গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে এমবিএসের লড়াই


  • মোতালেব জামালী
  • ১৭ জুলাই ২০২১, ১৪:৫০

সৌদি আরবের অঘোষিত শাসক যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এবং দেশটির সাবেক গোয়েন্দা প্রধান সাদ আলজাবরির মধ্যে আইনি লড়াইয়ে বেকায়দায় পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পরস্পরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি এই মামলার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন গোয়েন্দা তথ্য প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার হুমকির মুখে পড়েছে। আলজাবরি দায়িত্বে থাকার সময় কী ভূমিকা পালন করেছেন, তা প্রমাণ করতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে থাকা গোয়েন্দা নথিপত্র আদালতে তলব করার আবেদন জানানো হয়েছে। এ নিয়ে জটিল পরিস্থিতিতে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যার প্রভাব পড়তে পারে দুই দেশের সম্পর্কের ওপর।

সৌদি আরবের সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সাকাব সৌদি হোল্ডিং গত মার্চ মাসে সাদ আলজাবরির বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করে। মামলায় জাবরির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে, সাবেক যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফের অধীনে তিনি গোয়েন্দা প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ-সময় গোপন গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনার নামে রাষ্ট্রের ৩ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আত্মসাৎ করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে সাদ আলজাবরির ২৯ মিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি জব্দ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে আবেদন করা হয়েছে। এছাড়া কানাডার আদালতেও জাবরির বিরদ্ধে দুর্নীতির মামলা করেছে কয়েকটি সৌদি প্রতিষ্ঠান। এরপরই জাবরির সম্পদ জব্দ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত।

নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগের জবাবে আলজাবরি বলেছেন, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে মিলেই কাজ করেছেন। এসব অভিযানে সৌদি আরবের কী পরিমাণ অর্থ কোথায় কীভাবে খরচ হয়েছে, তার সব তথ্যই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে রয়েছে। এসব তথ্য আদালতে উপস্থাপন করার নির্দেশ দিতে তার আইনজীবী আবেদন করেছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কখনও তার স্পর্শকাতর গোয়েন্দা তথ্য প্রকাশ করবে না।

যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার আদালতে চলমান এই মামলার কার্যক্রম কীভাবে থামিয়ে দেওয়া যায়, তা নিয়ে কোনো কূল-কিনারা করতে পারছে না বাইডেন প্রশাসন। শেষ পর্যন্ত আদালতের কাজে হস্তক্ষেপ করার মতো বিরল ঘটনাও ঘটতে পারে বলে মার্কিন কর্মকর্তারা আভাস দিয়েছেন।

কানাডায় বসবাসরত আলজাবরি এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে সৌদি যুবরাজ সালমানের বিরুদ্ধে তাকে হত্যাচেষ্টার মামলা করেছেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, বিন সালমান তাকে হত্যা করার জন্য কানাডায় গুপ্ত ঘাতকের দল পাঠিয়েছিলেন। দুই জনের পাল্টাপাল্টি মামলাই বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে।

দুই পক্ষের এই মামলা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চরম বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বাইডেন প্রশাসনকে এখন দেশে ও দেশের বাইরে আদালতের কাজে হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এ ধরনের কিছু ঘটলে তা হবে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা।

সাদ আলজাবরি ২০১৭ সালে সৌদি রাজপরিবারে গৃহবিবাদ ও পরে ক্ষমতার পালাবদলের আগে পর্যন্ত দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও গোয়েন্দা প্রধান ছিলেন। তিনি ছিলেন সাবেক যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফের ডান হাত হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বিন সালমানের আগে মোহাম্মদ বিন নায়েফ ছিলেন সিংহাসনের সম্ভাব্য উত্তরসুরী। কিন্তু প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই তিনি কারাবন্দি রয়েছেন।

২০০০ এর দশকে আলকায়েদাকে পরাজিত করার পেছনে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফের ভূমিকাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। সে সময় সৌদি আরবের সঙ্গে ‘ফাইভ আইস’ নামে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কের মূল মাধ্যম ছিলেন সাদ আলজাবরি। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি করা আলজাবরি এক পর্যায়ে মেজর জেনারেল পদমর্যাদা লাভ করেন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন।

পরিস্থিতি পাল্টে যায় ২০১৫ সালে বাদশাহ আব্দুল্লাহ মারা যাওয়ার পর। তার সৎভাই সালমান বিন আব্দুল আজিজ বাদশাহ হন এবং নিজের ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমানকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিয়োগ দেন। এরপর ২০১৭ সালে বাদশাহ সালমান তার উত্তরাধিকার হিসেবে নাটকীয় পরিবর্তন আনেন। ওই সময় বাদশাহ সালমানের সম্মতিতে মোহাম্মদ বিন সালমান রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানে মোহাম্মদ বিন নায়েফকে সরিয়ে নিজেই হয়ে যান যুবরাজ বা ক্ষমতার পরবর্তী উত্তরাধিকারী। মোহাম্মদ বিন নায়েফকে আটক করা হয়।

এরপর যুবরাজ সালমান রাজপরিবারে ও প্রশাসনে তার বিরোধীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন। ফলে গ্রেফতারের ভয়ে প্রায় তিন বছর আগে সৌদি আরব ছাড়েন আলজাবরি। এরপর তুরস্ক হয়ে কানাডায় পাড়ি জমান। বর্তমানে তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন। হত্যাচেষ্টা ও পাল্টাপাল্টি মামলা যুবরাজ সালমানের সঙ্গে সাবেক যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফ ও আলজাবরির মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ বলে ধারণা করা হয়।

আলজাবরি অভিযোগ করেছেন, তাকে সৌদি আরব ফেরানোর জন্য বিন সালমান একাধিকবার চেষ্টা করেছেন। এমনকি ব্যক্তিগত ম্যাসেজও পাঠিয়েছেন। সেগুলোর মধ্যে একটি ম্যাসেজের বক্তব্য ছিল ‘আমরা নিশ্চিতভাবে তোমার কাছে পৌছাবো।’ সাদ আলজাবরিকে হাতের মুঠোয় পাওয়ার জন্য যে মরিয়া হয়ে উঠেছেন বিন সালমান তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তার উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে দেশে থাকা তার ভাই, ছেলে ও জামাতাকে এরইমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনসহ পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সৌদি আরবের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিলেন আলজাবরি। ওয়াশিংটনের আশঙ্কা, আদালতে এই লড়াই তাদের গোপন গোয়েন্দা অভিযানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব তথ্য প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয় রয়েছে।

গত বছর যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন আল-জাবরি। ওয়াশিংটন ডিসির আদালতে দায়ের করা এই মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, তার কাছে থাকা ‘সংবেদনশীল তথ্যে’র কারণে তার মুখ বন্ধ করার জন্য তাকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন যুবরাজ সালমান। তুরস্কে সৌদি কন্স্যুলেটে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে ২০১৮ সালে হত্যার পর পরই তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। বলে তিনি অভিযোগ করেন।

মামলায় জাবরি উল্লেখ করেন, তাকে হত্যার জন্য কানাডায় গুপ্ত ঘাতক টিম ‘টাইগার স্কোয়াড’ এর সদস্যদের পাঠিয়েছিলেন বিন সালমান। টরেন্টোর পিয়ারসন বিমানবন্দর দিয়ে ঘাতকরা কানাডায় প্রবেশ করার সময় সীমান্ত রক্ষীদের সন্দেহ হয়। এ সময় তারা সন্দেহভাজন এই লোকদের কানাডায় প্রবেশে বাধা দেন। ফলে তাকে হত্যার এই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। মামলায় বলা হয়, সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যার জন্যও এই টাইগার স্কোয়াডকে তুরস্কে পাঠিয়েছিলেন বিন সালমান।

আলজাবরির এই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত যুবরাজ বিন সালমানের প্রতি সমন জারি করেছিল। অন্যদিকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন এই মামলা থেকে কীভাবে যুবরাজ সালমানকে অব্যাহতি দেয়া দেয়া যায় তা নিয়ে নানা পরিকল্পনা করেছিল। ডোনাড ট্রাম্পের সঙ্গে যুবরাজ সালমানের ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। কিন্তু ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজয়ের পর ট্রাম্পের সেই পরিকল্পনা আর বাস্তবায়ন করা যায়নি।

যুবরাজ সালমান ও আলজাবরির পরস্পরের বিরুদ্ধে করা মামলার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কি সিদ্ধান্ত নেবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, আলজাবরি যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। অনেক কর্মকর্তা তার কাজের প্রশংসা করে কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি লিখেছেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের একজন কর্মকর্তা গত বছর আগষ্ট মাসে সিনেটরদের কাছে লেখা চিঠিতে বলেছেন, আলজাবরি যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমাদের সঙ্গে নিবিড়ভাকে কাজ করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মূল্যবান কাজের অংশিদার হয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ গত এপ্রিল মাসে ম্যাসাচুসেটস-এর আদালতে দেওয়া লিখিত বক্তব্যে বলেছে। আলজাবরির মামলার বিষয়ে কোনো তথ্য প্রদানের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত।

এর মাসখানেক পর বিচার বিভাগ আদালতে দেয়া আরেক আবেদনে সরকারকে আরও সময় দেওয়ার অনুরোধ জানায়। বিষয়টি স্পর্শকাতর ও নিরাপত্তা ইস্যুর সঙ্গে জড়িত বলে বিচার বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ বিষয়ে আরও গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিতে চান। তবে ওই আবেদনে একথাও বলা হয় যে, সরকার মামলার বিষয়ে আদালতকে ‘গোপনীয়’ কিছু তথ্য জানাতে প্রস্তুত রয়েছে।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাইডেন সরকার ‘রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা আইনের’ সহায়তা নিতে পারে। এই আইন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর তথ্য প্রকাশে আদালতের নির্দেশ দেয়ার ক্ষমতাকে রহিত করবে। কিন্তু কানাডার আদারতে করা মামলাটি যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে মোকাবেলা করবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, গত ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সৌদি আরব একটি স্থিতিশীল দেশ হিসেবে সময় পার করেছে। বর্তমানে দেশটি আর মোটেও স্থিতিশীল নয়। যুবরাজ সালমান কেবল খাশোগি বা আলজাবরির জীবনের জন্যই হুমকি নয়, সৌদি আরবের অস্তিত্বের জন্যও এক বিরাট হুমকি। তিনি বর্তমানে ক্ষমতায় আরোহনের সিঁড়িতে আছেন। তিনি যদি বাদশাহ হয়ে যান, তখন হয়তো এক চরম অস্থিতিশীল সৌদি আরব দেখতে হবে। এই পরিস্থিতিতে দেশটিতে হয়তো আরও অস্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবর্তন আসতে পারে।