মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফর যত ভালোভাবেই সাজানো হোক না কেন, একটা ভুল সেখানে ঠিকই করেছে হোয়াইট হাউজ। সেটা হলো প্রেসিডেন্ট বাইডেন সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান বা এমবিএসের সাথে মুখোমুখি বৈঠকে বসেছেন। সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের সাথে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এটা ছিল প্রথম বৈঠক।
ওয়াশিংটন ছাড়ার আগে মার্কিন প্রশাসন জানিয়েছিল, কোভিডের সংক্রমন বেড়ে যাওয়ায় এই সফরে প্রেসিডেন্ট বাইডেন অন্যদের সাথে শারীরিক স্পর্শ এড়িয়ে চলবেন এবং হ্যান্ডশেক করা থেকে বিরত থাকবেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পদক্ষেপের কারণে সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের সাথে করমর্দনরত অবস্থায় ক্যামেরায় ধরা পড়ার হাত থেকে বেঁচে গেছেন বাইডেন।
কিন্তু কিছু ছবি ঠিকই মনোযোগ কেড়েছে। দুই নেতা পরস্পরের দিকে ঝুঁকে বসেছেন। যখন তারা একে অন্যের মুষ্টিবদ্ধ হাত স্পর্শ করেছেন, তখন উভয়ের মুখে হাসিও দেখা গেছে। এ সময় প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে যতটা স্বচ্ছন্দ্য দেখা গেছে, সেটা তার কাছ থেকে কেউ আশা করেনি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বের যে সব একনায়ক ও কর্তৃত্বপরায়ন শাসকদের সাথে দহরম মহরম গড়ে তুলেছিলেন, তাদের ব্যাপারে কঠোর হওয়ার ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন জো বাইডেন। ক্রাউন প্রিন্স এমবিএসের ব্যাপারে তার বিশেষ শত্রুতা ছিল। ৩৬ বছর বয়সী উচ্চাকাঙ্ক্ষী এই নেতা ক্ষমতার পরবর্তী উত্তরসুরী হওয়ার জন্য তার চাচাকে পর্যন্ত সরিয়ে দিয়েছেন। তিনি ইয়েমেনে যুদ্ধ শুরু করেছেন, এবং তার সমালোচকদের আটক এবং এমনকি হত্যাও করেছেন।
সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যার পর বাইডেন যখন তার নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছিলেন, তখন তিনি সৌদি আরবকে মার্কিন বলয় থেকে সরিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তখন থেকেই তিনি বলে আসছেন যে, ক্রাউন প্রিন্সের সাথে কখনও তিনি কথা বলবেন না। বরং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ব্যাপারে তিনি বাদশাহ সালমানের সাথে কথা বলবেন। হোয়াইট হাউজে আসার কিছু পরেই বাইডেন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন প্রকাশ করে দেন, যেটা ট্রাম্প আটকে রেখেছিলেন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইস্তান্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাশোগির বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর অনুমোদন দিয়েছিলেন এমবিএস।
সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের সাথে বৈঠকে প্রেসিডেন্ট বাইডেন যখন খাশোগির বিষয়টি উত্থাপন করেন, তখন তাকে পাল্টা কড়া জবাব দিয়েছেন এমবিএস। ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে ভন্ডামির অভিযোগ তুলে মোহাম্মদ বিন সালমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনি-আমেরিকান সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহের হত্যাকান্ড তদন্তে কোন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। অন্যদিকে, ইরাকের আবু গারিব কারাগারে বন্দিদের উপর নির্যাতনের বিষয়েও তাদের কোন মাথাব্যথা নেই।
এতকিছুর পরও রিয়াদ বহু দশক ধরে ওয়াশিংটনের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার হিসেবে চলে আসছে। এর পেছনে এমন কারণ রয়েছে, যেটা অগ্রাহ্য করা কোন মার্কিন প্রেসিডেন্টের পক্ষেই সম্ভব নয়। সৌদি আরবের তেলের যে বিশাল রিজার্ভ রয়েছে, তার টান উপেক্ষা করতে পারেননি বাইডেন। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক তেলের বাজারে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, সেই পরিস্থিতিতে সৌদি আরবকে অগ্রাহ্য করা বাইডেনের পক্ষে সম্ভব নয়।
সৌদি আরব সফরের আগে বাইডেন ইসরাইল ও অধিকৃত ফিলিস্তিনে যান এবং সেখানে তিন দিন অবস্থান করেন। ইরানের সাথে ইসরালের যে নিরাপত্তা টানাপড়েন, সে ব্যাপারে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি ইসরাইলি নেতাদের তুষ্ট করেছেন। অন্যদিকে, ফিলি¯িস্তনিদেরকে হতাশ করে তিনি বলেছেন, শান্তি চুক্তি নবায়নের মতো পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি। সেখানে তার অর্জনও অতি সামান্য। রিয়াদ সৌদির আকাশ দিয়ে ইসরাইলের চলাচলের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। অন্যদিকে, পশ্চিম তীর আর গাজায় ফোর-জি সুবিধা চালুর প্রতিশ্রুতি মিলেছে।
সৌদি রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলি শিহাবি মনে করেন, পবিত্র ভূমি জেরুালেমর সঙ্কট কখনই বাইডেনের মনোযোগের কেন্দ্রে ছিল না। তিনি মধ্যপ্রাচ্যে এসেছেন মূলত ক্রাউন প্রিন্সের সাথে বৈঠক করতে। মনোযোগ অন্যদিকে রাখার জন্যই তিনি এদিক-ওদিক গেছেন।আলি শিহাবি মনে করেন এই সফরে এমবিএসের সাথে বৈঠকটাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এটা শুধু তেলের ব্যাপারও নয়। দেরিতে হলেও বাইডেন বুঝতে পেরেছেন যে, সৌদি আরব আর আগের মতো এককভাবে আমরিকার উপর নির্ভরশীল নয়। চীন ও রাশিয়ার সাথেও তাদের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। এই দেশগুলো অস্ত্র বিক্রি করে। আর ইরানের উপর তাদের প্রভাব আছে, যেটা আমেরিকার নেই। আলি শিহাবি বলেন, বৈঠক থেকে এই বাস্তবত আবারও বোঝা গেছে, কেউ যদি মধ্যপ্রাচ্যে কিছু করতে চায়, তাহলে সৌদি আরবকে অগ্রাহ্য করে সেটা করা যাবে না।
মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা বাইডেনের জন্য অতটা সহজ হবে না। সৌদি আরবে সম্মানকে অন্য সব কিছুর উপরে প্রাধান্য দেয়া হয়। নির্বাচনী প্রচারণার সময় প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, মানবাধিকার হবে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির প্রধান নীতি। কিন্তু ডেমোক্র্যাট ভোটারদেরকে হতাশ করে বাইডেনকেও এখন এমবিএসের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে হচ্ছে।
ব্রেন্ট অপরিশোধিত তেলের দাম বেড়ে মার্চ মাসে ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে গেছে। ব্যারেল প্রতি ব্রেন্ট তেলের দাম এখন ১৩৯ দশমিক ১৩ ডলার। এতে সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি বাড়ার সাথে সাথে জীবনযাত্রার ব্যায় বেড়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ১ শতাংশ, এবং সেটা আরও বাড়ছে। এই কারণে নভেম্বরের মিড-টার্ম নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা আসন হারাতে পারে।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেলের রিজার্ভ রয়েছে সৌদি আরবে। তেলের দামের উপর সৌদি আরবের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। কিন্তু বৈশ্বিক তেলের উৎপাদন বাড়ানোর ব্যাপারে কোন ধরণের ঘোষণা ছাড়াই বাইডেনকে দেশে ফিরতে হয়েছে। সৌদি আরব শুধু এতটুকু প্রতিশ্রুতি দিয়েছে , বাজারে তেলের ঘাটতি থাকলে তারা আরও তেল উত্তোলন করবে। তবে আগামী মাসে অনুষ্ঠিতব্য ওপেক সম্মেলন থেকে এ ব্যাপারে আরও ঘোষণা আসতে পারে।
তেলের বাইরে জেদ্দাতে গালফ কোঅপারেশান কাউন্সিলের এক বৈঠকে বাইডেন মধ্যপ্রাচ্যের নেতাদের আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, ওয়াশিংটন এই অঞ্চল ছেড়ে যাবে না, এবং এমন কোন শূণ্যতা সৃষ্টি করবে না, যেটা পূরণের জন্য চীন, রাশিয়া, বা ইরান এগিয়ে আসতে পারে।ইউক্রেন পরিস্থিতির কারণে উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এই দেশগুলো তেহরানের মোকাবেলায় ওয়াশিংটনকে আর নির্ভরযোগ্য মনে করে না। বাইডেন প্রশাসন যেভাবে মস্কোকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করেছে, উপসাগরীয় অঞ্চলের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো তাতে সমর্থন দেয়নি।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন মধ্যপ্রাচ্য ছাড়ার আগে যে বার্তা দিয়েছেন, সে ব্যাপারেও খুব একটা গা করছে না মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। তিনি বলেছেন, যে সব দেশ তাদের জনগণের পূর্ণ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারবে, যেখানে নাগরিকরা তাদের নেতাদেরকে সমালোচনা করতে পারবে এবং তাদেরকে প্রশ্ন করতে পারবে, তারাই ভবিষ্যতে বিজয়ী হবে। শিহাবি মনে করেন, বাইডেনের এই সফর ছিল অনেকটাই প্রতীকি। শেষ বিচারে এটা এমবিএসের জন্য একটা বড় জয়। আর এখানে মূল্যটা দিতে হবে বাইডেনকে।
বাইডেনের এই সফরের কি দরকার ছিল? এই মুহূর্তে সেটা বলা মুশকিল। কিন্তু হোয়াইট হাউজ দীর্ঘমেয়াদি অর্জনের দিকে নজর দিচ্ছে। জেদ্দাতে বাইডেন বলেছেন, এই অঞ্চলে এই মুহূর্তে কোন স্থলযুদ্ধে অংশ নিচ্ছে না আমেরিকান সেনারা। এজন্য তিনি গর্বিত।
আর কোন মার্কিন নেতাই আরেকটি আফগানিস্তান বা ইরাক চাইবে না। সৌদি আরব যাতে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে, সে জন্যেও জোরদার লবিং চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের বিরুদ্ধে যে আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা জোটের আবীর্ভাব হচ্ছে, তাতেও সৌদি আরবকে যুক্ত করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
আমেরিকা যতই নিজেদেরকে সক্রিয়, নীতিবান নেতৃত্ব হিসেবে দাবি করুক, আসলে মধ্যপ্রাচ্যের দাবার ঘুঁটি নড়তে শুরু করেছে। আর যুক্তরাষ্ট্র এখান থেকে সরে যেতেও তৈরি হয়ে গেছে। বাইডেন হয়তো মাত্র এক মেয়াদের জন্য প্রেসিডেন্ট হয়ে এসেছেন, কিন্তু বাস্তবতা হলো মোহাম্মদ বিন সালমান আরও বহু দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যতের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখবেন।