সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিষ্ঠাতা শেখ জায়েদ ১৯৭১ সালে ইসরায়েলকে ‘শত্রু’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছিলেন, ‘কোনো আরব দেশই এই শত্রু থেকে নিরাপদ নয়।’ কিন্তু তার এই ঘোষণার ৫০ বছর পেরিয়ে এসে আরব আমিরাত এখন সেই শত্রু দেশের সাথেই সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়ার লাপিড এ মাসেই আরব আমিরাত সফর করেছেন। লাপিডই হচ্ছেন ইসরায়েলের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি আরব আমিরাত সফর করেন। তার এই সফরে আরব আমিরাতে ইসরায়েলের দূতাবাস উদ্বোধন করা হয়।
বিগত ৫০ বছরের পথ পরিক্রমায় আরব আমিরাত একদিকে যেমন বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়েছে, অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় যথেষ্ট প্রভাব-প্রতিপত্তিও অর্জন করেছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রেও দেশটিতে এসেছে অনেক পরিবর্তন। আরব আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান যিনি এমবিজেড নামে পরিচিত, তার উচ্চাভিলাষী পররাষ্ট্রনীতির কারণে দেশটি অনেকটা অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। তার ভিশন হচ্ছে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও আরব আমিরাতকে নেতৃত্বের আসনে নিয়ে আসা। সে কারণেই লিবিয়া থেকে আফ্রিকার শৃঙ্গ, সুদান থেকে উপসাগরীয় অঞ্চল- সর্বত্রই আরব আমিরাতের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মোহাম্মদ বিন জায়েদ কার্যত জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে সামনে এগোচ্ছেন। তার সামনে কোনো ন্যূনতম হুমকি তৈরি হওয়ার আগেই তিনি সেটাকে নির্মূল করে ফেলতে চাইছেন। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই বিভিন্ন হুমকির মধ্যে ইসলামপন্থী ও সেকুলার গণতন্ত্রীদের হুমকিও রয়েছে। তিনি আরববিশে^ বর্তমান শাসকদের রক্ষায় আঞ্চলিক প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু দেশের বাইরে লিবিয়াসহ কয়েকটি স্থানে তার হস্তক্ষেপ সফলতা বয়ে আনেনি।
যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পরিবর্তন হওয়ায় দেশের বাইরে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদের এসব পরিকল্পনা নতুন করে সাজাতে হবে। এমনকি পিছু হটতে হবে। জো বাইডেনের প্রশাসন বর্তমানে মানবাধিকার ইস্যু, ইয়েমেনে সংঘাত ও ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার টেবিলে ফিরে আসাকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। এমবিজেড-এর নেতৃত্বাধীন আরব আমিরাত এখন বাইডেন প্রশাসনের কাছে এটা প্রমাণ করতে চাইছে যে, এসব ক্ষেত্রে তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিশ^স্ত অংশীদার হতে পারে। এর অংশ হিসেবে আরব আমিরাত এখন বিপজ্জনক ইসরায়েল কার্ড খেলছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের পরম মিত্র হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করছে।
১৯৭১ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত। এরপর থেকে পরবর্তী কয়েক দশকে দেশটি তার তেল ও গ্যাস সম্পদের ওপর নির্ভর করে ব্যাপক অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করে। বিশেষ করে আমিরাতের সবচেয়ে বড় রাজ্য আবুধাবি-কেন্দ্রিক উন্নয়ন হয়েছে চোখে পড়ার মতো। আরব আমিরাতের প্রথম শাসক আবুধাবির আমির ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান। তিনি চেয়েছিলেন যে, তার দেশের সম্পদ যেন জনগণের মধ্যে ভালোভাবে বণ্টন করা হয়। ২০০৪ সালে তিনি মারা যান। ততদিনে আরব আমিরাত বিশে^র সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর একটিতে পরিণত হয়ে গেছে।
শেখ জায়েদের পর আরব আমিরাতের শাসক হন শেখ খলিফা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অসুস্থ হয়ে পড়ায় প্রকৃত শাসন ক্ষমতা আস্তে আস্তে চলে যায় তার উত্তরসুরী হিসেবে নির্ধারিত থাকা মোহাম্মদ বিন জায়েদ বা এমবিজেড-এর হাতে। ২০০৮-০৯ সালের দিকে তার অবস্থান আরও সংহত হয়। এ সময়ে বিশে^ অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে এর প্রভাব আরব আমিরাতেও গিয়ে পড়ে। বিশেষ করে এর অন্যতম রাজ্য দুবাই মারাত্মক আর্থিক সংকটে পড়ে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মদ আবুধাবির শাসকের কাছে যেতে বাধ্য হন।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাতটি রাজ্যের বা আমিরাতের মধ্যে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি নিয়ে সবচেয়ে বেশি দ্বন্দ্ব চলে আসছিল আবুধাবি ও দুবাইয়ের শাসকদের মধ্যে। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে দুবাই দুর্বল হয়ে পড়ায় ও আবুধাবির কাছে সহায়তার জন্য হাত পাতায় সেই সুযোগটি গ্রহণ করেন আবুধাবির শাসক। তিনি এমবিজেডকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভবিষ্যৎ শাসক হিসেবে মেনে নিতে দুবাইয়ের শাসককে বাধ্য করেন। ফলে এমবিজেড-এর ক্ষমত নিরঙ্কুশ হয়।
২০১১ সালে ‘আরব বসন্ত’ শুরু হলে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশগুলোতে শাসকদের বিরুদ্ধে শুরু হয় গণআন্দোলন। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় সিরিয়া ও মিসরে। ফলে এসব দেশ আঞ্চলিক ভূরাজনীতির মানচিত্র থেকে ছিটকে পড়ে। দেশে দেশে শাসকদের বিরুদ্ধ গণআন্দোলন শুরু হলে তা দেখে এমবিজেড অনেকটা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এই গণআন্দোলনের ঢেউ কুয়েত, বাহরাইনসহ উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতেও এসে লাগে। তখন এমবিজেড এটা অনুধাবন করেন যে, জনগণ সুযোগ পেলে তিউনিশিয়া ও মিসরের মতো উপসাগরীয় অঞ্চলেও ইসলামপন্থী দলগুলোকে ভোট দেবে।
আরব বসন্তের ফলে সংযুক্ত আরব আমিরাতেও এমন কিছু পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যার ফলে পুরো দেশের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব এমবিজেড এর হাতে চলে আসে। ভবিষ্যত ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে দুবাইসহ অন্য কোন রাজ্যের আর মাথা তুলে দাড়াতে পারছে না। এমনকি ইসলামপন্থি কোনো দল বা গ্রুপও এসময় তার সামনে কোন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারেনি। এসময় এমবিজেড এর হাতে বিপুল পরিমান অর্থ সম্পদও ছিল। ফলে সার্বিক পরিস্থিতিই ছিল তার অনুকূলে।
আরব আমিরাত বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে নানা ক্ষেত্রে নিজের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে যাচ্ছে। উপসাগর, আরব সাগর, এডেন উপসাগর ও লোহিত সাগরে দেশটির নানা স্বার্থসংশ্লিষ্ট উপস্থিতি রয়েছে। ইয়েমেন সংঘাতে জড়িয়ে সেখানে নিজের অবস্থান শক্ত করে আরব আমিরাত এখন এসব অঞ্চলে তার নানা স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করে যাচ্ছে।
২০১৫ সালে সৌদি আরবের নেতৃত্বে গঠিত জোটে যোগ দিয়ে ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে আরব আমিরাত। সেখানে এই জোট ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহিদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। ঐ সময় হুথি বিদ্রোহিরা ইয়েমেনের ক্ষমতা দখলের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছিল। কিন্তু আমিরাতি সৈন্যরা অভিযান চালিয়ে বিদ্রোহিদেরকে দক্ষিন ইয়েমেন থেকে বিতাড়িত করে।
এরপর ২০১৭ সালে সৌদি আরব, বাহরাইন ও মিসরের সাথে যোগ দিয়ে আরব আমিরাত কাতারের উপর কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। তখন এসব দেশের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল যে, কাতার আরব বসন্ত ও মিসরের ইসলামি আন্দোলন মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন দিয়েছে।
এসব ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ দেশটির কৌশলগত স্বার্থে করা হলেও পরবর্তীতে আরও অনেক ক্ষেত্রেই নিজেকে জড়িয়ে ফেলে আরব আমিরাত। যে কোন দেশ যখন ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি দেখাতে থাকে তখন অনিবার্যভাবে দেশটি স্থানীয় নানা বিরোধেও জড়িয়ে পড়ে। আরব আমিরাত একই ভাবে আরব উপদ্বীপ থেকে অনেক দূরের বিরোধেও জড়িয়ে গেছে। আফ্রিকার দেশ ইরিত্রিয়া, সুদান, জিবুতি, সোমালিয়া ও সোমালিল্যান্ডের বিরোধেও নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে। কাতারের সাথে বিরোধে জড়াতে গিয়ে আরব আমিরাত কাতরের মিত্র দেশ তুরস্কের সাথেও বিভিন্ন ইস্যুতে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে।
লিবিয়ায় ত্রিপোলিবিত্তিক জাতিসংঘ সমর্থিত সাবেক গভর্ণমেন্ট অব ন্যাশনাল অ্যাকর্ড বা জিএনএকে সমর্থন দিয়েছে তুরস্ক। অন্যদিকে এই সরকারের প্রতিপক্ষ হিসেবে পরিচিত লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় বিদ্রোহী জেনারেল খলিফা হাফতারকে সমর্থন করেছে আরব আমিরাত। এছাড়া পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সমুদ্রসীমা ও তেল-গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে তুরস্কের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে গ্রীস ও সাইপ্রাস। বর্তমানে এই দুটি দেশের সাথে হাত মিলিয়েছে আরব আমিরাত। বিশ্লেষকরা বলছেন এজন্য আরব আমিরাতকে এখন বিভিন্নভাবে মূল্য দিতে হবে।
বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে আরব আমিরাতের হস্তক্ষেপ বড় ধরণের ব্যর্থতার মুখ দেখেছে। যেমন লিবিয়ায় আরব আমিরাত তার হিসাবে ভুল করে ফেলেছে। এমবিজেডে ধারণা ছিল লিবিয়ার সংঘাতে জেনারেল হাফতারই জিতবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ঘটেনি। কাতারের উপর অবরোধ আরোপও কোনো কাজ করেনি, এটি ব্যর্থ হয়েছে। ইয়েমেনের সংঘাতে দেশটির দক্ষিনাঞ্চলে আরব আমিরাত সফলতা পেলেও উত্তরাঞ্চলে সৌদি আরব তার লক্ষ্য অর্জনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।
২০১৯ সালে ইউএই তার নিয়মিত বাহিনী ইয়েমেন থেকে সরিয়ে আনে। কিন্তু তারপরও তারা ইয়েমেনের স্থানীয় মিলিশিয়া গ্রুপগুলোকে অস্ত্র, অর্থ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করা অব্যাহত রাখে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতার মেয়াদের শেষের দিকে আরব আমিরাত ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করলেও সৌদি আরব তা করেনি। এমবিজেড নানা দিকে জড়িয়ে চারদিকে শত্রু তৈরি করে ফেলেছেন। নিজের নিরাপত্তার জন্য তিনি ইসরায়েলমুখী হয়েছেন। আগামি দিনে এর ফল হতে পারে মারাত্নক।
আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোর হাতে বিপুল অর্থ থাকলেও বাস্তবে এগুলো আর্টিফিসিয়াল স্টেট। কোনো না কোনো দেশের ওপর নির্ভর করে টিকে থাকতে হয়। রাষ্ট্র হিসাবে ইসরায়েলের চরিত্র অনেকটা একই রকম। আরব আমিরাতের উল্টো দিকে ইরান। ইসরায়েলের সাথে আরব আমিরাতের মাখামখি ইরান নিজেদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসাবে দেখছে। আবার আরেক শক্তিশালী দেশ তুরস্কের সাথে বিরোধে জড়িয়েছে আরব আমিরাত। ইসরায়েলের সাথে ঘনিষ্টতা ভালোভাবে নেবে না তুরস্ক। আরব আমিরাতের ইসরায়েল নির্ভরতা আমিরাতের জন্য আরও বেশি ঝুঁকি তৈরি করছে।
যুবরাজ ও অঘোষিত শাসক এমবিজেড-এর বর্তমান বয়স ৬০ বছর। তিনি সম্ভবত আরও ২০ থেকে ২৫ বছর সময় পাবেন। যুবরাজ থেকে আমির হবেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতকে তিনি পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর নেতৃত্বে নিয়ে যাওয়ার যে টার্গেট নিয়ে কাজ করছেন, তাতে কতটুকু সফল হবেন না সংকটে পড়বেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।