রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য যে প্রচারণা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, তাতে অংশ নেয়নি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। কোন মুসলিম দেশই এখন পর্যন্ত রাশিয়ার বিপক্ষে অবস্থান নেয়নি। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র সৌদি আরব আর সংযুক্ত আরব আমিরাত। তারাও মার্কিন ডাকে সাড়া দেয়নি। ইরান আর সিরিয়া প্রকাশ্যেই রাশিয়াকে সমর্থন দিয়েছে। তুরস্ক কোন পক্ষ না নিয়ে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে। বেলারুশের বৈঠক আয়োজনের পেছনে আংকারা ভূমিকাও রেখেছে। চাঞ্চল্যকর বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরাইলও ওয়াশিংটনের আহ্বানে সাড়া দেয়নি। ওয়াশিংটন ইউক্রেনকে আয়রন ডোম মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম দিতে চেয়েছিল। ইসরাইল তার বিরোধীতা করেছে। তারা পরিস্কার জানিয়েছে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোন সঙ্ঘাতে যেতে চায় না তারা। প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট উল্টো প্রেসিডেন্ট পুতিনকে টেলিফোন করেছেন। ইউক্রেনের সাথে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্র আর ন্যাটোর সাথে রাশিয়ার উত্তেজনার দৃশ্য দেখতে দেখতে বিশ্ব সম্প্রদায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এই শত্রুতা ইউক্রেনে সামরিক সঙ্ঘাতে গড়িয়েছে। পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে। যে ধরণের জটিলতা পুরো স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়েও দেখা যায়নি।
কৌতুহলের বিষয় হলো, পশ্চিমের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রকাশ্যেই আলোচনা হচ্ছে, কেন ইউক্রেন থেকে আসা শরণার্থীদের জন্য ইউরোপীয় দেশগুলোর দরজা খুলে দেয়ার নীতি গ্রহণ করতে হবে। এই সব আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে আধুনিকতার খোলসের আড়ালে ইউরোপে একটা ভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রবাহ জারি রয়েছে।
পশ্চিমা সাংবাদিকরা আবেগের সাথে এই যুক্তিতর্কে অংশ নিচ্ছেন যে, ইউক্রেন থেকে আসা শরণার্থীরা ওই মুসলিম দেশগুলো থেকে আসা ‘অর্ধ-মানবদের’ মতো নয়। যারা ইউরোপের দরজায় নক করে আশ্রয় চাচ্ছে। বরং ইউক্রেনের এই শরণার্থীরা হলো খ্রিস্টান। তার উপর তাদের চুল সোনালী, আর চোখের রং হালকা।
যখন কোন বিপর্যয়কর পরিস্থিতি উপস্থিতি হয়, তখন ইউরোপিয়ানদের সাংস্কৃতিক আর আধুনিকতার খোলস সরে যায় এবং তাদের আসল চেহারাটা উলঙ্গ হয়ে বেরিয়ে আসে। এখানে শিক্ষাদীক্ষা বা সম্পদের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। সবার ক্ষেত্রেই এটা ঘটে।
আমরা এখন এটাও দেখছি যে, এমনকি অ্যান্টনিও ম্যানুয়েল ডি ওলিভিয়েরা গুতেরেসের মতো ব্যক্তিও এখন বদলে গেছেন। জাতিসংঘের মহাসচিবের চেয়েও তিনি এখন পর্তুগাল থেকে আসা একজন পশ্চিমা নাগরিক, এবং রোমান ক্যাথলিক চার্চের অনুসারী হিসেবে আচরণ করছেন।
দ্যাগ হ্যামারশোল্ডের পরে গুতেরেসই জাতিসংঘের প্রথম মহাসচিব, যিনি নিরাপত্তা পরিষদের একটি স্থায়ী সদস্যের সাথে সঙ্ঘাতে গেলেন। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সেখানে তিনি ব্যক্তিগতভাবে অংশ নিলেন।
হ্যামারশোল্ডের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের যে বিরোধ ছিল, তা ব্যক্তিগত ছিল না। বরং তা ছিল নীতি ও আদর্শের বিরোধ; কিন্তু গুতেরেসের উদ্দেশ্য যথেষ্ট সন্দেহজনক। এটাকে কি কাকতালীয় বলা যাবে যে, যখনই বিশ্বের কোথাও পশ্চিমা স্বার্থ বিপন্ন হয়ে পড়েছে, সেখানেই তার বিশেষ প্রতিনিধির উপস্থিতি দেখা গেছে? সেটা মিয়ানমারেই হোক, অথবা সোমালিয়া, সুদান, আফগানিস্তান বা ভেনেজুয়েলাতে হোক। আর এই প্রতিনিধিদের সবাই হলো পশ্চিমা দেশগুলোর মনোনীত প্রতিনিধি।
গুতেরেসকে অবশ্য হ্যামারশোল্ডের ট্রাজিক পরিণতি বরণ করতে হবে না; কিন্তু গুতেরেস আসলে তার সংস্থাকে ছোট করেছেন, কারণ এই সংস্থার অধিকাংশ সদস্যই হলো পশ্চিমা জগতের বাইরের।
রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্র যে সঙ্ঘাতে নেমেছে, সেখানে একটি মুসলিম দেশও ওয়াশিংটনকে সমর্থন করেনি। যদিও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধলে সবাইকেই সেখানে মূল্য দিতে হবে; কিন্তু তারা সেটা নিয়েও ভাবতে চায় না।
মূল বিষয় হলো, মুসলিম দেশগুলো ভাবছে, এটা খ্রিস্টান দেশগুলোর আরেকটি ক্রুসেড। যেটাকে তথাকথিত মূল্যবোধ আর 'আইন-ভিত্তিক ব্যবস্থার' মোড়কে ঢেকে রাখা হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা তাদের আগেও হয়েছে। তারা দেখতে পাচ্ছে যে, পশ্চিমা দেশগুলো তাদের আদিম যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ফিরে গেছে। ইউরোপের পুরো ইতিহাস জুড়েই এ ধরণের যুদ্ধের কাহিনী ছড়িয়ে আছে।
সংবাদপত্রের খবরকে যদি বিশ্বাস করতে হয়, তাহলে দেখা যাচ্ছে, সৌদি আরব খোলাখুলি জো বাইডেন প্রশাসনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। রাশিয়ার সাথে মিলে যে ওপেক- প্লাস নামের সংস্থা রয়েছে- যেটা বিশ্ব তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, সেখান থেকে সৌদি আরবকে বেরিয়ে আসতে বলেছিল ওয়াশিংটন। রিয়াদ সেই প্রস্তাবকে পাত্তাই দেয়নি।
সৌদি আরবের প্রতিপক্ষ ইরান আর সিরিয়া প্রকাশ্যেই রাশিয়াকে সমর্থন দিয়েছে। তুরস্ক, রাশিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছিল। সত্যিই তারা বেলারুশের বৈঠক আয়োজনের পেছনে ভূমিকা রেখেছে।
সবচেয়ে বড় চমক দেখিয়েছে ইসরাইল। যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল ইউক্রেনের কাছে আয়রন ডোম মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম হস্তান্তর করতে। সেটা বাস্তবায়িত হলে যুদ্ধ পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে যেতো; কিন্তু ইসরাইল সেখানে বাধা দিয়েছে। তারা বলেছে, রাশিয়ার বিপক্ষে কোন অবস্থানে তারা যেতে চায় না।
ওয়াশিংটন আর তেলআবিব দু;পক্ষই খবরটি চেপে গিয়েছিল; কিন্তু মিডিয়ায় সম্প্রতি সেটা ফাঁস হয়ে গেছে। এরপর নিরাপত্তা পরিষদে ইউক্রেন নিয়ে প্রস্তাবনার ক্ষেত্রে ইসরাইলকে কো-স্পন্সর হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল বাইডেন প্রশাসন। সেটাও প্রত্যাখ্যান করেছে ইসরাইল। যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে কোন রাখঢাক ছাড়াই তার অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।
মস্কোতে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইসরাইলের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে খোলামেলাভাবে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, ইউক্রেনে যেটা চলছে, সেটা কি ইসরাইল জানে না? সেখানে ক্ষমতা রয়েছে নব্য-নাৎসি গোষ্ঠির হাতে, এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সহায়তা নিয়ে তারা তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এতে কোন সন্দেহ নেই, ইসরাইল পরিস্থিতি সম্পর্কে খুব ভালোভাবেই অবগত। ইসরাইলের কাছে ইউক্রেন আর দশটা দেশের মতো নয়। ১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে আগ্রাসী নাৎসী সেনাবাহিনী, এসএস আর জার্মান পুলিশের ইউনিটগুলো এই ইউক্রেনেই অবস্থান নিয়েছিল। এদের নেতৃত্বেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম বৃহৎ গণহত্যা সঙ্ঘটিত হয়েছে। যেখানে গণহত্যা ঘটেছিল, সেই বধ্যভূমির নাম বাবিন ইয়ার। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের ঠিক বাইরেই এই জায়গাটির অবস্থান।
হলোকাস্ট বিশ্বকোষের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিয়েভের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার আগ পর্যন্ত জার্মানরা এই বধ্যভূমিতে গণহত্যা অব্যাহত রেখেছিল। এই সময়টাতে ইহুদি থেকে নিয়ে, রোমা, ইউক্রেনীয় বেসামরিক নাগরিক এবং সোভিয়েত যুদ্ধবন্দীদের এখানে গুলি করে মেরেছে জার্মানরা।
যুদ্ধের পরে কয়েক দশক ধরে বাবিন ইয়ার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে জার্মান গণহত্যার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো।
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত কি বলেছেন, সেটা আমাদের জানার সুযোগ নেই; কিন্তু মস্কোর জন্য একটা বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। সেটা হলো ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ফোন করে ইউক্রেন ইস্যুতে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছেন।
পুতিন স্বাভাবিকভাবেই বেনেটকে জানিয়েছেন যে, ডোনবাসকে রক্ষার জন্য তিনি বিশেষ সামরিক অভিযান চালাচ্ছেন। তিনি এটাও ব্যাখ্যা করেছেন যে, কিয়েভের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনার জন্য প্রস্তুত মস্কো। যদিও কিয়েভের এ যাবতকালের আচরণে ধারাবাহিকতা দেখা যায়নি, এবং তারা এখন পর্যন্ত এ সুযোগ গ্রহণ করেনি।
ইসরাইল বেশ স্পর্শকাতর অবস্থানে রয়েছে। ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। বেনেট এমন সতর্কতার সাথে চলার চেষ্টা করছেন, যাতে বাইডেন প্রশাসনের সাথে মতপার্থক্যগুলো বড় ধরণের বিবাদে রূপ না নেয়। অন্যদিকে, রাশিয়ার সাথেও ইসরাইলের একটা বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। এর একটি কারণ হলো নাৎসি বাহিনীর হাতে দুই পক্ষকেই অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ২০ মিলিয়নের বেশি সোভিয়েত নাগরিক জীবন দিয়েছে।
ইসরাইল এটাও জানে , রাশিয়া তাদের ফ্যাসিবাদ বিরোধী তৎপরতায় ভীষণভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিশেষ করে যেখানে পশ্চিমা বিশ্ব এই ইতিহাস এড়িয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চাচ্ছে। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি ইউরোপিয় সমাজে যে নব্য নাৎসীবাদী আদর্শের উত্থান দেখা দিয়েছে, সেটাকেও যেন মেনে নেয়ার চেষ্টা করছে ইউরোপীয়রা।
ইউক্রেনের নব্য-নাৎসীদের সাথে জার্মানির যে যোগাযোগ রয়েছে, খুব স্বাভাবিকভাবেই সেটা ইসরাইলের গোয়েন্দাদের জানা; কিন্তু ইসরাইলের সেখানে একা কিছু করার নেই। ইসরাইল আর রাশিয়ার জন্য এটা সমানভাবে বেদনাদায়ক যে, পশ্চিমা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নাৎসী আদর্শকে আর নেতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছে না।
তিনটি আব্রাহামিক ধর্মের মধ্যে দুইটিই খ্রিস্টান বিশ্বের যুদ্ধের চোরাবালিতে আটকা পড়েছে? ইউক্রেন সঙ্কটের কারণে কে কার বন্ধু হয়ে উঠছে, বলা মুশকিল।
মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের খুবই শক্তিশালী মিত্র সংযুক্ত আরব আমীরাত। সম্প্রতি জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যে নিন্দা প্রস্তাব এনেছে, তাতে দুই দফা ভোট দেয়া থেকে বিরত থেকেছে আমীরাত। মুসলিম বিশ্ব ইউরোপের এই বিবাদ থেকে নিজেদের যথেষ্ট দূরে সরিয়ে রেখেছে। কারণ তাদের ইতোমধ্যে অভিজ্ঞতা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের খেলার পুতুল হওয়ার খেসারত তাদের কতটা নির্মমভাবে দিতে হয়।