সৌদি-আমিরাত সম্পর্কে ফাটল!


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ০৭ জুলাই ২০২১, ১৪:২৬

তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর এক চুক্তিতে ঠকানো হচ্ছে, এমন অভিযোগ তুলে সৌদি আরবের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। কয়েক যুগের মিত্র দেশ দুটির এমন পরস্পর বিরোধিতা অবাক করেছে অনেককেই। দুবাইগামী ইসরাইলি বিমানকে সৌদি আরবের আকাশসীমা ব্যবহার করতে না দেওয়ার দেড় মাসের মধ্যেই ঘটল এই ঘটনা। এর সাথে কোভিড-১৯ মোকাবিলা নিয়ে দুই দেশের ভিন্ন অবস্থান, ইয়েমেন যুদ্ধ থেকে আরব আমিরাতের ফিরে আসার মতো ঘটনাগুলো মেলালে রিয়াদ ও আবুধাবির সম্পর্কে চিড় ধরার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

সৌদি আরবের কোনো সিদ্ধান্ত বা বক্তব্যের বিপক্ষে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পক্ষ থেকে পাল্টা বক্তব্য আসার ঘটনা বিরল। সেই ঘটনাই এবার ঘটেছে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর একটি সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে। কোভিড মহামারীর কারণে কমিয়ে দেওয়া তেলের উৎপাদন আবার ধীরে ধীরে বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে।

সে অনুযায়ী চলতি বছরের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন ২০ লাখ ব্যারেল তেলের উৎপাদন বাড়ানো হবে। উৎপাদন সীমিত রাখার এই পরিকল্পনার বিষয়ে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর মাঝে একটি চুক্তি হয়েছিল। যে চুক্তির মেয়াদ ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত। সৌদি আরবের নেতৃত্বে অন্য দেশগুলো চাইছে, এই চুক্তিটি আগামী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বহাল রাখতে। কিন্তু বেঁকে বসেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। তারা বলছে, তেল উৎপাদন সীমিত রাখার যে চুক্তি এখন কার্যকর রয়েছে, তাতে আরব আমিরাতকে অনেক বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হচ্ছে। তাই তাদের জন্য উৎপাদনের কোটা বৃদ্ধি না করে চুক্তিটিকে আর দীর্ঘায়িত করা যাবে না।

করোনাভাইরাসের প্রভাবে গত বছর বিশ^ব্যাপী ভ্রমণ ও পণ্য পরিবহন প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জ¦ালানি তেলের ব্যবহার অনেক কমে গেছে। যে কারণে তেল উৎপাদনও কমিয়ে দেয়া হয়েছিল ওই চুক্তির মাধ্যমে। কিন্তু আরব আমিরাত এখন বলছে, মার্কেটে চাহিদা বেড়েছে তাই তেলের উৎপাদন বাড়নো দরকার। চুক্তির বর্তমান শর্ত অনুযায়ী সংযুক্ত আরব আমিরাতকে যেখানে ১৮ শতাংশ তেল উৎপাদন কমাতে হয়েছে, সেখানে সৌদি আরবের উৎপাদন কমেছে ৫ শতাংশ।

জুলাইয়ের প্রথম শুক্রবার এক ভার্চুয়াল বৈঠকে বসেছিল তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো। ওই বৈঠকে ওপেকভূক্ত ১৩টি দেশ এবং ওপেকের বাইরের তেল উৎপাদনকারী দেশ। যাদেরকে ওপেক প্লাস নামে ডাকা হয় সে সব দেশ উপস্থিত ছিলো।কিন্তু কোন সমাধান আসেনি। বরং সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিরোধীতার কারণে সৌদি আরবের এই প্রস্তাব নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি সংযুক্ত আরব আমিরাত ওপেক ছেড়ে বেড়িয়ে যাবে কিনা সেই গুঞ্জনও উঠেছে।

আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুহাইল আল মাজরৌউই বলেছেন, পুরনো শর্তে নতুন চুক্তি করবো না আমরা। এ বিষয়ে আলোচনার অধিকার আমাদের আছে। ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক খবরে বলা হয়েছে, আরব আমিরাতের ওপেকে থাকা উচিত কিনা সেটি নিয়ে দেশটির জাতীয় তেল কোম্পানির কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে।

রিয়াদের সাথে আবুধাবির যে সম্পর্ক তাতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের এমন অবস্থান অবাক করেছে সবাইকে। বহু বছর ধরেই সৌদি আরবের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে চলছে দেশটি। যে কোন ইস্যুতে তারা এক হয়ে ভুমিকা রাখে। গলায় গলায় ভাব বলতে যা বোঝায়- এই সম্পর্ক যেন তার চেয়েও বেশি। সৌদি আরবের মিত্র না হলেও আরেক প্রতিবেশী দেশ ইরাকও মেনে নিয়েছে নতুন প্রস্তাবটি।

অর্থায়ন বিষয়ক প্রতিষ্ঠান আরবিসি ক্যাপিটাল মার্কেটের বিশ্লেষক হেলিমা ক্রফট ধারণা করছেন, এই বিরোধ মীমাংসা না হলে তেল উৎপাদন বিষয়ে চুক্তিতে পৌঁছতে পারবে না দেশগুলো। এমনকি ওপেক ছেড়ে বেরিয়েও যেতে পারে সংযুক্ত আরব আমিরাত। সৌদি আরবের সাথে আমিরাতের এই দূরত্ব ঘোচাতে হয়তো হোয়াইট হাউজকেও নাক গলাতে হতে পারে।

কারণ চুক্তি না হলে কিংবা ওপেকে ভাঙন দেখা দিলে বিশ^ অর্থনীতিতে অস্থিরতা দেখা দেবে। যা সামাল দেয়া হবে কষ্টকর। গত বছর তেল উৎপাদনের কোটা পদ্ধতি নিয়ে সৌদি আরব ও রাশিয়ার মধ্যে বনিবনা না হওয়ায় তেলের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছিল।

সৌদি আরবের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাতের এই মতবিরোধ শুধু তেলের উৎপাদন নিয়ে না অন্য ক্ষেত্রেও সে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বেশ কিছুদিন ধরেই বিভিন্ন বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে মতবিরোধের সুর দেখা যাচ্ছে। যার সূত্রপাত হয়েছিল ২০১৯ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত ইয়েমেন যুদ্ধ থেকে সরে আসার পর। ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সৌদি আরবকে একা ফেলে আসে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশটি। এরপর সেখানে আমিরাতের সমর্থিত একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠি সৌদি আরব সমর্থিত সরকারের সাথে সঙ্ঘাতে লিপ্ত হয়।

ইয়েমেন যুদ্ধ নিয়ে সৌদি আরব এমনিতেই অনেক সমালোচনার মুখে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আরব আমিরাত তাদের ত্যাগ করায় রিয়াদ সেটি ভালো ভাবে নেয়নি। এরপর কাতারের ওপর সৌদি আরবের নেতৃত্বে আরোপ করা অবরোধ প্রত্যাহারের সময় দুই দেশের মধ্যে মতবিরোধ ছিলো। সৌদি আরবকে এত দ্রুত কাতারের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে নিষেধ করেছিল আবুধাবি। কিন্তু তাতে কান না দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্ততায় কাতারের ওপর অবরোধ তুলে নেয় ও সম্পর্ক পুন:স্থাপন করে রিয়াদ।

অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্ততায় ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। সৌদি আরব সেই পথে হাঁটেনি। কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর বিমান চলাচল, পর্যটক ভিসা চালুসহ অনেক কিছুতে ইসরাইলের সাথে জড়িয়েছে আবুধাবী। সৌদি আরব এতে বাধা না দিলেও এতটা তাড়াহুড়ো পছন্দ করেনি বলেই মনে করা হচ্ছে। এরপর চলতি বছর মে মাসের শেষ দিকে হঠাৎ করেই ইসরাইল থেকে দুবাইগামী যাত্রীবাহী বিমানের জন্য সৌদি আরব তার আকাশসীমা ব্যবহার বন্ধ করে দেয় রিয়াদ।

বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়, সেদিন তেলআবিবের বেনগুরিয়ন বিমানবন্দরে ১০ ঘণ্টা অপেক্ষার পরও সৌদি আরবের আকাশ দিয়ে আরব আমিরাতে যাওয়ার অনুমতি পায়নি একটি ফ্লাইট। শেষ পর্যন্ত ইসারাইলি এয়ারলাইন্সের ওই বিমানের যাত্রা বাতিল করা হয়। সৌদি আকাশ সীমা ব্যবহার করে ইসরাইল থেকে আরব আমিরাত যাওয়া যায় তিন ঘণ্টায়। না হলে এই যাত্রায় সময় লাগে ৮ ঘণ্টা। গত নভেম্বর থেকে এই রুটে নিয়মিত বিমান চলাচল শুরু হলেও, সৌদি আরব হঠাৎ করেই তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের বিষয়ে কোন ব্যাখ্যা দেয়নি।

করোনাভাইরাস মোকাবেলা নিয়েও মতপার্থক্য দেখা গেছে দুই মিত্র দেশের। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে সৌদি আরব সংক্রমণ বাড়ার শঙ্কায় যে তিনটি দেশের সাথে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করেছে তার একটি সংযুক্ত আরব আমিরাত। অন্য দেশ দুটির নাম ইথিওপিয়া ও ভিয়েতনাম। আবার সংযুক্ত আরব আমিরাত তার নাগরিকদের ভ্যাকসিনের আওতায় আনার জন্য চীনা ভ্যাসকিনের অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু সৌদি আবর বলেছে- তারা চীনা ভ্যাকসিনকে স্বীকৃতি দেবে না। এই সিদ্ধান্ত আরব আমিরাতের নাগরিকদের বিপাকে ফেলবে এবং দেশটির শাসকদের অসন্তুষ্ট করছে।

কিছুদিন আগে বেশ কিছু বিদেশী কোম্পানিকে সৌদি আরব জানিয়েছে তাদের সরকারের সাথে লাভজনক চুক্তি টিকিয়ে রাখতে হলে রিয়াদে কার্যালয় স্থানান্তর করতে হবে। দেখা গেছে, সেসব কোম্পানির বেশির ভাগেরই প্রধান বা আঞ্চলিক কার্যালয় আমিরাতের বাণিজ্য নগরী দুবাইয়ে। এছাড়া সম্প্রতি সৌদি আরব এক ঘোষণায় বলেছে,ইসরাইলে পুরোপুরি বা আংশিক তৈরি কোন পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক মওকুফের সুযোগ থাকবে না। যেসব কোম্পানির মালিকানায় ইসরাইলি শেয়ার রয়েছে সেগুলোর ক্ষেত্রেও এই আইন প্রযোজ্য হবে।

এতে বড় ধরণের ক্ষতি হবে আরব আমিরাতের। কারণ দেশটির ফ্রি বিজনেস জোনের সুযোগ নিয়ে অনেক ইসরাইলি মালিকানাধীন কোম্পানি সেখানে ব্যবসা করে। ইসরাইল ও আরব আমিরাতের মাঝে গত মে মাসে ট্যাক্স চুক্তিও সম্পাদিত হয়েছে। সৌদি আরব এ ধরনের পণ্য আমদানিতে শর্ত দিলে সেটি আমিরাতকে অসুবিধায় ফেলবে।

গত কয়েক বছর ধরেই সৌদি আরব তার অর্থনীতিকে তেল নির্ভরতা থেকে বের করে এনে বৈচিত্র দিতে চাচ্ছে। এ জন্য তারা নজর দিয়েছে পর্যটন, ট্রেডিং বিজনেসহ বেশ কিছু সেক্টরে। আর এতে ভাগ বসাতে যাচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মুনাফায়। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের পর্যটন ও বাণিজ্যে একচেটিয়া প্রভাব আমিরাতের। এটিও প্রতিযোগীতায় নামিয়ে দেবে দেশ দুটিকে।

আরব আমিরাতের সাথে যেসব বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে, সেগুলো নিয়ে সৌদি আরব বলছে, ব্যবসায়িক কিংবা নিরাপত্তার স্বার্থে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দুই দেশের সম্পর্ক যে আর আগের মতো নেই, সেটি এখন স্পষ্ট।