মধ্যপ্রাচ্যে বন্ধুত্বের সুবাতাস : শক্তিশালী হচ্ছে মুসলিম বিশ্ব

মানচিত্রে মধ্যপ্রাচ্য - সংগৃহীত

  •  মুনতাসীর মুনীর
  • ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৭:৪০


কয়েক দশকের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যর প্রভাবশালী দেশগুলো সক্ষম হয়েছে পরস্পরের কাছাকাছি আসতে। গত দুই দশেকে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, সংঘাত ও প্রক্সি যুদ্ধের খেলায় মেতে উঠেছিলো এ দেশগুলো। এখন মধ্যপ্রাচ্যর খেলোয়াড় দেশগুলো চেষ্টা করেছে ব্যবসা, নিরাপত্তা ও কূটনীতিকে সামনে রেখে নতুন সর্ম্পক গড়ে তোলার।
এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো ২০২০ সালের শেষ দিকে। ইরানের সাথে গোপনে আলোচনা শুরু করে দেশটি। এর ধারবাহিকতায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শেখ তাহনুন বিন জায়েদ ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ইরান সফর করেন। এর আগে ২০২১ সালের শুরুর দিকে সৌদি আরব ও কাতারের মধ্যে সর্ম্পক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়া শুরু হয়।


মিশরের সাথে কাতারের সর্ম্পক স্বাভাবিক করার পাশাপাশি তুরস্ক ও মিশরের মধ্যে সর্ম্পক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এরমধ্যে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোয়ান সৌদি আরব সফর করেন। প্রায় একই সময় পর্দার আড়ালে ইরানের সাথে সৌদি আরবের আলোচনা চলতে থাকে। আবার ইসরাইলের সাথে তুরস্কের সর্ম্পক স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে আনার উদ্যেগ নেয়া হয়।


আরব বসন্তকে কেন্দ্র করে প্রায় এক দশকের কূটনৈতিক টানাপড়েনের পর ২০২১ সালের জানুয়ারিতে মিশরের সাথে কাতারের কূটনৈতিক সর্ম্পক পুন:প্রতিষ্টা হয়। মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দুল ফাত্তাহ সিসির সাথে কাতারের আমিরের শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সাথে বাগদাদ, বেইজিং এবং কায়রোতে তিন দফা বৈঠক করেন। মিশরের অর্থনীতি সচল করতে কাতার দেশটিতে ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়। একই সময় তুরস্কের সাথে মিশরের সর্ম্পক পুন:প্রতিষ্টার প্রক্রিয়া শুরু হয়। মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি তুরস্কের সমর্থন ও লিবিয়া এবং পূর্ব ভুমধ্যসাগরে প্রভাব বিস্তার নিয়ে দুদেশের মধ্যে মতবিরোধ ছিলো তীব্র। কয়েক দফা আলোচনার পর দুদেশের মধ্যে মতবিরোধ কমে আসে।


মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে পুরানো শত্রু দেশ হিসাবে পরিচিত সৌদি আরব ও ইরান। দেশ দুটি ইয়েমেন ও ইরাকে সরাসরি প্রক্্িরযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘ এক দশকের বেশি সময় ইয়েমেন যুদ্ধে বড় আকারের সামরিক অভিযান চালিয়ে হুথি বিদ্রোহীদের পরাজিত করতে পারেনি সৌদি আরব। সেখানে তৈরি হয় মানবিক বিপর্যয়। ইরানের সমর্থনপুষ্ট হুথি বিদ্রোহীরা এক পর্যায়ে সৌদি আরবের অভ্যন্তরে মিসাইল ও ড্রোন হামলা চালাতে থাকে। বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুকিতে পড়ে সৌদি আরব। এমনকি সৌদি আরবের তেলক্ষেত্র হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত হয়। এমন পরিস্থিতির মধ্যে ইরাকের মধ্যস্থততায় ইরানের সাথে আলোচনা শুরু করে সৌদি আরব। আলোচনায় নিরাপত্তা, ইয়েমেন পরিস্থিতি ও কূটনৈতিক সর্ম্পক স্থাপনের বিষয় গুরুত্ব পায়। ২০১৬ সালের পর থেকে দুদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সর্ম্পক ছিন্ন রয়েছে।


অনেক কূটনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে খুব দ্রুত স্বাভাবিক সর্ম্পক ফিরে আসবে এমনটা আশা করা যায় না। তবে দুদেশ নতুন করে যে প্রক্সি যুদ্ধে জড়াবে না তা নিশ্চিত করে বলা যায়। এর কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ইরানের সাথে ছয় বিশ্বশক্তির যে পারমানবিক চুক্তি হতে যাচ্ছে, তা নিয়ে সৌদি আরব ও তার মিত্র দেশগুলো এক ধরনের নিরব ভুমিকা পালন করছে। অপরদিকে ইসরাইল এই পরমানু চুক্তির বিরোধিতা করে যাচ্ছে। কিন্তু ইসরাইলের সাথে সূর মেলাচ্ছে না আরব দেশগুলো।


ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্বের জ্বালানী বাজারে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে তাতে আরব দেশগুলো বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। আরব বিশ্বের জ্বালানীর ওপর বাড়ছে ইউরোপের দেশগুলোর নির্ভরতা। রাশিয়ার সাথে সংঘাত যত দীর্ঘ হবে আর্ন্তজাতিক রাজনীতিতে মধ্যপ্রাচ্যর দেশগুলোর গুরুত্ব তত বাড়বে।
অপরদিকে ইউরোপের দেশগুলো ভবিষ্যত জ্বালানী চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখে ইরানের সাথে দ্রুত চুক্তির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কারন ইরানে বিপুল পরিমান উন্নত মানের জ্বালানীর মজুদ আছে। এই মুহুর্তে আরব দেশগুলোর কৌশল হচ্ছে নিজেদের অবস্থান সংহত করা। নিজেদের মধ্যে বিভাজন কমে আনা। এই কৌশলের অংশ হিসাবে নতুন করে ইরানের সাথে দ্বন্দ্ব বাড়াতে চায় না আরব দেশগুলো। কারন এ অঞ্চলের সশস্ত্র সংগঠনগুলোর সাথে ইরানের রয়েছে নিবিড় যোগাযোগ।
ইরাক ,লেবানন, সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও ইয়েমেনের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের ওপর রয়েছে ইরানের ব্যাপক প্রভাব। ইরানের সাথে সংঘাতের অর্থ হচ্ছে পুরো আরব অঞ্চলে অস্থিরতা তৈরি করা। আরব নেতারা দেখছেন, ইরান যদি পরমানু কর্মসূচী থেকে সরে আসে তাহলে আরব দেশগুলোর নিরাপত্তা ঝুকি কমে আসে। পরমানু চুক্তির মাধ্যমে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে প্রভাবশালী দেশে পরিনত হতে পারে। ইরানের অর্থনৈতিক প্রভাবকে আরব দেশগুলো ইতিবাচক হিসাবে বিবেচনা করে। এছাড়া ইরানের সাথে তুরস্ক, আরব আমিরাত ও কাতারের রয়েছে নিবিড় বানিজ্য সর্ম্পক।


মধ্যপ্রাচ্যর আরেক বড় খেলোয়াড় হচ্ছে তুরস্ক। কুর্দি বিদ্রোহীদের দমন করা এখন তুরস্কের প্রধান নিরাপত্তা সংকট। কিন্তু এককভাবে তুরস্কের পক্ষে কুর্দিদের দমন করা সম্ভব নয়। কারন কুর্দিদের কোনঠাসা করতে হলে তুরস্কের দরকার হবে ইরাক, সিরিয়া, ইরান ও রাশিয়ার সমর্থন। তুরস্কের জন্য বড় সমস্যা হলো পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো কুর্দিদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সিরিয়া , ইরান ও রাশিয়ার সমর্থন চাইছে তুরস্ক। এ ক্ষেত্রে কুর্দিদের ওপর থেকে পশ্চিমা সমর্থন প্রত্যাহারের জন্য রাশিয়া কার্ড খেলছে এরদোয়ান।


তুরস্কের সীমান্ত সুরক্ষিত রাখতে হলে সিরিয়া ও ইরানের সমর্থন খুব জরুরি। অপরদিকে এই দুদেশের ওপর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে রাশিয়ার। সিরিয়ার আসাদ সরকারকে মুলত টিকে রেখেছে রাশিয়া। সিরিয়াতে রয়েছে রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি। ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে এ অঞ্চলে রাশিয়া সামরিক ভুমিকা কমাতে চায়।
এক সময় প্রেসিডেন্ট আসাদের সাথে এরদোয়ানের ছিলো সুসর্ম্পক। আরব বসন্তের মাধ্যমে আসাদকে উচ্ছেদের সাথে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে এরদোয়ান সরকার। সিরিয়ার বিদ্রোহী যোদ্ধাদের আশ্রয় ও প্রশিক্ষন দেয় তুরস্ক। সিরিয়ার বিশাল অংশ দখল করে নিরাপদ এলাকা গঠন করে সেখানে সেফজোন গঠন করে। ফলে আসাদের এক নম্বর শত্রুতে পরিনত হন এরদোয়ান।


এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। সম্প্রতি তেহরানে পুতিন - এরদোয়ান ও রাইসির মধ্যে বৈঠকের পর তুরস্কের নীতিতে পরিবর্তনের আভাষ পাওয়া যাচ্ছে। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইঙ্গিত দিয়েছেন, বাশার আল আসাদ সরকারের সাথে সর্ম্পক স্থাপনের চিন্তা করছে তুরস্ক। এছাড়া সিরিয়ার ভুখন্ডে তুরস্ক যে অভিযান চালানোর হুমকি দিয়ে আসছে তা থেকে সরে আসছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে তুরস্কের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে শরনার্থীদের ফেরত পাঠানো। কারন সিরিয়ার শরনার্থীরা দেশে ফিরে গেলে তারা ঝুকির মুখে পড়বেন।


এ ক্ষেত্রে এরদোয়ান হয়তো আসাদ সরকারের সাথে অলিখিত সমঝোতায় যেতে পারেন। মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি সক্রিয় সমর্থন সীমিত করার শর্তে মিশরের সাথে সর্ম্পক গড়ে তুলেছে এরদোয়ান। সিরিয়ার সাথেও একই কৌশল নিতে পারেন। তবে দখল করা সিরিয়ার ভুখন্ড নিয়ে সমঝোতার ক্ষেত্রে রাশিয়ার ভুমিকা হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন।
সামগ্রিকভাবে সিরিয়া নীতিতে মধ্যপ্রাচ্যর দেশগুলোতে পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সিরিয়ার সাথে আরব আমিরাত , জর্ডান ও মিশরের সর্ম্পক স্বাভাবিক হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ চলতি বছরের মার্চে আরব আমিরাত সফর করেন। এটি ছিলো কোনো আরব দেশে তার প্রথম সফর। এখন তুরস্কের সাথে সিরিয়ার সর্ম্পক স্বাভাবিক হলে পুরো পরিস্থিতি বদলে যাবে।


মধ্যপ্রাচ্যে দেশগুলোর সর্ম্পকের এই মেরুকরনে গুরুত্বপূর্ন ছিলো তুরস্ক ও সৌদি আরবের মধ্যে সর্ম্পক পুন:স্থাপন। কারন এরমধ্যদিয়ে পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। কাতার ছাড়া উপসাগরীয় দেশগুলোর ওপর রয়েছে সৌদি আরবের একচ্ছত্র প্রভাব। সৌদি আরবের সাথে তুরস্কের সর্ম্পক স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার মধ্যদিয়ে এ অঞ্চলে নতুন এক স্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কমে আসে মধ্যপ্রাচ্যর দেশগুলোর মধ্যে বিভাজন।


হোয়াইট হাউসে ডেমোক্রাটদের ফিরে আসার বড় ধরনের প্রভাব পড়ে মধ্যপ্রাচ্যর ভুরাজনীতিতে। নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট বাইডেন মধ্যপ্রাচ্যর পরস্পর বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহনের ঘোষনা দিয়েছিলেন। এই তালিকায় সৌদি আরবের ডিফ্যাক্টো শাসক মোহাম্মদ বিন সালমান বা এমবিএস যেমন ছিলেন, তেমনি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানও ছিলেন।


বাইডেন ইরানের ব্যাপারে নমনীয় নীতি গ্রহন করবেন সে ঘোষণাও তিনি আগেই দিয়েছিলেন। ফলে এরদোয়ান ও এমবিএসের মধ্যে সর্ম্পক তৈরির কমন গ্রাউন্ড তৈরি হয়। এরদোয়ানের সৌদি আরব সফরের মধ্যদিয়ে তার সূচনা হয়। এমবিএসকে কোনঠাসা করা হয়েছিলো ইস্তাম্বুলে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যার সাথে তার সম্পৃক্ততা নিয়ে। তুরস্ক এমবিএসের মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে এমবিএসের মাথার ওপর ঝুলে থাকা তরবারিটি সরে যায়। তার পক্ষে এক ধরনের আইনি বৈধতা তৈরি করে।
অপরদিকে অর্থনৈতিক সংকটে থাকা তুরস্কের পাশে দাড়ায় সৌদি আরব ও আরব আমিরাত। এই দুই দেশের সাথে সর্ম্পকের ভূরাজনৈতিক সুফলও পায় তুরস্ক। লিবিয়ায় বিদ্রোহী নেতা খলিফা হাফতারের পেছনে সমর্থন কমিয়ে আনে আরব আমিরাত ও তুরস্ক। ফলে লিবিয়ায় তুরস্কের অবস্থান সৃদৃর হয়। পূর্ব ভুমধ্যসাগরে গ্রিস ও ইসরাইলের সাথে জোট বেধেছিলো মিশর। সে অবস্থান থেকে সরে আসে কায়রো।


মধ্যপ্রাচ্যর দেশগুলোর ঐক্য আর্ন্তজাতিক রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যর দেশগুলো পুরোপুরিভাবে ওয়াশিংটনকে সমর্থন দেয়নি। রাশিয়া ও চীনের সাথে নিবিড় সর্ম্পক বজায় রেখে চলছে। ফলে ওয়াশিংটনের সাথে মধ্যপ্রাচ্যর দেশগুলোর বাড়ছে দরকষাকষির সক্ষমতা। মধ্যপ্রাচ্যর দেশগুলো যদি ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে তাহলে এ অঞ্চল দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ ও সংঘাত থেকে বেড়িয়ে নতুন শক্তি হিসাকে আর্বিভুত হতে পারবে।