ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সাম্প্রতিক সঙ্ঘাতের অবসান ও অস্ত্রবিরতি কার্যকর হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে মিসর। বিষয়টি নিয়ে দেশটির কূটনীতিকরা ব্যাপক তৎপরতা চালিয়েছেন। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে কোনো বিষয় নিয়ে মিসরের কূটনীতিকদের এতটা তৎপর হতে দেখা যায়নি। এ ঘটনা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, মিসর তাদের দীর্ঘদিনের নীরবতা ভেঙে আবার সক্রিয় হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের যে কোনো বিষয়ে বড়ো ধরনের প্রভাব বিস্তারকারী দেশ হিসেবে সামনের কাতারে চলে এসেছে।
গাজা থেকে লিবিয়া, পূর্ব ভূমধ্যসাগর থেকে আফ্রিকার শৃঙ্গ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিরোধ মীমাংসায় কায়রো এখন গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। মিসরের এই ভূমিকা আঞ্চলিক যুদ্ধ ও শান্তির ক্ষেত্রে নির্ণায়ক হয়ে উঠবে। দীর্ঘদিন ধরেই মিসরকে তার প্রতিবেশী দেশগুলো কিছুটা অবজ্ঞার চোখে দেখে আসছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, দেশটির অভ্যন্তরীণ নানা সংকট। বিশেষ করে প্রেসিডেন্টকে নিয়ে সংকট প্রধান ভূমিকা রেখেছে। এখন মিসর সেই সংকট কাটিয়ে আবার মধ্যপ্রাচ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বলতে গেলে এক নতুন মিসরে উত্থান ঘটেছে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের উত্তর আফ্রিকার প্রকল্প পরিচালক রিকার্ডো ফ্যাবিয়ানো বলেন, ‘আমরা এক নতুন ধরনের মিসরের উত্থান দেখতে পাচ্ছি।’ তিনি বলেন, আরব বসন্ত নামের এক ঝড় মিসরকে আঞ্চলিক কূটনৈতিক মানচিত্র থেকে অনেকটাই ছিটকে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু যেভাবেই হোক, ভূমিকম্পের ঝাঁকুনিতে তৈরি হওয়া ফাটল এখন অনেকটাই কমে আসায় মিসর আবার সক্রিয় হয়েছে।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দ্য ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারেস্ট-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সামি হামদি বলেন, ‘মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাতাহ আল সিসি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। তিনি এখন পূর্ব ভূমধ্যসাগর, লিবিয়া, ফিলিস্তিনসহ সব ইস্যুতেই গুরুত্বের সাথে নজর দিতে পারবেন। এর ফলে আগামীতে অনেক বেশি ব্যস্ত ও উচ্চাকাক্সক্ষী মিসরকে দেখতে পাব। তবে মিসরের উচ্চাকাক্সক্ষা পূরণের পথে এখনও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। সম্প্রতি মিসরের মধ্যস্থতায় হওয়া অস্ত্রবিরতি চুক্তির প্রতিক্রিয়া গাজা ও পূর্ব জেরুজালেমকে ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর পর্যন্ত হতে পারে।
মিসরের পূর্ব দিকে সরু ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড গাজা উপত্যকা হামাস নিয়ন্ত্রণ করছে। ইসরায়েলি বাহিনী যখন গাজা ও পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনিদের সাথে লড়ছিল, তখন এই লড়াই বন্ধে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ দ্রুতই মিসরের দিকে দৃষ্টি দেয়। কারণ, ইসরায়েল এবং হামাস উভয়ের সাথেই মিসরের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। অন্য যে আরব দেশটি বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে পারত, সেটি হচ্ছে কাতার। কিন্তু ইসরায়েল শুরুতেই কাতারের ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি। কারণ, কাতারের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বৈরী সম্পর্ক চলছে। অন্যদিকে ইউএই ইসরায়েলের সাথে সম্প্রতি সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। এছাড়া হামাসকে দীর্ঘ দিন ধরেই সহায়তা দিয়ে আসছে কাতার। সেটিও কাতারের মধ্যস্থতা মানার ব্যাপারে ইসরায়েলের অনাগ্রহের আরেকটি বড় কারণ।
সামি হামদি বলেন, ‘মিসর এটা প্রমান করতে সক্ষম হয়েছে যে, ইসরায়েল ও হামাসের সাথে তাদের সুম্পর্ক রয়েছে। ফলে মধ্যস্থতার দায়িত্ব পড়ে মিসরের উপর। যুক্তরাষ্ট্রও মিসরের মধ্যস্থতার ব্যাপারে দ্রুত সায় দেয়। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দায়িত্ব গ্রহনের পর প্রথম বারের মতো টেলিফোনে কথা বলেন মিসরের প্রেসিডেন্ট সিসির সাথে। দুই প্রেসিডেন্ট ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে অস্ত্র বিরতি নিয়ে আলোচনা করেন। বাইডেন সিসিকে ফোন করায় তা মিসরের জন্য বিরাট স্বস্তির খবর হয়ে দাড়ায়।
এদিকে মিসরের দক্ষিণের দুই প্রতিবেশি দেশ সুদান ও ইথিওপিয়া নীল নদের বৃহৎ শাখা ব্লু নীল নদে জল বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিশাল বাঁধ নির্মান করেছে। পৃথিবী বিখ্যাত নীল নদ মিসরের ভিতর দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে। এই নদকে মিসরের লাইফলাইনও বলা হয়ে থাকে। মিসরের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সামি সুকরির মতে, নীল নদের পানি দিয়ে চাষাবাদ ও অন্যান্য কাজ করে মিসরের প্রায় ১০ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহ হয়ে থাকে। মিসর নীল নদে গ্র্যান্ড ইথিওপিয়ান রেনেসা ড্যাম কে ‘অস্তিত্বের প্রশ্ন’ হিসেবে দেখছে। করেছিলেন। আংশিক চীনা অর্থে নির্মিত এই বাধের কারণে মিসরে নীল নদের পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এই ড্যামে পানি সরবরাহের জন্য বিশাল যে জলাধার নির্মান করা হয়েছে তা এই গ্রীষ্মেই পানিতে পূর্ণ করার কাজ শুরু হয়েছে। এটা থামানো মিসরের পক্ষে কোন ভাবেই হয়তো সম্ভব হবে না।
পানি নিয়ে প্রতিবেশী দেশের সাথে সঙ্ঘাত নিরসনে যুক্তরাষ্ট্র এখনও তেমন কোনো উদ্যোগী ভূমিকা নেয়নি। কায়রো আশা করছে, এখন থেকে বাইডেন প্রশাসন মিসরের সহায়তায় এগিয়ে আসবে এবং পানি নিয়ে দক্ষিণের প্রতিবেশিদের সাথে বিরোধ মিমাংসায় মধ্যস্থতা করবে। এর পাশাপাশি মিসর সম্প্রতি ইথিওপিয়ার প্রতিবেশি দেশ জিবুতি ও উগান্ডায় প্রথমবারের মতো নিজ দেশের মিশন খুলেছে । এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্লু নীলে বাধ নিয়ে ইথিওপিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করা।
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের গভীরতা নিয়ে মিসরের উদ্বেগের আরেকটি ক্ষেত্র হলো লিবিয়া। মিসর তার পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশ লিবিয়াতে বিদেশি শক্তির উপস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। মোয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর গৃহযুদ্ধে জর্জরিত লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় বিদ্রোহী জেনারেল খলিফা হাফতার ও তার বাহিনীকে সমর্থন দিয়ে আসছে মিসর, রাশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাত । অন্যদিকে, লিবিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে জাতিসংঘ সমর্থিত গভর্নমেন্ট অব ন্যাশনাল অ্যাকর্ড বা জিএনএ-কে সমর্থন দিচ্ছে তুরস্ক ও কাতার।
বিবদমান দুই পক্ষের এই সংঘাত বন্ধ করে লিবিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা ও স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে গঠন করা হয়েছে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার। এই সরকারে নেতৃত্ব দিতে মিসরের সমর্থিত প্রার্থীরা ভোটে পরাজিত হয়েছে। নতুন সরকারের উপর প্রভাব রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও তুরস্কের। এ কারণে লিবিয়া পরিস্থিতি নিয়ে নানা শঙ্কা ও উদ্বেগ কাজ করছে মিসরের ক্ষমতাসীনদের মধ্যে।
এই অঞ্চলের আরেক শক্তিশালী দেশ তুরস্কের সাথে সম্পর্ক নিয়েও মিসরের উদ্বেগ রয়েছে। বিশেষ করে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সমুদ্রসীমা নিধারণ ও তেল-গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে আঞ্চলিক কয়েকটি দেশের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে। সেখানে তুরস্ক একটি শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। মিসর তুরস্কের প্রতিপক্ষ দেশ গ্রীস, সাইপ্রাস ও ইসরায়েলের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলে। এই চারটি দেশ মিলে গঠন করেছে ইষ্ট মেড গ্যাস ফোরাম। এই ফোরামের অফিস করা হয়েছে কায়রোতে। এসব দেশ পূর্ব ভূমধ্যসাগরের তলদেশের গ্যাস সম্পদ উত্তোলন করে তা ইউরোপে বিক্রি করার চেষ্টা করছে।
অন্যদিকে তুরস্ক পূর্ব ভূমধ্যসাগরের জলসীমা নতুন করে নির্ধরণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এ নিয়ে তুরস্ক ২০১৯ সালে লিবিয়ার জিএনএ সরকারের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। আঙ্কারা চেষ্টা করছে মিসর ও ইসরায়েলকে পাশে টানতে। তুরস্ক চাইছে মিসরের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন করতে। তবে মিসরের প্রেসিডেন্ট সিসি তুরস্কের এই ডাকে এখনও সাড়া দেননি। মিসর মনে করে তুরস্ক বর্তমানে আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে।
মিসরের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে তুরস্ক কি কি পদক্ষেপ নেয় তা দেখার জন্য কায়রো অপেক্ষা করছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তুরস্কের কছে কায়রোর কিছু চাওয়া রয়েছে। ২০১৩ সালে মিসরের তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাতাহ আল সিসি প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে আটক করে ক্ষমতা গ্রহনের পর মুসলিম ব্রাদারহুডের অনেক নেতাকর্মী তুরস্কে পালিয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট সিসি চাইবেন তুরস্ক তাদেরকে কায়রোর কাছে হস্তান্তর করুক। এছাড়া তুর্কি সৈন্যরা লিবিয়া ছেড়ে চলে আসবে সেই দাবিও রয়েছে কায়রোর। তুরস্ক মিসরের এসব দাবি পূরণ না করলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতির তেমন কোন সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।
সব কিছু মিলিয়ে বলা যায় যে, মিসর আর আগের অবস্থায় নেই। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাত নিরসনে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে এক নতুন মিসরের উত্থান ঘটেছে। এই ইস্যুতে কাজ করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে কায়রোর সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। অন্যান্য ইস্যুতেও মিসর নিজের অবস্থান সংহত করার চেষ্টা করছে।