তুর্কি নেতা রিজেপ তাই্যয়েপ এরদোয়ানকে কোনোভাবেই বশে আনতে পারছে না পাশ্চাত্য। তুরস্কের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি পশ্চিমা দুনিয়াকে মাঝে মাঝেই বেকায়দায় ফেলে দেয়। ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে এক মাসে এরদোয়ানের দুইবার বৈঠক নিয়ে পাশ্চাত্যের নেতারা নাখোশ। বিশেষ করে রাশিয়ার সোচিতে দুই নেতার চার ঘণ্টার বৈঠক পাশ্চাত্যকে উৎকণ্ঠায় ফেলেছে। ্িবটেনের প্রভাবশালী দৈনিক ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের খবরের ভিত্তিতে এ সম্পর্কে বিস্তারিত থাকছে ইলিয়াস হোসেনের প্রতিবেদনে।
পশ্চিমা দেশগুলো এরদোয়ান এবং পুতিনের মধ্যে গভীর অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়ে ক্রমবর্ধমানভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞা এড়াতে সাহায্য করলে তুরস্ক শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে পারে বলে সতর্ক করেছে পশ্চিমা দেশগুলো। পশ্চিমা ছয় কর্মকর্তা ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, সোচিতে দুই নেতার বৈঠকের পর তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য ও জ্বালানি বিষয়ে সহযোগিতা সম্প্রসারণের জন্য দুই দেশের প্রতিশ্রুতি নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ২৭ সদস্যের এ জোট তুরস্ক ও রাশিয়ার সহযোগিতাকে আরও বেশি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, তুরস্ক ক্রমবর্ধমানভাবে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের একটি প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠছে। আরেকজন কর্মকর্তা রাশিয়ার প্রতি তুরস্কের আচরণকে খুবই সুবিধাবাদী বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, তারা তাদের উদ্বেগের ব্যাপারে তুর্কিদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছেন।
ওয়াশিংটন বারবার সতর্ক করেছে, কোনো দেশ রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞা এড়াতে সহায়তা করলে যুক্তরাষ্ট্র সেকেন্ডারি নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ওই দেশকে আঘাত করবে । মার্কিন ডেপুটি ট্রেজারি সেক্রেটারি ওয়ালি আদেয়েমো জুন মাসে তুর্কি কর্মকর্তা ও ইস্তাম্বুলের ব্যাংকারদের সঙ্গ বৈঠক করেন। এ সময় তিনি তাদের সতর্ক করেন, তারা যাতে অবৈধ রাশিয়ান অর্থের বাহক না হয়। একজন পশ্চিমা কর্মকর্তা হুমকি দেন, এরদোয়ান সোচিতে পুতিনকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালন করলে পশ্চিমা দেশগুলো তাদের কোম্পানি এবং ব্যাঙ্ককে তুরস্ক থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাতে পারে। একটি ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এটি অত্যন্ত অস্বাভাবিক হুমকি। পশ্চিমা বিশ্বের ৮০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি তুরস্ককে পঙ্গু করে দিতে চায়।
তুরস্ককে হুমকি দেয়া পশ্চিমা কর্মকর্তা বলেন, যে দেশগুলো রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তারা আঙ্কারার বিরুদ্ধেও একই কাজ করতে পারে। পশ্চিমা বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোকে হয় তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করতে হবে অথবা তুরস্ককে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক সঙ্কুচিত করতে হবে। তবে এ ধরনের পরামর্শ অন্য পশ্চিমা কর্মকর্তারাই প্রত্যাখ্যান করেছেন।
তুরস্ক পশ্চিমা আর্থিক ব্যবস্থায় গভীরভাবে যুক্ত। কোকা-কোলা, ফোর্ড থেকে বিপি পর্যন্ত ব্র্যান্ডগুলো তুরস্কে দীর্ঘদিন ধরে অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা করছে। দেশটিতে এসব কোম্পানির খুব গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। ফলে চাইলেই তুরস্কের বিরুদ্ধে বেশি কঠোর হতে পারছে না পশ্চিমা দুনিয়া। ওই কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, তুরস্কের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতে গেলে ইইউর কয়েকটি দেশই তাকে চ্যালেঞ্জ করবে। সোচির বৈঠক শেষে এরদোয়ান জানিয়েছেন, এই অঞ্চলে তুরস্ক ও রাশিয়া কী ধরনের ভূমিকা পালন করবে সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এই আলোচনা বেশ ফলপ্রসূ হয়েছে বলেও জানান তুর্কি নেতা।
এ বৈঠকে এরদোয়ানের প্রশংসা করেন পুতিন। ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যে শস্যচুক্তি করতে প্রত্যক্ষভাবে অবদান রাখায় এরদোয়ানকে ধন্যবাদ জানান রুশ প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেন, আপনার সরাসরি অংশগ্রহণে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায়, কৃষ্ণ সাগর দিয়ে ইউক্রেনের শস্য রপ্তানির সমস্যার সমাধান হয়েছে। শস্য রপ্তানি ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এজন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই।
পুতিন আরও বলেন, অনেক দেশ খাদ্য ও সার নিয়ে সমস্যার দ্বারপ্রান্তে আছে। তাদের জন্য চুক্তিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি আপনার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সম্ভব হয়েছে। এছাড়াও প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ প্রকল্প ‘তুর্কস্ট্রিম’-এর জন্য এরদোয়ানের প্রশংসা করেছেন পুতিন। তিনি বলেছেন, ‘রাশিয়ার গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ অব্যাহত রাখার জন্য ইউরোপের উচিত তুরস্কের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা।’ বৈঠক শেষে ক্রেমলিন এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, অনেক বৈশ্বিক বাধা থাকা সত্ত্বেও তুরস্ক ও রাশিয়া সম্পর্ক আরও জোরদার করতে একমত হয়েছে।
ডুভার নিউজ পোর্টালের বিশ্লেষক ইলহান উজগেল মনে করেন, জাতিসংঘ চুক্তির মধ্যস্থতায় এরদোয়ানের সাফল্য এবং সোচি বৈঠক তুর্কি নেতা সম্পর্কে তুরস্কের পশ্চিমা মিত্রদের কাছে একটি শক্তিশালী বার্তা দিয়েছে। দুটি ঘটনা আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিকভাবে এরদোয়ানের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে সাহায্য করেছে। তিনি এখন দেখানোর চেষ্টা করছেন, তিনি পুতিনের সাথে চুক্তি করতে পারেন। এরদোয়ান যুক্তরাষ্ট্র এবং বাইডেন প্রশাসনকে দেখিয়েছেন, পুতিন তার ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং বন্ধু। তিনি মাসে দুবার পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন। কিছুদিন আগে ইরানেও তারা বৈঠকে মিলিত হন।
বন ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক এবং তুরস্ক-রাশিয়া সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ জউর গাসিমভ মনে করেন, আঙ্কারা ইউক্রেনের সংঘাতে ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে। শস্য চুক্তি রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে সম্পর্ককে আরও গভীর করবে। ইউক্রেনের গম রপ্তানি এই অঞ্চলের জন্য একটি নতুন অধ্যায়। তুরস্ক এর মধ্যস্থতাকারী হিসাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে তাদের ঘনিষ্ঠতাকে সুনজরে দেখছে না পশ্চিমা নীতিনির্ধারকরা।
ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়াার আগ্রাসনের পর থেকে কিয়েভ এবং মস্কোর ব্যাপারে ভারসাম্যপূর্ণ নীতি অনুসরণ করছেন এরদোয়ান। ন্যাটোর অন্যান্য সদস্যদের মতো তুরস্কও বলেছে, তারা ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরোধিতা করে। রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে মোকাবেলায় সহায়তা করার জন্য কিয়েভের সরকারকে অত্যন্ত কার্যকর ড্রোন দিয়েছে। তবে রাশিয়ার ওপর মার্কিন ও ইউরোপীয় নিষেধাজ্ঞায় যোগ দেওয়া থেকে বিরত রয়েছে তুরস্ক।
সোচিতে বৈঠকের পর মস্কোর শীর্ষ জ্বালানি কর্মকর্তা উপ- প্রধানমন্ত্রী আলেকজান্ডার নোভাক সাংবাদিকদের বলেছেন তুরস্ক রাশিয়ার গ্যাসের জন্য রুবলে অর্থ প্রদান শুরু করতে সম্মত হয়েছে। তুরস্কে বছরে ২৬ বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস সরবরাহ করে রাশিয়া। এর দামের কতটা রুবলে পরিশোধ করা হবে তা স্পষ্ট নয়।
তুরস্ক রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি অব্যাহত রেখেছে। এর পরিমান দেশটির অপরিশোধিত তেল আমদানির এক চতুর্থাংশ। গত বছর তুরস্ক তার প্রাকৃতিক-গ্যাস আমদানির বড় অংশ এনেছে রাশিয়া থেকে। রাশিয়া ভূমধ্যসাগর উপকূলে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ শেষ করার জন্য তুরস্ককে বিলিয়ন ডলার দিয়ে দেশটিকে অনেক প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে সহায়তা করেছে।
সোচি বৈঠকে পুতিন এবং এরদোয়ান রুবেল এবং লিরাতে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। রাশিয়া থেকে ফিরে এরদোয়ান সাংবাদিকদের বলেছেন, রাশিয়ার এমআইআর পেমেন্ট কার্ড সিস্টেম ব্যবহার নিয়ে আলোচনায় খুব উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এর মাধ্যমে রাশিয়ানরা এমআইআর কার্ডের মাধ্যমে তুরস্কে অর্থ খরচ করতে পারবেন। রাশিয়ায় ভিসা এবং মাস্টারকার্ডের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে।
এরদোয়ান জানান, রাশিয়ার এমআইআর কার্ড দিয়ে রুশ পর্যটকরা কেনাকাটা এবং হোটেলের জন্য অর্থ প্রদান করতে পারবেন। রাশিয়ার লাখ লাখ পর্যটক প্রতিবছর তুরস্ক ভ্রমণ করে থাকেন। পশ্চিমা কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, আঙ্কারা ও মস্কো নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে এ কাজ করবে। তুরস্ক ও পশ্চিমের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক আগে থেকেই উত্তপ্ত। মস্কো থেকে এস- ৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কেনায় ওয়াশিংটন ২০২০ সালে আঙ্কারার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। তবে এতে তুরস্ককে দমানো যায়নি।
এরদোয়ান ন্যাটোতে সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের প্রবেশে ভেটো দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। পশ্চিমের অনেক রাজধানীতে তাকে তাই অবিশ্বস্ত মিত্র হিসাবে দেখা হয়। তবে তুরস্ক সন্ত্রাসবাদ ও শরণার্থী রোধে ইউরোপের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে একটি চুক্তির অংশ হিসাবে দেশটি প্রায় ৩৭ লাখ সিরীয়কে আশ্রয় দিয়েছে। এটা ইউরোপে অভিবাসীদের স্রোত রোধ করতে সহায়তা করেছে।
রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে দ্বন্দ্ব তুরস্কের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানকে আবার সামনে নিয়ে এসেছে। কৃষ্ণ সাগরকে ভূমধ্যসাগরের সাথে সংযুক্ত করা প্রণালীগুলোতে প্রবেশের নিয়ন্ত্রণ আঙ্কারার হাতে। এই সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে এরদোয়ান রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে শস্য রপ্তানি চুক্তি করার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এটা বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট এড়াতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এখন ইউক্রেনে যুদ্ধের অবসানে সহায়তা করার জন্যও মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে চায় তুরস্ক।