সৌদি-ইরান সুসম্পর্কের আভাস


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ০১ জুলাই ২০২১, ১৪:১৩

ইব্রাহিম রাইসি ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই সৌদি আরবের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেহরানের ইতিবাচক মানসিকতার কথা জানিয়েছেন। তাহলে কি রাইসির যুগে দুই প্রতিবেশীর সম্পর্ক আবার স্বাভাবিক হবে? যদিও ইরানের রাজনীতিতে প্রেসিডেন্টই শেষ কথা নয়। কিন্তু অর্থনীতি, নিরাপত্তাসহ অনেক ইস্যুতে উভয় পক্ষের জন্যই এই সম্পর্ক জোড়া লাগার বিকল্প নেই। তাই পারস্য উপসাগরের দুই পাড়ের সম্পর্ক আবার গড়ে উঠতে পারে বলে আশাবাদী অনেকে।

ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি সংবাদ সম্মেলনে জোর দিয়েই বলেছেন, সৌদি আরব ও ইরানের মাঝে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে তেহরানের দিক থেকে কোনো বাধা নেই। একথা সত্যি হলে, ইরান-সৌদি দূরত্ব ঘুচতে পারে নিকট ভবিষ্যতে। তবে মধ্যপ্রাচ্যের দুই শক্তিশালী রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হলেও বিবাদমান বিষয়গুলো মীমাংসা হতে যে দীর্ঘ সময় লাগবে তাতে সন্দেহ নেই।

ইরানের সরকার ব্যবস্থায় বর্তমানে কট্টরপন্থীদের দাপট থাকলেও রাইসির বিজয় এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক ইতিবাচক পূর্বভাস বয়ে আনছে। এর স্পষ্ট কিছু লক্ষণও রয়েছে। ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর সাথে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির চেয়ে ইব্রাহিম রাইসির ঘনিষ্টতা বেশি। যে কারণে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, বিষয়টি ইরানের সাথে সৌদি আরব ও অন্যান্য উপসাগরীয় দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ইতিবাচক হবে।

১৯৭৯ সালের পর থেকেই তেহরানের সাথে এই দেশগুলোর সম্পর্কের তিক্ততা চলে আসছে। ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে বাগদাদে ইরান ও সৌদি কূটনীতিকরা যে সংলাপ চালিয়ে আসছেন, রাইসির যুগে সেটি আরো জোরালো হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।

উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ বা জিসিসি রাইসির বিজয়কে একটি সম্ভাব্য ইতিবাচক ফল হিসেবে দেখছে। এই দেশগুলো দেখছে যে, রুহানীর চেয়ে রাইসি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ও নিরাপত্তা বাহিনীর অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ। যে কারণে আঞ্চলিক আপোস রফায় তিনি বেশি সামর্থবান হবেন। এই পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি বাগদাদের চলমান সংলাপকে এগিয়ে নিতে উভয় পক্ষকে উৎসাহিত করবে।

জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় ছয় জাতির সাথে ইরানের পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে যে আলোচনা শুরু হয়েছে, তার বাইরে সৌদি আরব চাইছে ইরানের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপনের পথে অগ্রসর হতে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল কোম্পানি আরামকোতে ইয়েমেনের হুথিদের হামলার পর বোঝা গেছে, সৌদি আরব ওই অঞ্চলে ইরান সমর্থিত গোষ্ঠিগুলোর হামলা থেকে পুরোপুরি সুরক্ষিত নয়। এই বিষয়টি তেহরানের সাথে সংলাপে বসতে রিয়াদকে বাধ্য করেছে বলে মনে করা হয়।

সৌদি আরব চায় ইয়েমেন যুদ্ধের মতো আঞ্চলিক সঙ্কটগুলো দ্রুত মিটিয়ে ফেলতে, আর তারা বুঝতে পেরেছে যে, এজন্য ইরানের সাথে সংলাপই হলো সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি। অনেক বিষয় নিয়ে দুই পক্ষের মাঝে মতৈক্য থাকলেও সৌদি আরব আপাতত এই নীতিতেই চলবে বলে মনে করা হচ্ছে।

সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন সালমানের ভিশন-২০৩০-এ দেশটির অর্থনীতিকে তেল নির্ভরতা থেকে বের করে এনে বহুমুখী রূপ দেয়ার কৌশল নেয়া হয়েছে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন সহজ হবে যদি, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের অঞ্চলে স্থিতিশীলতা থাকে এবং সৌদি আরবের সীমান্ত সুরক্ষিত থাকে।

এক্ষেত্রে এমবিএস ওয়াশিংটনে তার অবস্থানকে কাজে লাগাতে পারেন । আঞ্চলিক ইস্যুর মীমাংসায় তিনি জো বাইডেনের প্রশাসনের সমর্থন ও রিয়াদের অনুকূলে কূটনৈতিক তৎপরতা চান। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও কোভিড- নাইটিনের কারণে ইরানের অর্থনীতি বিপর্যস্ত। যেটি তাদেরকে বাধ্য করবে সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় বাদশহাদের সাথে সংলাপে বসতে।

পশ্চিমা চাপ ও আঞ্চলিক উত্তেজনার পর উপসগারীয় আরব দেশগুলোর সাথে সংলাপে ইরানেরও স্বার্থ রয়েছে। আঞ্চলিক উত্তেজনা প্রশমিত হলে ইরান তার অর্থনীতিকে আবার দাড় করাতে পারবে । ইরান এই সুযোগটি নিতে চাইবে, কারণ তার সামনে আর বিকল্প পথ নেই।

সৌদি আরবের সাথে ইরানের সংলাপ জোরদার হলে অন্য জিসিসি দেশগুলোর ভুমিকা কেমন হবে সেটি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে ওই দেশগুলো রিয়াদ ও তেহরানের মধ্যে সেতু হিসেবে কাজ করবে বলেই বেশির ভাগ বিশ্লেষকের ধারণা।

সৌদি-ইরান বিরোধে সংযুক্ত আরব আমিরাত এক সময়ে অন্ধভাবে সৌদি আরবকে সমর্থন দিয়ে আসলেও, ২০১৯ সাল থেকে তারা উপসাগরীয় অঞ্চলের পরিবেশ শান্ত রাখতে এবং যুদ্ধ এড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে। এমন অনেকগুলো বিষয় রয়েছে যাতে ইব্রাহিম রাইসি ও মোহাম্মাদ বিন সালমানের প্রশাসনের মধ্যে মতৈক্য স্থাপনে কাজ করতে পারবে আবুধাবি।

মধ্যপ্রাচ্যের ছোট্ট দেশ কাতার অবশ্য এই ভুমিকায় সফল হওয়ার সম্ভবানার দিক থেকে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ঐতিহাসিক আল উলা সম্মেলনের পর কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানিয়েছিলেন, তার দেশ ইরান ও সৌদি আরবের বিরোধে মধ্যস্ততা করতে প্রস্তুত।

কাতারের অবশ্য কিছু সীমাবন্ধতা রয়েছে। ইরানের সাথে মধ্যস্ততার বিষয়ে কাতারের ওপর আস্থার সঙ্কট রয়েছে সৌদি-আমিরাত ব্লকের। এটি কাতারকে খুব একটা অগ্রসর হতে দেবে না। সৌদি আরব মনে করে ইরানের ব্যালেস্টিক মিসাইল সামর্থ কিংবা তাদের প্রক্সি নেটওয়ার্কের বিষয়ে কাতার যে ভুমিকা নেবে, সৌদি স্বার্থের বিষয়ে দেশটির ভুমিকা সমান হবে না।

তবে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক অবস্থা অস্থিতিশীল থাকলে কাতারই যে সবচেয়ে ভালো মধ্যস্ততাকারী হতে পারে সেটি নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই । তুরস্কের সাথে কাতারের বিশেষ সম্পর্ক এক্ষেত্রে গুরত্বপূর্ণ। এছাড়া আফগান শান্তি আলোচনার মূল মধ্যস্ততাকারী কাতার। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা অঞ্চলে আরো কিছু বিরোধী মীমাংসায় কাতার প্রশংসনীয় ভুমিকা রেখেছে ইতোপূর্বে।

অন্য দেশগুলোর মধ্যে কুয়েত ও ওমান মধ্যপ্রাচ্যের বিরোধে নিজেদের নিরপেক্ষ রাখার চেষ্টা করছে। এই অঞ্চলের বিরোধ নিরসনে সংলাপ আয়োজনেও তারা আগ্রহী।

সৌদি আরব মনে করছে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের বিষয়ে ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটি অযথা নয়, ইরান হয়তো এ বিষয়ে এখন অগ্রসর হওয়ার চিন্তা করছে। প্রেসিডেন্ট যেই হোক, ইরানের পররাষ্ট্র নীতির বিষয়ে প্রধান নীতি নির্ধারক দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। যে কারণে সৌদি আরব ও তার মিত্রদের চিরাচরিত ধারণা প্রেসিডেন্ট পদে পরিবর্তন আসা সত্ত্বেও তেহরানের আঞ্চলিক নীতি একই থাকবে।

ইব্রাহিম রাইসির সংবাদ সম্মেলনের প্রতিক্রিয়ায় সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান বলেছেন, তার দেশ ইরানের নতুন প্রেসিডেন্টের বক্তব্যেকে মূল্যায়ন করবে বাস্তবতার নিরিখে। সৌদি রাজপরিবারের সদস্য ও ব্যবসায়ী প্রিন্স তালাল আল ফয়সাল বলেন, আমি মনে করি না যে, বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে ইরানের প্রেসিডেন্ট প্রধান ভুমিকা রাখেন। সেখানে বিপ্লবী গার্ড বাহিনী ও পররাষ্ট্র নীতি সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করেন সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা।

সৌদি আরব হয়তো রাইসির এই ইতিবাচক বক্তব্যকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার পক্ষ থেকে নীতি পরিবর্তনের কোনো পূর্বাভাস হিসেবেও ধরে নিতে পারে। কারণ রাইসি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ও বিপ্লবী গার্ডের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। তিনি খামেনীর সরাসরি ছাত্র ছিলেন। তার পছন্দের পাত্র হওয়ার কারণেই মফস্বল শহরের প্রসিকিউটর থেকে ধীরে ধীরে উঠে এসেছেন প্রধান বিচারপতি পর্যন্ত।

ইব্রাহিম রাইসির বিজয়ের পর সৌদি আরব ও বাহরাইন কোনো অভিনন্দন বার্তা পাঠায়নি। এটিও অস্বীকার করার উপায় নাই যে, সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যকার কয়েক দশকের উত্তেজনা বৈরীতাকে পাশ কাটিয়ে দেশ দুটির ঐক্যমত্যে পৌছা কঠিন হবে।

তবে চলতি বছর বাগদাদে শুরু হওয়া দ্বিপক্ষীয় সংলাপ এই সম্পর্ক উন্নতির একটি লক্ষণ। তারপর নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট রাইসির ইতিবাচক বক্তব্য ইরানের দিক থেকে মনোভাব পরিবর্তনের আভাস নিয়েই হাজির হয়েছে। এই আভাস যদি বাস্তবে রূপ নেয়, পুরো অঞ্চলের জন্যই সেটি সুখবর বয়ে আনবে।