আয়রন ডোম ইসরায়েলকে বাঁচাতে পারবে?


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ২৬ মে ২০২১, ১৫:১৯

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বড় একটি প্রকল্প আয়রন ডোম এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। কোটি ডলারের এই প্রজেক্ট ইসরায়েলের গর্বেরও একটি বিষয়। চারপাশের দেশগুলোর থেকে ইসরায়েলকে নিরাপদ রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি তৈরি করে তেলআবিব। এর আগে আয়রন ডোমকে কোনো পরীক্ষায় পড়তে না হলেও হামাসের সাথে সর্বশেষ যুদ্ধে এটির দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। বলা হচ্ছে, বড় হামলার মুখে পড়লে মুখ থুবড়ে পড়তে পারে এটি।

সর্বশেষ ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটে আলোচনায় এসেছে ইসরায়েলের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম আয়রন ডোম। ইসরায়েলের তৈরি এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি যেমন ইসরায়েলকে হামাসের রকেট বৃষ্টি থেকে রক্ষা করেছে, আবার বেশ কয়েকবার এর রক্ষণব্যুহ ভেদ করতে পেরেছে হামাসের ছোড়া রকেট।

খোদ ইসরায়েলের অনেক বিশ্লেষক আয়রন ডোমের সমালোচনা করছেন। কেউ বলছেন, হামাসের সাধারণ রকেটই যদি এটিকে ফাঁকি দিতে পারে, তবে ইরান বা অন্য কোনো দেশ আধুনিক মিসাইল ছুড়লে কী হবে পরিণতি? আবার ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বিভাগ স্বীকার করছে, আয়রন ডোমের সফলতার হার ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ।

ফলে বাকি ১০ থেকে ১৫ শতাংশ রকেট ঠেকানোর ঘাটতি ইসরায়েলিদের মনে ভীতি ছড়িয়ে দিচ্ছে। অথচ আয়রন ডোম নিয়ে ইসরায়েলে গর্বের শেষ ছিল না। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও এই ডিফেন্স ব্যাটারির দুটি ইউনিট কিনেছে। কিন্তু তাদেরও এখন আয়রন ডোম নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে কিনা সেই প্রশ্ন উঠেছে বিশেষজ্ঞদের মাঝে।

আয়রন ডোম এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের নির্মাতা যৌথভাবে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা সামগ্রী প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেম ও ইসরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ। আর এই প্রকল্পে নগদ অর্থ ও কারিগরি সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। স্বল্পপাল্লার রকেট ও মর্টার শেল প্রতিরোধ করতেই এটি তৈরি করা হয়েছে।

২০০৬ সালে লেবাননের মিলিশিয়া গোষ্ঠি হিজবুল্লা’র সাথে যুদ্ধের সময় নতুন একটি স্বল্পপাল্লার এন্টি মিসাইল সিস্টেমের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ইসরায়েল। ওই যুদ্ধে চার হাজারের বেশি স্বল্পপাল্লার রকেট ছুড়েছে হিজবুল্লাহ। এসব রকেট আঘাত হেনেছে হাইফা নগরীসহ ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় এলাকায়। এতে নিহত হয় ৪৪ ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিক। ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে হয় আড়াই লাখ লোককে।

হিজবুল্লার রকেট হামলা ঠেকাতেই স্বল্পপাল্লার এয়ারডিফেন্স সিস্টেমের গুরুত্ব অনুভব তেলআবিব। আবার দক্ষিণ দিক থেকে হামাসের রকেট হামলাও চলতে থাকে বিভিন্ন সময়। শেষ পর্যন্ত ২০০৭ সালে আয়রন ডোম তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় ইসরায়েল।

আয়রন ডোমের প্রথম ইউনিটটি ২০১১ সালে সার্ভিসে যুক্ত হয়। এটি চার থেকে ৭০ কিলোমিটার দূর থেকে উড়ে আসা রকেট বা মর্টার শেল ধ্বংস করতে পারে। আয়রন ডোমের একটি বৈশিষ্ট হচ্ছে এটি উড়ে আসা রকেটের গতিপথ বিশ্লেষণ করে দ্রুত বলে দিতে পারে সেটি বিপজ্জনক কি না। যদি রকেটটি জনবসতিপূর্ণ এলাকায় পড়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে আয়রন ডোম একটি ইন্টারসেপ্টর লঞ্চ করে, সেই সাথে বাজে সাইরেন। ইন্টারসেপ্টরটি আকাশে উড়ে আসা রকেটটির কাছে গিয়ে বিস্ফোরিত হয় এবং রকেটটিকে ধ্বংস করে। এ সব কিছুই সম্পন্ন হয় রকেট ছোড়ার ৯০ সেকেন্ডের মধ্যে।

আয়রন ডোমের প্রতিটি ইউনিটে তিন অথবা চারটি মিসাইল লঞ্চার থাকে। প্রতিটি লঞ্চারে মোতায়েন থাকে ২০টি করে তামির মিসাইল। এখন পর্যন্ত ১০টি আয়রন ডোম ইউনিট তৈরি করেছে ইসরায়েল। ইসরায়েলকে পুরো নিরাপত্তা চাদরে ঢাকতে এর ১৩টি ইউনিট প্রয়োজন বলে জানিয়েছে দেশটির প্রতিরক্ষা বাহিনী। তাই আরো কিছু আয়রন ডোম ইউনিট নির্মাণাধীন রয়েছে। এই প্রকল্পে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিয়েছে পেন্টাগন।

যদিও বলা হচ্ছে এবারের যুদ্ধে গাজা উপত্যকা থেকে হামাসের ছোড়া রকেটের হাত থেকে ইসরায়েলকে বাঁচিয়ে দিয়েছে আয়রন ডোম। তবে এই প্রতিরক্ষা যন্ত্রটির অনেক দুর্বলতাও ধরা পড়েছে। ইসরায়েলি সংবাদ মাধ্যম জেরুসালেম পোস্ট দেশটির সামরিক কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলেছে, আয়রন ডোমের সফলতার হার ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ।ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর মুখপাত্র হিদাইল জিলবারম্যানও স্বীকার করেছেন একথা। অর্থাৎ ইসরায়েলি জনগনকে শতভাগ সুরক্ষা দিতে পারছে না সেটি।

এক সাথে অনেক রকেট উড়ে এলেও আয়রন ডোম সবগুলোকে প্রতিহত করতে পারে না। ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের রকেট হামলার সক্ষমতা আগের চেয়ে অনেকগুণ বেড়েছে। ২০১৪ সালের যুদ্ধে হামাস সব মিলে রকেট ছুড়েছিল ৪ হাজারের মতো, কিন্তু সেটি ছিলো পঞ্চাশ দিনব্যাপী। এবার সে তুলনায় অনেক বেশি রকেট ছোড়া হয়েছে গাজা উপত্যকা থেকে। কয়েক মিনিটের মধ্যে শতাধিক রকেট ইসরায়েলি ভূখণ্ডের দিকে উড়ে যেতে দেখা গেছে। আর হামাসের এই রকেট সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াতেই দুর্বলতা ধরা পড়েছে আয়রন ডোমে।

আয়রন ডোমের দুর্বল দিকগুলো চিহিৃত করতে পেরেছে হামাস। ফলে তারা এখন হামলার কৌশল পাল্টাতে পারে। বিশেষ করে এক সাথে ঝাকে ঝাকে রকেটের হামলা সামলাতে পারে না আয়রন ডোম। হামাসের রকেট হামলার সক্ষমতা ক্রমশই বাড়ছে। এর ফলে আরো বড় পরীক্ষার মুখে পড়তে হতে পারে আয়রন ডোমকে। হামাস যদি বারবার হামলা না চালিয়ে এক সাথে অনেক বেশি রকেট ছোড়ে তাহলে ইসরায়েলের বড় ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

হামাস এখন যে রকেট ছোড়ে সেগুলো আনগাইডেড ও সেকেলে পদ্ধতির। তারা যদি গাইডেড রকেট ছোড়ার সক্ষমতা অর্জন করে কিংবা হামাস ছাড়া অন্য কোন দেশ বা গোষ্ঠির সাথে সঙ্ঘাত হলে ইসরায়েলকে বিপদে পড়তে হবে।

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন, লেবাননের হিজবুল্লার রকেট ছোড়ার সক্ষমতা হামাসের চেয়ে বেশি। এবং তাদের রকেট প্রযুক্তিও হামাসের চেয়ে উন্নত। ইসরায়েলি সংবাদ মাধ্যমের তথ্য মতে হিজবুল্লাহর কাছে রকেটের মজুদ রয়েছে দেড় লাখেরও বেশি। তারা প্রতিদিন এক হাজারেও বেশি রকেট ছুড়তে পারে। তাই হিজবুল্লাহর সাথে যুদ্ধ বাধলে আয়রন ডোম ইসরায়েলে বড় ধরনের প্রাণহানী এড়াতে পারবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।

ইসরায়েলি সংবাদ মাধ্যম জেরুসালেম পোস্টের এক নিবন্ধে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, হামাস যদি দূরপাল্লার রকেট ছুড়তে শুরু করে তাহলে কি করবে ইসরায়েল? কিংবা ইরান বা হিজবুল্লাহর সাথে যুদ্ধ বাধলে তারা ঝাকে ঝাকে রকেট ছুড়তে পারবে ইসরায়েলের বিভিন্ন শহর লক্ষ্য করে। সেক্ষেত্রে আয়রন ডোম কতটা সুরক্ষা দিতে পারবে ইহুদিবাদী দেশটিকে?

আসলে আয়রন ডোম নামক প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের যে দুর্বলতাগুলো ধরা পড়েছে তাতেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে ইসরায়েলিদের মাঝে। হামাসের মতো ছোট্ট একটি গোষ্ঠির হামলা থেকেই পুরোপুরি সুরক্ষা দিতে পারেনি আয়রন ডোম। ভবিষ্যতে বড় কোন যুদ্ধ বাধলে তাদের পরিণতি কী হবে সেই চিন্তা ভাবনা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। চিন্তুা শুরু হয়েছে মার্কিন মুল্লুকেও।

মার্কিন সাংবাদিক ও প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ফ্রেড কাপলান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিরক্ষা সামগ্রীটির ব্যবহার নিয়ে আবারো নতুন করে ভাবা উচিত। কারণ ইসরায়েল যাদের সাথে লড়াই করে, সেই হামাস বা হিজবুল্লাহর চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুরা অনেকগুন শক্তিশালী।

জার্মান সংবাদ মাধ্যম ডয়েচে ভেলে জানিয়েছে, আয়রন ডোমের আরেকটি সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, এটি প্রতিটি রকেট ধ্বংস করতে দুটি করে প্রোজেক্টাইল ছোড়ে। প্রতিটি প্রজেক্টাইলের খরচ ৮০ হাজার মার্কিন ডলারের আশপাশে।এই প্রকল্প চালু রাখতে হলে প্রচুর খরচ করতে হবে তেল আবিবকে। যে কারণে আয়রন ডোমকে শুধুমাত্র জনবহুল এলাকার দিকে উড়ে আসা রকেট সামলাতে মোতায়েন রাখা হয়েছে।

এছাড়া আয়রন ডোমে যে তামির মিসাইল ব্যবহৃত হয়, ইসরায়েলের কাছে তা সব সময় যথেষ্ট পরিমানে মজুদ থাকে না। অনেকেই মনে করছেন, ইসরায়েলকে যতটা অপ্রতিরোধ্য ও সুরক্ষিত সামরিক শক্তি বলে ভাবা হচ্ছে, দেশটি আসলে তা নয়। হামাসের মতো শক্তির বিরুদ্ধেই যারা শতভাগ সফল হতে পারছে না, তাদের নিরপত্তার আরো অনেক ফাঁক-ফোকর হয়তো রয়ে গেছে।