ইরান নিয়ে পাঁচ পরিকল্পনা ইসরায়েলের


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ০৮ জুন ২০২১, ১৫:৪২

মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম বড় সামরিক শক্তি ইরানকেই সবচেয়ে বেশি ভয় পায় ইসরায়েল। তেহরানকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাই নানা পন্থা অবলম্বন করে তেল আবিব। তবে ইসরায়েলি সমরবিশারদরাই বলছেন, ইরানকে বশে আনা অসম্ভব। তাই ইরানের সঙ্গে সরাসরি সামরিক সঙ্ঘাতের পরিবর্তে পেছনে থেকে ছুরি মারাই ইসরায়েলের প্রধান কৌশল।

যুক্তরাষ্ট্রের সিএনবিসির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরান ইউরিনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ৬০ শতাংশে উন্নীত করেছে। সামরিক গ্রেডে উন্নীত করতে হলে এটাকে ৯০ শতাংশে নিতে হবে। তাহলেই ইরান পরমাণু বোমা বানাতে সক্ষম হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান চাইলে এখনই পরমাণু বোমা বানাতে পারে।

ইরানকে পরমাণু বোমা বানানো থেকে বিরত রাখতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ^শক্তি আবার আলোচনা শুরু করেছে। ভিয়েনায় এ আলোচনা চলছে এবং তা সফলভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে। তবে এবার ইরান বেশ অনড় অবস্থান নিয়েছে। তাদের ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি তুলে না নিলে পরমাণু চুক্তিতে ফিরতে রাজি হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে।

ইসরায়েল এ আলোচনায় কোনো পক্ষ না হলেও পরমাণু চুক্তি নিয়ে সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা তাদের। ইসরায়েলের পাশাপাশি সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাইরাইন ও সৌদি আরবও চায় ইরানের সঙ্গে চুক্তি করা হলে তেহরানকে যেন ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ও মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া প্রধান দেশটির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা থেকে নিবৃত্ত করা হয়।

পরমাণু চুক্তি নিয়ে আলোচনা চললেও ইরান ও ইসরায়েল কিন্তু গোপনে একে অপরের বিরুদ্ধে এক ধরনের যুদ্ধের মধ্যে রয়েছে। ইরানের নাতাঞ্জে সম্প্রতি পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিস্ফোরণের জন্য ইসরায়েলকেই দায়ী করা হচ্ছে। লোহিত সাগরে ইরানি গোয়েন্দা জাহাজে রহস্যজনক বিস্ফোরণের নেপথ্যেও ইসরায়েল বলে মনে করা হয়। এর জবাবে ইরানও ইসরায়েলের দুটি কার্গো জাহাজকে টার্গেট করেছিল। সর্বশেষ ওমান উপকূলে ইরানের নৌবাহিনীর একটি জাহাজে আগুন লেগে সাগরে ডুবে যায়। ‘খার্গ’ নামের জাহাজটি নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণ ও লজিস্টিক জাহাজ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছিল।

এর আগে একই উপকূলে ইরানের বৃহত্তম একটি কার্গো জাহাজ রহস্যজনক কারণে ডুবে গেছে। এর পেছনে ইরসাইলের হাত থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

ইরানের ইরানের নাতাঞ্জে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রে বিস্ফোরণের পর থেকেই তেহরান পরমাণু কর্মসূচি আরও জোরদার করেছে। অন্যদিকে ইসরায়েল ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংস করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। প্রতিপক্ষ দেশের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধের ক্ষেত্রে ইসরায়েলের কিছু সফলতাও রয়েছে।

৪০ বছর আগে ১৯৮১ সালে ইসরায়েলি এফ সিক্সটিন জঙ্গিবিমান লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে ইরাকের পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে সেটি ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। অপারেশন অপেরা নামের সেই অভিযানের একজন পাইলট ছিলেন জেনারেল আমোস ইয়াদলিন।

২০০৭ সালে জেনারেল ইয়ালদিন ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান থাকার সময় আরেকটি অভিযান পরিচালনা করা হয় সিরিয়ায়। অপারেশন অরচার্ড নামের ওই অভিযানে সিরিয়ার পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া হয়।

জেনারেল ইয়ালদিন বলছেন, ইরাক ও সিরিয়ায় যেভাবে সফলতা পাওয়া গেছে ইরানে সেটা সম্ভব নয়। এ ধরনের হামলার কথা সাদ্দাম হোসেন ও বাশার আল আসাদ চিন্তাও করেননি। কিন্তু ইরান সেখান থেকে শিক্ষা নিয়েছে। তারা এ ধরনের হামলা মোকাবিলার জন্য গত ২০ বছর ধরেই প্রস্তুত রয়েছে।

ইয়ালদিন জানান, ইরান ও সিরিয়ার পরমাণু কর্মসূচি ছিল এক জায়গায় কেন্দ্রিভূত। কিন্তু ইরানের পরমাণু কর্মসূচি দুর্ভেদ্য প্রাচীরে ঘেরা এবং বিভিন্ন স্থানে বিস্তৃত। ইরানের পরমাণ কর্মসূচি ডজন ডজন সাইটে পরিচালিত হচ্ছে। এর অনেকগুলো আবার পবর্তমালার মাটির নীচে। তাছাড়া ইরানের পরমাণু কর্মসূচিগুলোর অবস্থান সম্পর্কে ইসরায়েল বিস্তারিত জানে বলেও মনে হয় না।

ইসরায়েলের সমরকৌশলীরা বলছেন, ইরান যাতে পরমাণু বোমার অধিকারী হতে না পারে সেজন্য তাদের ৫টি কৌশল রয়েছে। ইরানকে পরমানু কর্মসূচী থেকে দূরে রাখতে তারা এই কৌশল গুলো প্রয়োগ করবেন। ইতোমধ্যে ইসরায়েলের এসব কৌশল নানা পর্যায়ে বাস্তবায়ন চলছে। যদিও এসব ইসরায়েলি তৎপরতা উপেক্ষা করে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি এগিয়ে যাচ্ছে।

ইসরায়েলের এই কৌশলের প্রথমটি হচ্ছে ইরানের পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী হওয়া ঠেকাতে কঠোর চুক্তি করতে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যকে চাপ দেওয়া। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ইরানকে এই বার্তা দেওয়া যে বর্তমান অবস্থানে থাকলে নিষেধাজ্ঞা ও কূটনৈতিক চাপের মাধ্যমে তাকে শায়েস্তা করা অব্যাহত থাকবে। তৃতীয়টি হচ্ছে, ইসরায়েলের কৌশল সি হিসেবে পরিচিত ব্যবস্থা প্রয়োগ। এর মধ্যে রয়েছে কভার্ট অ্যাটাক বা গুপ্ত হামলা, ক্লানডেস্টাইন অ্যাকশন বা গোপনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সাইবার হামলা। চার হচ্ছে ইরানের পরমাণু কর্মসূচিেেত হামলা চালানো।

পাঁচ নম্বর কৌশল হচ্ছে ইরানে ক্ষমতার পালাবদল করা। তবে এটা কার্যত অসম্ভব। কারণ ইরানে রাষ্ট্র পরিচালনায় আয়াতুল্লাহদের রয়েছে অসীম ক্ষমতা। সামরিক বাহিনীর ওপর রয়েছে তাদের নিয়ন্ত্রণ। ইসলামিক রিভ্যুলিউশনারি গার্ড এবং বাসিজ নামের একটি শক্তিশালী বাহিনী রয়েছে যারা যে কোনো বিদ্রোহ দমনে সক্ষম।

তবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় ইরান সরকার অনেকটা নাজুক হয়ে পড়েছে। ইরানিরা বিভিন্ন সময় বিক্ষোভ করেছে। ২০১৮ সালে ইরানের হাতে ছিল ১২০ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ২০২০ সালে সেটা কমে দাড়ায় মাত্র ৪ বিলিয়ন ডলারে। জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বিক্ষোভ দেখা যায়।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, পরমাণু চুক্তি না হলে ইরান খুব দ্রুতই হয়তো দুই তিনটি পরমাণু বোমা বানিয়ে ফেলবে। এজন্য দ্রুততার সঙ্গে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে দেশটি। ইসরায়েলি জেনারেল ইয়ালদিন নিশ্চিত যে পরমাণু বোমা বানাতে এখনই সক্ষম ইরান।

ইরানকে বশে আনার ইসরায়েলি চেষ্টা কতটা সফল হবে তা নিয়ে দেশটির অনেক বিশেষজ্ঞই ভীষণভাবে সন্দিহান। সাম্প্রতিক গাজা আগ্রাসনে ইসরায়েলের সামরিক ও কৌশলগত দুর্বলতা জনসমক্ষে উন্মোচিত হয়েছে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন। হামাসের সাম্প্রতিক সাফল্যেও পেছনে ইরানেরও বড় ভূমিকা রয়েছে।

ইরানকে মোকাবিলায় ইসরায়েল কতটা সক্ষম তা নিয়ে ইসরায়েলির বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন, কঠোর সমালোচনা করেছেন। তাদেরই একজন ইসরায়েলি কূটনীতি ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এবং ইসরায়েলি ইন্সটিটিউট ফর রিজিওনাল ফরেন পলিসিজের সিইও ড. গিল মার্সিয়ানো। দৈনিক হারেৎসে এক নিবন্ধে তিনি বলছেন, ইসরায়েলি সামরিক কৌশল হচ্ছে ইরান এবং তার সহযোগী হামাস ও হেজবুল্লাহর সঙ্গে মাঝে মাঝেই যুদ্ধ করা। তবে প্রতিটি যুদ্ধের পরপরই ইসরায়েলের কৌশলগত অবস্থান আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। এবার গাজায় আগ্রাসনের পর স্পষ্ট হয়েছে যে ইসরায়েলের সামরিক কৌশলের বড় ধরনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

ইসরায়েল নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য, বিশেষ করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে যে কৌশল অবলম্বন করে থাকে তার নাম ওয়ার বিটুইন দা ওয়ারস বা যুদ্ধের মধ্যে যুদ্ধ। এর অংশ হিসেবে ইসরায়েল হামাস, হেজবুল্লাহ ও ইরানি রিভ্যুলিউশনারী গার্ডের বিরুদ্ধে সময়ে সময়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এর মাধ্যমে দেশটি যুদ্ধের প্রস্তুতি খতিয়ে দেখে। একটি যুদ্ধের পর আরেকটি যুদ্ধের জন্য ইসরায়েল কিছুটা সময় নেয় প্রস্তুতির জন্য। এ সময় দেশটি সর্বশেষ যুদ্ধের ফলাফল পর্যালোচনা করে থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই কৌশল ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিবার যুদ্ধের পর ইসরায়েলের অবস্থান আরও ক্ষয়িষ্ণু হয়েছে।

প্রতিবার যুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসরায়েল আরও বেশি দুর্বল হয়েছে এবং হামাস ফিলিস্তিনের রাজনীতিতে আরও বেশি শক্তিশালী হয়েছে। ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধ তদন্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আইসিসির সিদ্ধান্ত এর একটা বড় উদাহরণ। এবার গাজায় আগ্রাসনের পর ইসরায়েল অভ্যন্তরীণভাবেও অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। ইসরায়েলের আরব ও ইহুদি নাগরিকদের মধ্যে সম্পর্ক ভেঙে পড়েছে।

হামাস ও ইসলামিক জিহাদ দেখিয়েছে তারা ইসরায়েলের ভেতরে যথেষ্ট ক্ষতি করার সামর্থ্য রাখেন। যুদ্ধবিরতির পর তারা অস্ত্রের মজুদ দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েলের কৌশলে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস দিন দিন অজনপ্রিয় ও দুর্বল হয়ে পড়ছেন। এতে শক্তিশালী হচ্ছে হামাস।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েল সবচেয়ে বড় ভুলটি করছে কূটনীতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে সামরিক শক্তির ওপর নির্ভর করে। এতে ইসরায়েলকে সবসময়ই তটস্ত থাকতে হচ্ছে। তবে ইসরায়েলের কট্টরপন্থীরা যেভাবেন রাষ্ট্রযন্ত্রের সবক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তাতে এই নীতি বদলানোর কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ফলে ইসরায়েলকে সবসময় ভীতির মধ্যেই থাকতে হবে।