হামাসের পরবর্তী লক্ষ্য গাইডেড মিসাইল তৈরি


  • মেহেদী হাসান
  • ৩০ মে ২০২১, ১৫:১১

মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বিস্তারের প্রধান শক্তি হচ্ছে এ অঞ্চলের সশস্ত্র সংগঠনগুলোর সাথে দেশটির ঘনিষ্ঠতা। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী দুটি প্রতিরোধ সংগঠন হামাস ও হিজবুল্লাহকে প্রকাশ্য সমর্থন দিয়ে আসছে ইরান। এছাড়া ইরাক ও ইয়েমেনের যোদ্ধারাও পাচ্ছে ইরানের পৃষ্ঠপোষকতা। লেবাননের হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের মনে করা হয় বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অরাষ্ট্রীয় যোদ্ধা সংগঠন। যাদের হাতে রয়েছে বহু ধরনের সমরাস্ত্র। সম্প্রতি গাজা যুদ্ধে হামাস যে রকেট প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে, ধারণা করা হচ্ছে, তাতে ইরানের কাছ থেকে বড় ধরনের প্রযুক্তিগত সহযোগিতা পেয়েছেন তারা। যুদ্ধবিরতির পর হামাস নেতারা ইরানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।

সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, হামাসের পরবর্তী লক্ষ্য হচ্ছে হিজবুল্লাহর মতো গাইডেড মিসাইলসহ বিপুল বিধ্বংসী ক্ষমতার অস্ত্রভান্ডার গড়ে তোলা। এতে সমর্থন রয়েছে ইরানের। হামাস উন্নত প্রযুক্তির গাইডেড মিসাইলের অধিকারী হলে তা ইসরায়েলের জন্য সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা সংকট হিসেবে দেখা দিতে পারে। এতে কমতে পারে গাজা ও ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের সন্ত্রাস আর দখলদারিত্ব।

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ১১ দিনের যুদ্ধে হামাস যে সামরিক শক্তি দেখিয়েছে তার পেছনে রয়েছে ইরানের ভূমিকা। ইরানের সামরিক ও আর্থিক সহায়তায় হামাস রকেট প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উন্নতি করেছে। হামাসের আল কাসেম ব্রিগেড সরাসরি ইরানের সহায়তাপুষ্ট।

ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স অ্যাজেন্সির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানের সামরিক সক্ষমতা তিনটি বিষয়ের দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে প্রথমটি হলো- দেশটির হাতে থাকা ব্যালিস্টিক মিসাইল। দ্বিতীয়টি- পারস্য উপসাগর ও হরমুজ প্রণালীতে নৌশক্তির দক্ষতা। আর তৃতীয় হলো- বিদেশি অংশীদার বা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ইরান-সমর্থিত বিপুুল সংখ্যক মিলিশিয়া বাহিনী।

মিলিশিয়া বাহিনীর মাধ্যমে প্রক্সি যুদ্ধ পরিচালনার দক্ষতার কিছু প্রকাশ ঘটেছে এবারের গাজায় হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধে।

এশিয়া টাইমসের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, হামাসের রকেট বাহিনী এবং সমর পরিকল্পনার পেছনে রয়েছে ইরানের সহায়তা।

হামাস ইসরায়েলে ঝাঁকে ঝাঁকে রকেট নিক্ষেপ করেছে। এসব রকেটের খরচ মাত্র কয়েকশ ডলার। অপরদিকে হামাসের সস্তা দামের এসব রকেট আকাশে ধ্বংস করতে ইসরায়েলকে ছুড়তে হয়েছে অতি ব্যয়বহুল আয়রন ডোম মিসাইল। হামাসের রকেট লক্ষ্য করে ইসরায়েল উন্নত প্রযুক্তির যেসব আয়রন ডোম মিসাইল ছুড়েছে, তার প্রত্যেকটির দাম ৫০ হাজার ডলার।

হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধে দুই পক্ষের অবস্থান তুলনীয় নয়। হামাস একটি রাজনৈতিক সংস্থা। আর ইসরায়েল হলো যুক্তরাষ্ট্রের আধুনিক অস্ত্র আর প্রযুক্তিত্বে সজ্জিত একটি দেশ। একটি রাজনৈতিক সংস্থার প্রতিরোধ যুদ্ধে এবার ইসরায়েলের আয়রন ডোম এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এছাড়া ইসরায়েল গাজায় চালিয়েছে নির্বিচার বিমান হামলা। এসব বোমার বেশিরভাগ আসছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ইসরায়েলের সব যুদ্ধবিমানও যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি।

অনেক বিশ্লেষকের মতে, ভবিষ্যতে ইসরায়েলকে এ ধরনের যুদ্ধে জড়ানোর আগে বহু বিষয় নতুন করে ভাবতে হবে। ইসরায়েলকে ভাবতে হবে ইরান নিয়ে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের নতুন রাজনৈতিক সমীকরনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ দেশ হয়ে উঠেছে ইরান। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, সামরিক দিক দিয়ে হামাসের বর্তমান শক্তির পেছনে রয়েছে ইরানের ভূমিকা। হামাস বর্তমানে একটি রাজনৈতিক শক্তি শুধু নয়। তাদের রয়েছে শক্তিশালী সামরিক শাখা বা মিলিশিয়া বাহিনী।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শীঘ্রই ইরানের সহায়তায় হামাসের এসব হোমমেড মিসাইল গাইডেড মিসাইলে পরিণত হতে পারে। আর তা ইসরায়েলের জন্য মৃত্যুদূত হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। হামাস অনেক দিন ধরে ইসরায়েলে এলোমেলা ভাবে রকেট নিক্ষেপ করেছে। অনেক রকেট খোলা স্থানে পড়েছে। আগে স্বল্প সময়ে এত রকেট হামলায়ও দক্ষ ছিল না সংগঠনটি। ফলে এসব রকেট ইসরায়েল সহজে আকাশে ধ্বংস করতে পারত। অপরদিকে হামাসের রকেট হামলার অজুহাতে আত্মরক্ষার নামে ইসরায়েল ফিলিস্তিনে বিমান হামলা চালিয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাত।

এবারও হামাসের ব্যবহার করা সব রকেট ছিল আনগাইডেড। তবে এবার হামাসের রকেট প্রযুক্তিতে যেমন উন্নতি হয়েছে তেমনি বেড়েছে তাদের রকেট নিক্ষেপের সক্ষমতা। ফলে ইসরায়েল ব্যর্থ হয়েছে অনেক হামলা ঠেকাতে। ভবিষ্যতে যদি হামাস গাইডেড মিসাইলের অধিকারী হয় তাহলে তারা ইসরায়েলের অভ্যন্তরে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনাসহ নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে সক্ষম হবে। এতে তাদের যুদ্ধ ব্যয়ও কমে আসবে।

মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধ চালানোর ক্ষেত্রে ইরানের আরেক হাতিয়ার হলো হিজবুল্লাহ। মিলিশিয়া বাহিনী হিজবুল্লাহ লেবানন আর্মির চেয়ে শক্তিশালী। হিজবুল্লাহকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অরাষ্ট্রীয় আর্মি বিবেচনা করা হয়। তাদের আর্থিক এবং সামরিক পৃষ্ঠপোষক ইরান। হিজবুল্লাহর মূল শক্তি তাদের মিসাইল পাওয়ার। আর তাদের এ মিসাইল ও রকেট শক্তির পেছনে রয়েছে সরাসরি ইরান।

অনেক সামরিক বিশ্লেষক মনে করেন, হিজবুল্লাহর কাছে ৪০ হাজার থেকে দেড় লাখ রকেট মজুদ রয়েছে। যা বিশ্বের অনেক দেশের আর্মির কাছেও নেই। আর এ রকেটে মূল লক্ষ্য হলো ইসরায়েল। তাদের রয়েছে হাজার হাজার এন্টি এয়ারক্রাফট, এন্টি শিপ এবং এন্টি ট্যাঙ্ক মিসাইল। অনেকে বিশ্লেষক মনে করেন, প্রচলিত যুদ্ধে আরব দেশের কোনো আর্মি হিজবুল্লাহর মতো শক্তিশালী নয়।

ইরানের লক্ষ্য মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশে তাদের মিলিশিয়া বাহিনীকে উন্নত রকেট ও মিসাইল শক্তিতে শক্তিশালী করা। ইরানের সহায়তায় হিজবুল্লাহ গড়ে তুলেছে বিধ্বংসী অস্ত্র ভান্ডার। তাদের কাছে রয়েছে গাইডেড মিসাইল। ২০১১ সালে সিরিয়া অভিযানের পর থেকে হিজবুল্লাহর কাছে এসব গাইডেড মিসাইল রয়েছে।

ভবিষ্যতে ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ যে কোনো যুদ্ধ উভয় পক্ষের জন্য দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে পারে। এ কথা সত্য ইসরায়েলের উন্নত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম রয়েছে। কিন্তু হামাসের সাথে যুদ্ধে প্রমানিত হয়েছে যে, তাদের পক্ষে শত্রুর সব মিসাইল ঠেকানো সম্ভব নয়। আর যদি গাইডেড মিসাইল দিয়ে আক্রমন চালায় তবে তা ইসরায়েলের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

বিশ্লেষকদের মতে, হামাস যদি উন্নত প্রযুক্তির শক্তিশালী গাইডেড মিসাইলের অধিকারী হতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতে ইসরায়েলের নিপীড়ন ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস থেকে ফিলিস্তিন রক্ষা পেতে পারে। গাজা বা ফিলিস্তিনে হামলার ক্ষেত্রে পাল্টা আঘাত নিয়ে ইসরায়েলকে অনেকবার ভাবতে হবে।

এ অঞ্চলে ইরানের এই মিসাইল ডিপ্ল্যোম্যাসিতে আরো সাফল্যর জন্য ইরানকে তার শিয়া চিন্তাধারা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। হামাস মূলত মিশর ভিত্তিক ইসলামিক রাজনৈতিক সংস্থা মুসলিম ব্রাদারহুডের অংশ এবং সুন্নী মতাদর্শের। ইরান শিয়া চিন্তা থেকে বের হয়ে সুন্নী হামাসের প্রতি সহায়তা কতটা অব্যাহত রাখতে পারবে তার ওপর নির্ভর করছে ভবিষ্যত সাফল্য।

ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের নিপীড়ন। ইয়াসির আরাফাতের প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন এবং ফাতাহ পার্টির ব্যর্থতার মধ্যদিয়ে উত্থান ঘটে হামাসের। শেখ আহমেদ ইয়াসিন ১৯৮৭ সালে গঠন করেন হামাস। ইয়াসির আরাফাতের পিএলও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যখন সশস্ত্র লড়াই বন্ধ করেছে তখন হামাস নিজেদের হাতে বন্দুক তুলে নিয়েছে। ইসরায়েলের সাথে ইয়াসির আরাফাতের শান্তি চুক্তির পরও ফিলিস্তিনে শান্তি আসেনি । বন্ধ হয়নি ইসরায়েলের বর্বরতা, সন্ত্রাস আর দখলদারিত্ব।

শান্তিচুক্তি ব্যর্থ হওয়ার কারণে ফিলিস্তিনিদের কাছে হামাস জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ২০০৬ সালে দলটি ফিলিস্তিন সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু তাদের সরকার গঠনে বাধা সৃষ্টি করা হয়। ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। গাজার নিয়ন্ত্রন চলে যায় হামাসের হাতে। আর পশ্চিম তীর ফাতাহর হাতে।

হামাসের প্রতি শুরু থেকে ইরানের সমর্থন ছিল। দলটি ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে ইসলামি বিপ্লবের সমর্থক। শিয়া মতাদর্শ হওয়া সত্ত্বেও হামাস ইরানের সাথে সম্পর্ক তৈরিতে এগিয়ে গেছে। বিনিময়ে ইরানও এগিয়ে এসেছে। হামাসকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দিয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে ইরানের সাথে এই সর্ম্পক ফিলিস্তিন এবং হামাসের জন্য আশার দিক। আর ইসরায়েলের জন্য আশঙ্কার। তবে এ সর্ম্পকের ক্ষেত্রে সমস্যাও আছে। ২০১১ সালে সিরিয়া যুদ্ধে হামাস পক্ষ নেয় আসাদ বিরোধী বিদ্রোহীদের পক্ষে। যেখানে ইরান সরাসরি আসাদের পক্ষ নেয় । ইরান তখন হামাসকে আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দেয়। তবে সহায়তা অব্যাহত রাখে হামাসের সামরিক শাখা আল কাসেম ব্রিগেডের প্রতি।

ইরানের বর্তমান লক্ষ্য দেশটির সমর্থিত এ অঞ্চলের মিলিশিয়া বাহিনীগুলো নিজেরাই মিসাইল তৈরিতে সক্ষমতা অর্জন করুক। ইরানের আল কুদস ফোর্সের নেতৃত্বে হামাস রকেট নির্মান শুরু করেছে। গাজায় আল কাসেম ব্রিগেড নিজেরা রকেট নির্মান করছে। রকেট লঞ্চার এবং ফিউজলেজ হিসেবে তারা ব্যবহার করছে পুরনো আন্ডারগ্রাউন্ড পানির পাইপ।

২০১৪ সালে গাজা অভিযানে ইসরায়েলের বিপুল অবিস্ফোরিত অস্ত্র এখন হামাসের অন্যতম বিস্ফোরক উপাদানে পরিণত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভূমধ্যসাগরে ডুবন্ত বৃটিশ যুদ্ধ জাহাজ কেটে হামাসের ডুবুরিরা উদ্ধার করেছে টনকে টন গান শেল। এবারের ১১ দিনের যুদ্ধে গাজা থেকে ইসরায়েলে ৪ হাজার ৩শ রকেট নিক্ষেপ করা হয়েছে। ইসরায়েলও ৪ হাজারের অধিক মিসাইল ছোড়ার কথা স্বীকার করেছে। হামাসের এখন লক্ষ্য হিবজুল্লাহর মত সমর শক্তি অর্জন করা এবং গাইডেড মিসাইলসহ বিধ্বংসী ক্ষমতার অস্ত্রভান্ডার তৈরি করা। হামাসকে শক্তিশালী করার ইরানি ভূমিকার মোকাবেলায় ইসরায়েল কী কৌশল গ্রহণ করতে যাচ্ছে, সেদিকে চোখ রেখেছেন বিশেষজ্ঞরা।