ইরানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন : কে জিতবেন?


  • মোতালেব জামালী
  • ০২ জুন ২০২১, ১৬:০০

ইরানে আগামী ১৮ জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনে প্রার্থী হতে আগ্রহী ৫৮৫ জন নাম নিবন্ধন করেছিলেন। তাদের মধ্যে মাত্র ৭ জন প্রার্থীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে দেশটির অভিভাবক পরিষদ বা গার্ডিয়ান কাউন্সিল। ৩২ জন মধ্যপন্থী ও সংস্কারপন্থীসহ অন্য সবার প্রার্থিতা বাতিল করে দিয়েছে পরিষদ। নির্বাচনে প্রার্থিতা অনুমোদন করার চূড়ান্ত ক্ষমতা এই পরিষদের হাতে। কারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন সেই সিদ্ধান্ত ১২ সদস্যের এই পরিষদের কাছ থেকেই আসে। অভিভাবক পরিষদের অনুমোদনের পর ইরানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত মঙ্গলবার চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে। যাদের প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে, তাদের পরিষদের কাছে আপিল করারও কোনো বিধান বা সুযোগ নেই।

যাদের প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে, তাদের মধ্যে দুজন আলোচিত ব্যক্তি হলেন- সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ এবং পার্লামেন্টের সাবেক স্পিকার ও দেশটির শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির উপদেষ্টা আলি লারিজানি। বর্তমান সংস্কারপন্থী প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করায় সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী তিনি তৃতীয় মেয়াদে প্রার্থী হতে পারেননি। অভিভাবক পরিষদ দেশটির বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট ইশহাক জাহাঙ্গিরির প্রার্থিতাও বাতিল করে দিয়েছে। তিনিও একজন সংস্কারপন্থী।

রক্ষণশীল বা ডানপন্থী হিসেবে পরিচিত যে ৭ জন প্রার্থীকে চূড়ান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনুমতি দেওয়া হয়েছে তারা হলেন- প্রধান বিচারপতি ইবরাহিম রাইসি, বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর সাবেক প্রধান ও বর্তমানে দেশটির শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির উপদেষ্টা পরিষদের সচিব মোহসেন রেজাই, সাবেক প্রধান পরমাণু আলোচক সাইদ জালিলি, সেন্ট্রাল ব্যাংকের গভর্নর আব্দুল নাসের হিম্মাতি, পার্লামেন্ট সদস্য আমির হোসেন গাজিজাদেহ, পার্লামেন্ট সদস্য আলি রেজা জাকানি ও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহসেন মেহের আলিজাদেহ। তবে শেষের তিনজন তেমনভাবে পরিচিত বা আলোচিত প্রার্থী নন। এছাড়া এই ৭ জনের কেউই সুপরিচিত সংস্কারবাদী বা বাস্তববাদী নন।

এই ৭ জনের মধ্যে আবার প্রধান বিচারপতি ইবরাহিম রাইসি ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ও অন্য রক্ষণশীল নেতাদের পছন্দের প্রার্থী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। ২০১৭ সালের নির্বাচনে তিনি বর্তমান প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির কাছে পরাজিত হন। আলি লারিজানির প্রার্থিতা বাতিল হওয়া ইরানের সব মহলের কাছেই একটি বিস্ময় হিসেবে দেখা দিয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই দেশটির প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করে আসছেন। তাকে নির্বাচনে ইবরাহিম রাইসির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছিল। কিন্তু তার প্রার্থিতা অনুমোদন না করায় এখন ইবরাহিম রাইসির বিজয় একরকম নিশ্চিতই বলা যায়। ইবরাহিম রাইসিকে আয়াতুল্লাহ খামেনির উত্তরাধিকারী বা ইরানের পরবর্তী শীর্ষ নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। সে কারণেই খামেনি সম্ভবত চান রাইসির বিজয় সুনিশ্চিত করতে।

অভিভাবক পরিষদ একটি অনির্বাচিত কিন্তু ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারি একটি প্রতিষ্ঠান। এর ১২ সদস্যের মধ্যে শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ৬ জনকে মনোনয়ণ দিয়ে থাকেন। অন্য ৬ জনও পরোক্ষভাবে তারই অনুমোদনে পরিষদের সদস্য হয়ে থাকেন। এ কারণে অভিভাবক পরিষদ খামেনিসহ রক্ষণশীল নেতাদের ইশারাতেই চলে। নির্বাচনে কারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা এই পরিষদের হাতে থাকায় চাইলেই কেউ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন না। এ কারণে অভিভাবক পরিষদকে নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে শীর্ষ নেতা খামেনির একটি হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন অনেকেই।

যেমন কট্টরপন্থী হিসেবে পরিচিত সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদকে ২০১৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অনুমতি দেয়নি অভিভাবক পরিষদ। এবারের নির্বাচনেও একই ঘটনা ঘটলো। এর প্রতিবাদে আহমাদিনেজাদ বলেছেন, তিনি নির্বাচন বর্জন করবেন।

নির্বাচনে আরেকজন সম্ভাব্য গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী ছিলেন সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত বর্তমান পররাষ্ট্র মন্ত্রী জাভেদ জারিফ। তিনি ইরানের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদদের একজন। কিন্তু সম্প্রতি তার একটি গোপন আলোচনার টেপ প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ দেখাননি। জাভেদ জারিফ তার অত্যন্ত কাছের কোন লোকের সাথে আলোচনাকালে দেশের পররাষ্ট্র নীতিতে হস্তক্ষেপ করার জন্য রেভুল্যুশনারী গার্ড বাহিনীর কঠোর সমালোচনা করেন। তার এই কথাবার্তা রেকর্ড করা হয় এবং পরে তা প্রকাশ করে দেয়া হয়। এরপর জনসমক্ষেই তার সমালোচনা করেন শীর্ষ নেতা খামেনি।

গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বাতিল করায় এবারের এই নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহ তেমন থাকবেনা এবং নির্বাচনের দিন ভোটারদের কেন্দ্রে উপস্থিতির হারও অনেক কম হবে বলে ইরানের অনেক বিশ্লেষক আশঙ্কা করছেন। এছাড়া চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের আগেই বেশ কিছু প্রার্থী ইবরাহিম রাইসির সমর্থনে তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন। ফলে নির্বাচন যে একতরফা হবে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

তবে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর ইবরাহিম রাইসি একটি ভিডিও বার্তা প্রকাশ করেছেন যাতে তিনি নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে অন্যদের প্রার্থিতা অনুমোদন করার আহবান জানিয়েছেন। এতে তিনি বলেছেন, চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের কথা শোনার পরপরই তিনি র্নিাচন সংশ্লিস্ট উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করার চেস্টা করছেন যাতে নির্বাচন করতে আগ্রহী অন্যদের প্রার্থিতা অনুমোদন করা হয়।

অসমর্থিত একটি সূত্র গত মঙ্গলবার জানিয়েছে, বিদায়ী প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি দেশটির সর্বোচ্চ নেতা খামেনির কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে তিনি নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে সংস্কারপন্থী ও মধ্যপন্থী প্রার্থীদের প্রার্থিতা অনুমোদন করার আহবান জানিয়েছেন। এছাড়া এ মাসের শুরুতে অভিভাবক পরিষদ যখন প্রার্থীদের যোগ্যতা নির্ধারণ করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে তখন রুহানির সরকার এর প্রতিবাদ জানিয়ে বরেছে, এটা প্রার্থীদের গণহারে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেয়ার একটি প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। এছাড়াও দেশটির বিভিন্ন মহল থেকেও এই প্রজ্ঞাপনকে অবৈধ ও নির্বাচনি আইনের পরিবর্তন বলে অভিহিত করেছেন।

অভিভাবক পরিষদের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, যাদের বয়স ৪০ থেকে ৭৫ এর মধ্যে কেবল তারাই নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন। যাদের অপরাধমূলক কোন কর্মকান্ডের রেকর্ড আছে তারাও প্রার্থী হতে পারবেন না। যাদের উর্ধতন নির্বাহী নেতৃত্বের পদে অন্তত: ৪ বছরের অভিজ্ঞতা আছে তারা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। এই প্রজ্ঞাপনের কারণে দু’জন সম্ভাব্য প্রার্থী সুপরিচিত সংস্কারপন্থী মোস্তফা তাজজাদেহ ও বর্তমান আইসিটি মন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ আজারি জাহরোমি এমনিতেই বাদ পড়ে যান। মোস্তফা তাজজাদেহ সাবেক প্রেসিডেন্ট আহমাদিজোদের শাসনাামলে তার পুননির্বাচনের বিরোধিতা করে গ্রীন মুভমেন্ট নামে একটি আন্দোলন গড়ে তোলায় তাকে ৭ বছর কারাদন্ড দেয়া হয়। অন্যদিকে আইসিটি মন্ত্রী জোহারামির বয়স এ বছরের শেষের দিকে ৪০ বছর পূর্ণ হবে।

আসন্ন নির্বাচনে দেশের সব মহলের মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে কিনা তা ইরানের সরকারি টেলিভিশনের পক্ষ থেকে অভিভাবক পরিষদের কাছে গত মঙ্গলবার জানতে চাওয়া হয়। জবাবে পরিষদের মুখপাত্র আব্বাস আলী কাদখোদেয়ী বলেন, ‘অভিভাবক পরিষদ সংবিধানের আলোকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কোন রাজনৈতিক দল বা গ্রুপের কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার বাধ্যবাধকতা পরিষদের নেই।’

প্রার্থিতা বাতিল হওয়া আলী লারিজানির ভাই ও অভিভাবক পরিষদের সদস্য সাদেক আমোলি লারিজানি প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর এক টুইট বার্তায় বলেছেন, তিনি ২০ বছর ধরে অভিভাবক পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু পরিষদের এবারের সিদ্ধান্ত যে ভাবে বিতর্কিত হচ্ছে অতীতে এমনটা কখনোই হতে দেখেননি। তিনি আরো বলেন, যাদের প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েওছে এবয় যাদেরকে তালিকায় রাখা হয়েছে দুই ক্ষেত্রেই তিনি নানা ত্রুটি দেখতে পাচ্ছেন। তিনি পরিষদের সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলেছেন।

ইরাকি কুর্দি রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোহাম্মদ বুলোভালি ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও প্রার্থী বাছাই সম্পর্কে বলেন, অনুমোদিত ৭ জন প্রার্থীই কোন না কোন ভাবে রেভুল্যুশনারী গার্ড বাহিনীর সাথে যুক্ত। বর্তমান প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সরকারের সাথে রেভুল্যুশনারী গার্ড বাহিনীর দ্বন্দ্ব সব সময় লেগেই থাকতো। প্রভাবশালী এই বাহিনী সরকারের কাছে নয়, দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির কাছে তাদের কাজের জবাবদিহি করে থাকে। সংস্কারপন্থী সব প্রার্থীর মনোনয়ণপত্র বাতিল করায় এবং ইবরাহিম রাইসি রেভুল্যুশনারী গার্ড বাহিনীর সমর্থণপুষ্ট হওয়ায় তার বিজয় সুনিশ্চিত বলে মন্তব্য করেন মোহাম্মদ বুলোভালি। সংস্কারপন্থীরা পশ্চিমা বিশে^র সাথে বিরোধ মিমাংসায় আরাপ-আলোচনার পক্ষপাতি। কিন্তু রেভুল্যুশনারী গার্ড বাহিনী পশ্চিমা বিশে^র ব্যাপারে ইরানের কঠোর অবস্থানের পক্ষে।

অভিভাবক পরিষদের অনুমেদিত প্রার্থীরা এখন নির্বাচনি প্রচারণা শুরু করতে পারবেন। প্রচারণা চলবে নির্বাচনের দুই দিন পূর্ব পর্যন্ত অর্থাৎ ১৬ জুন পর্যন্ত। প্রার্থীরা তিনটি টেলিভিশন বিতর্কে অংশগ্রহণ করবেন। তবে এসব বিতর্কের তারিখ এখনও নির্ধারণ করা হয়নি।