এমনকি ফিলিস্তিন বিষয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র যে বয়াণ তৈরি করেছে, তার বিকল্প কোনো বয়াণও তিনি দাঁড় করাতে পারেননি।
বাইডেন যদি ফিলিস্তিন ইস্যুতে ট্রাম্পের অবস্থানই অনুসরণ করেন এবং দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বিষয়ক দৃষ্ঠিভঙ্গি লালন করেন, তাহলে আব্বাস কিছুটা সুবিধা পেতে পারেন। আব্বাস হয়তো তেমনটাই আশা করছেন বলে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। কারণ অসলোর সেকেলে চিন্তাকে পাল্টে কঠোর অবস্থান নেয়ার মতো মানসিকতা বা বলিষ্ঠতা কোনোটাই আব্বাসের নেই। মাহমুদ আব্বাস শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হতে দেবেন কিনা তা অনিশ্চিত।
তবে তার নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে স্বস্তি দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের যেকোনো নতুন পরিস্থিতিকে সামনে রেখে আব্বাস এ নির্বাচনকে স্থগিতও করে দিতে পারেন। নিকট অতীতে এমন নজিরও তার দিক থেকে রয়েছে।
সার্বিকভাবে মাহমুদ আব্বাসের নির্বাচন আয়োজনের এ ঘোষণাকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ফিলিস্তিনের গণতন্ত্রের চাতুর্যতা হিসেবেই বিবেচনা করছেন। গণতন্ত্রের এসব টাটকা শ্লোগানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অনেকটা মোহিত হলেও ফিলিস্তিনের মানুষের জন্য এসব এখন আর আশা সৃষ্টি করে না।
নতুন কোনো ভাবনা নিয়ে কোনো নেতৃত্ব আসবেন এবং ফিলিস্তিনের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে কর্মকৌশল প্রনয়ন করবেন এমনটা তারা আশা করেন। এবারের নির্বাচনে এমন নেতৃত যদি বেড়িয়ে আসে তা হবে ফিলিস্তিনিদের জন্য বড় পাওয়া। আব্বাসের সেকেলে চিন্তাকে যারা চ্যালেঞ্জ করবেন ফিলিস্তিনের জনগণ তাদের দিকে ঝুঁকবেন। এ কারণেই অনেকে আশংকা করছেন , আব্বাস যদি বুঝতে পারেন ক্ষমতা তার এবং তার দলের বাইরে হামাস বা অন্য কোনো দলের হাতে চলে যাবে তাহলে নির্বাচণের ঘোষণা দিয়েও শেষ মুহূর্তে তিনি সরেও আসতে পারেন।