শিরিন আবু আকলেহ। ফিলিস্তিনের দর্শকদের কাছে আল জাজিরা মানেই ছিলো এই একটি নাম। তিনি ছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের কণ্ঠস্বর। টেলিভিশনের পর্দায় যখন তাকে তাকে দেখা যেতো, উজ্জীবিত হতেন ফিলিস্তিনীরা। তার একেকটি প্রতিবেদন ছিলো নিপীড়িত মানুষের ভাষা। ইসরাইলি সেনার গুলিতে এই সাংবাদিকের মৃত্যুতে শোকে কাঁদছে অশান্ত ভুমি। তাকে নিয়ে আমাদের আজকের প্রতিবেদন। তৈরি করেছেন শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ
বেশি কিছুদিন থেকেই অশান্ত পশ্চিম তীর। ইসরাইলি সেনারা দাবি করছে, জেনিন শরণার্থী শিবির থেকে তাদের ওপর হামলা করা হয়েছে। এ কারণে শিবিরে বেপরোয়া হয়ে উঠে ইসরাইল।
ইসরাইল বরাবরই বেপরোয়া। এবার দখলদার এই দেশটির বুলেট আঘাত হানলো শিরিন আবু আকলেহ এর মতো এক সাংবাদিকের মাথায়। মৃত্যু হলো তার। এই মৃত্যুতে বিশ্বব্যাপি বইছে নিন্দার ঝড়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তাকে স্মরণ করা হচ্ছে।
শিরিন আবু আকলেহ এর ফেসবুক টাইমলাইন ঘেঁটে দেখা গেছে তিনি শেষ পোস্ট দিয়েছিলেন গত ৬ মে। ওই ভিডিও পোস্টে তিনি লিখেন ‘জেনিনের পথে’। ভিডিওতে দেখা গেছে একটি গাড়ির উইন্ডশিল্ড। বাইরে বৃষ্টি। দ্রুত উঠানামা করছে উইন্ডশিল্ড উইপারস। একজন সাংবাদিকের ব্যস্ততা বোঝার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট।
এর আগের পোস্টটি ছিলো ৫ মে। এতে তিনি ৭০ বছর বয়সি এক মায়ের মৃত্যুর খবর দিয়েছেন। ইসরাইলি কারাগারে বন্দি তার ছেলের অপেক্ষায় থেকেও দেখা পাননি তিনি।
২৯ এপ্রিল এক পোস্টে তিনি লিখেন, ‘আপনি কি পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনী? প্রার্থনা করুন জেরুজালেম দেখার জন্য। যেন ঈশ্বর আপনাকে বাঁচিয়ে রাখেন। ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ কেবল ষাট বছরের বেশি পুরুষদের সামরিক বাধা পেরিয়ে যেতে দেয়। আপনি যদি গাজা উপত্যকার লোক হন, তবুও আশা রাখুন একদিন অবরোধ তুলে নেওয়া হবে। ফিলিস্তিনে একটি প্রজন্ম আছে, যারা কখনো জেরুজালেমে ঢুকতে পারেনি। জীবনে একবারও দেখার ভাগ্য হয়নি।’
শিরিন আবু আকলেহ এমনভাবেই নিজেকে জড়িয়েছিলেন ফিলিস্তিনের সাথে। ১৯৭১ সালে জেরুজালেমেই তার জন্ম হয়। তিনি আরব ফিলিস্তিনী খৃস্টান পরিবারের মেয়ে। নানাবাড়ির লোকেরা থাকেন আমেরিকার নিউজার্সিতে। সেই সুবাদে তিনিও মার্কিন নাগরিক। কিন্তু পেশাগত জীবন কাটিয়েছেন ফিলিস্তিনে। জর্ডানে প্রিন্ট জার্নালিজমের ওপর গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি করার পর ফিরে আসেন জন্মভ’মিতে। এরপর সাংবাদিকতায় নামেন। ১৯৯৭ সালে আলজাজিরার হয়ে কাজ শুরু করেন। এরপর পরিচিতি পান আরবিভাষার টিভি দর্শকদের কাছে।
ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের সাহসি সংঘাতের বর্ণনার জন্য আরব বিশ্বের লোকেরা তাকে পরিবারের একজন বলেই মনে করতেন।
সেই শিরিন আবু আকলেহ এখন নেই।
জেনিন শরণার্থী শিবিরে ইসরাইলি সামরিক অভিযান কাভার করার সময় মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিলো ৫১ বছর। তিনি তার ভাই টনি আবু আকলেহকে রেখে গেছেন।
জেনিনে ওই সময় আল জাজিরার আরেক সাংবাদিক আল-সামুদিও পিঠে গুলিবিদ্ধ হন। তবে হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি স্থিতিশীল অবস্থায় আছেন।
স্থানীয়দের বরাত দিয়ে আল জাজিরা জানিয়েছে, ইসরাইলি বাহিনী সাংবাদিকদের একটি দলকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে। এতেই শিরিনের মৃত্যু হয়। তবে ইসরাইলি সেনাবাহিনী দাবি করছে, তাকে কে গুলি করেছে সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। এর আগে দেশটির সামরিক প্রধান দাবি করেছিলেন ফিলিস্তিনী যোদ্ধাদের গুলি লক্ষ্যভ্রস্ট হয়ে শিরিনের মাথায় বিদ্ধ হয়। পরে অবশ্য তিনি এ দাবি থেকে সরে এসেছেন।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল আভিভ কোচাভি বলেন, ‘দখলকৃত পশ্চিম তীরের জেনিনে বুধবার আবু আকলেহকে কে গুলি করেছে সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে এতে আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি।
এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয় ইউনিয়ন। শিরিন একজন মার্কিন নাগরিক দাবি করে যুক্তরাষ্ট্র এ ঘটনার তদন্ত চেয়েছে।
ঘটনার সময় সাংবাদিকদের দলে উপস্থিত ছিলেন হানায়শা। তিনি বলেন, ‘জেনিনে পায়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তাজা গুলির শিকার হয়ে আমরা অবাক হয়েছিলাম। ইসরাইলি বাহিনী থেকে যারা গুলি চালিয়েছে, তারা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে আমরা সাংবাদিক।
সংবাদ কাভার করার সময় শিরিনের গায়ে স্পষ্ট প্রেসচিহিœত নীল ফø্যাক জ্যাকেট ছিলো উল্লেখ করে হানায়শা বলেন, ‘হত্যা করার উদ্দেশ্যেই শিরিনকে গুলি করা হয়। শরীরের যে অংশ সুরক্ষিত ছিলো না, সেখানেই গুলিটি চালানো হয়।’
তিনি বলেন, ‘সত্যিই যদি তারা আমাদের হত্যা করতে না চাইতো, তবে ওই এলাকায় আমাদের আসার আগেই গুলি করা হতো। আমি এটাকে সুস্পষ্ট সাংবাদিক হত্যাকান্ড হিসেবে দেখছি।
হত্যাকা-ের প্রত্যক্ষদর্শী আরেক সাংবাদিক মুজাহেদ আল-সাদি বলেন, ‘ইসরাইলি সেনাবাহিনীকে স্পষ্ট করে জানানো হয়েছে যে তারা সংবাদমাধ্যমের সদস্যদের ওপর গুলি চালাচ্ছে। তারপরও সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো অব্যাহত ছিল।
ফিলিস্তিনি এমপি খালিদা জারার বলেছেন, ‘আবু আকলেহ ছিলেন ফিলিস্তিনিদের কণ্ঠস্বর। ইসরাইলি উপনিবেশবাদ ও দখলদাররা তাকে হত্যা করেছে। খালিদা জারার এর আগে ইসরাইলি কারাগারে বন্দি ছিলেন। আদালতে তার শুনানির সময় সাংবাদিক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিরিন। খালিদা বলেন, ‘আমি কারাগারের কামরায় থাকার সময় শিরিন ছিলেন আমার কণ্ঠস্বর।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের পরিচালক ওমর শাকির জানিয়েছেন, তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখছেন। এবং এই ধরনের হত্যাকা-ের ইসরায়েলি তদন্তকে ‘হোয়াইটওয়াশ মেকানিজম’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
তিনি বলেন, ‘ইসরাইলিরা যখন এমন কাজ করে তখন কোনো জবাবদিহিতা দেখা যায় না। এটাই বাস্তবতা।
শিরিনের হত্যাকান্ড নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের ভুমিকা নিয়ে তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। ইউক্রেনে একজন পশ্চিমা সাংবাদিক নিহত হওয়ার পর যে হৈচৈ হয়েছে শিরিনের হত্যা নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা নেই। এমনকি নিউয়র্ক টাইমসের মতো সংবাদপত্র এমন ভাবে সংবাদ পরিবেশন করেছে যাতে তার হত্যাকান্ড নিয়ে ধোয়াশা তৈরি হয়। পশ্চিমা গনমাধ্যমে সেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়নি শিরিনের হত্যাকান্ড।
শিরিনকে হত্যার পর সাধারণ ফিলিস্তিনী এবং সাংবাদিকেরা ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। তার বন্ধু ও সহকর্মীরা ভুলতে পারছেন না সাহসি এবং হাসিমুখের এই সাংবাদিককে। সহকর্মী নিদা ইব্রাহিম বলেন, ‘শিরিন দয়ালু এবং কাজে নিবেদিত ছিলেন। একটি স্টোরি কিভাবে সাজাতে হয় সে কৌশল তিনি জানতেন। তার প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসতো অনেক তথ্য।
সাংবাদিকতায় শিরিন ছিলেন অভিজ্ঞ। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা ফিলিস্তিনের গল্পগুলো তিনি নতুনভাবে উপস্থাপন করতেন। মৃত্যুর আগে শিরিন হিব্রু শিখছিলেন। ইসরাইলি মিডিয়ার প্রতিবেদনগুলো ভালোভাবে বুঝার আগ্রহ ছিলো শিরিনের। ১৯৯৬ সালে আল জাজিরা চালু হয়। এর এক বছর পর সংবাদমাধ্যমটিতে কাজ শুরু করেন শিরিন। তখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক পরিচিতি পান। ২০০০ সালে দ্বিতীয় ফিলিস্তিনী ইন্তিফাদায় তার কভারেজ ছিলো অনন্য।
এক সাক্ষাতকারে শিরিন বলেছিলেন, ‘মানুষের কাছাকাছি থাকার জন্য আমি সাংবাদিকতা বেছে নিয়েছি। বাস্তব সত্যটা পরিবর্তন করা আমার পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। তবে আমি তাদের কণ্ঠ বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিতে পারি।
একজন টেলিভিশন সাংবাদিক হিসেবে আবু আকলেহ ২০০৮, ২০০৯, ২০১২, ২০১৪ এবং ২০২১ সালের গাজার যুদ্ধ কাভার করেন। তিনি উত্তর ইসরাইলের কারাগার থেকে পালিয়ে আসা ছয় ফিলিস্তিনীর সাহসী জেলব্রেক কাভার করেছেন। ২০০৬ সালে লেবাননের যুদ্ধসহ ওই অঞ্চলের খবরও কভার করেছিলেন।
আল জাজিরার আরেক সাংবাদিক ডালিয়া হাতুকা। তিনি বলেন, ‘শিরিন একজন ট্রেইলব্লেজার। আমাদের অনুপ্রেরণা। আমাদের এখানে আল জাজিরা মানেই শিরিনকে ধরে নেওয়া হতো। হাতুকা শিরিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি আবেগ ধরে রাখতে না পেরে শিরিনের প্রতিবেদনের সমাপনি অংশটি অনুকরণ করে চিৎকার করেন ‘শিরিন আবু আকলেহ, আল জাজিরা, রামাল্লা।
ফিলিস্তিনের নিষ্ঠুরতা দেখে দেখেই বড় হয়েছেন শিরিন। তারপরও জীবনকে থামিয়ে রাখেননি। কোনো হৃদয়বিদারক গল্প বলার সময় তার কণ্ঠ খাপ খেয়ে যেতো।’ শিরিন আবু আকলেহ আল জাজিরাকে ইমেইলে শেষ বার্তাটি পাঠিয়েছিলেন ভোর ছয়টা ১৩ মিনিটে। এতে জানিয়েছিলেন জাবরিয়াত পাড়ায় একটি বাড়ি ঘেরাও করা হয়েছে। সেখানে যাওয়ার পথ খুলে গেলেই পরের খবর নিয়ে তিনি ফিরবেন। দর্শকরা অপেক্ষায় থাকলেন পরের খবরের।
তরপর! নিজেই খবর হয়ে হাজির হলেন দর্শকদের সামনে।