ইউরোপের ২৭টি দেশ নিয়ে ১৯৫৭ সালে গঠিত হয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন । মানবতাবাদী ও শান্তিপূর্ণ জোট হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সুনাম আছে সারা বিশ্বে। মানুষের বাক স্বাধীনতা, মানবাধিকার, আইনের সঠিক প্রয়োগ, নিয়ন্ত্রনমুক্ত বিচারব্যবস্থা, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ও ধর্মনিরপেক্ষতাসহ নানা কারণে বিশে^র অন্যান্য দেশের জনগণের কাছে এই মহাজোট ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক প্রধান জোসেফ রোরেল সম্প্রতি তরুন কুটনীতিকদের এক অনুষ্ঠানে দাবি করেছেন, ‘ইউরোপ সভ্য বিশ্বের নেতৃত্ব দিচ্ছে। ইউরোপ হচ্ছে একটি ফুলের বাগান। এখানে রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সামাজিক সংহতি সুদৃঢ়ভাবে বিরাজমান। তিনি আরো বলেন, বিশ্বের অবশিষ্ট অংশের মানুষ তাদের ভুখন্ডকে জংগলে পরিণত করেছে। সেই জংগলের লোকজন আমাদের এই বাগানে হামলা চালনোর চেষ্টা করতে পারে। ইউরোপের বাইরের বিশ^ সম্পর্কে শিষ্টাচার বর্জিত মন্তব্য করার জন্য জোসেফ বোরেল কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েন।
এই জোট গঠনের সময় প্রধান লক্ষ্য ছিল পুরো ইউরোপ থেকে যুদ্ধ বন্ধ করা ও পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরি করা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ইউরোপের হাওয়া বদলাতে শুরু করেছে। ছড়িয়ে পড়েছে ধর্ম বিদ্বেষ। বিশেষ করে ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ ও অভিবাসনবিরোধী ঘৃণার বিষ। ধীরে ধীরে ইউরোপের ডানপন্থী ও ইসলামবিদ্বেষীরা উগ্র ও হিংস্র হয়ে উঠছে। ইউরোপে রাস্তাঘাট, শপিংমল, মসজিদ, এমনকি বাসা বাড়িতে গিয়েও উগ্রপন্থীরা মুসলমানদের উপর হামলা করছে।
নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ আল-নূর মসজিদে ২০১৯ সালের ১৫ মার্চ শুক্রবার জুমার নামাজ চলাকালে হামলা চালায় ব্রেন্টন টরেন্ট নামক একজন খিষ্টান উগ্রপন্থী। তার নির্বিচার গুলিবর্ষণে নামাজ পড়তে আসা মুসল্লিদের অনেকেই নিহত হন। মসজিদে হামলার পর নীলউড ইসলামিক সেন্টারেও এলোপাথাড়ি গুলি ছোড়ে সেই বন্দুকধারী। সেখানেও নিহত হন বেশ কয়েকজন মুসলমান। সে সময় হামলাকারী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার সেই জঘন্য হত্যাকান্ডের লাইভ সম্প্রচার করে। সে নিজেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আদর্শে অনুপ্রানিত বলে দাবি করেছিল সেদিন। চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারী জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছে হানাও শহরে একজন উগ্রপন্থীর হামলায় ৯ জন মুসলমান প্রাণ হারান। এরমধ্যে পাঁচজন তুর্কি মুসলিম নাগরিক ছিলেন। এ ঘটনার পর তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে- ‘এই হামলা প্রমাণ করে ইউরোপে বর্ণবাদ এবং ইসলামবিদ্বেষ বাড়ছে।’ জার্মানিতে গত কয়েকবছরে মসজিদসহ বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের উপর হামলার বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে।
সম্প্রতি ফ্রান্সের লে কানার্ড এনচান সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি কার্টুনে কাতারের জাতীয় ফুটবল দলকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কাতারে ২০২২ সালের ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হওয়ার পূর্ব মুহুর্তে এই কার্টুনটি প্রকাশ করা হয়েছে। এর ফলে কাতারজুড়ে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। আরব বিশ^ এবং মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশে এবারই প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর বসেছে। কিন্তু উপসাগরীয় অঞ্চলের একটি দেশে বিশশ্বকাপের মতো বৃহৎ পরিসরের একটি ক্রীড়ানুষ্ঠানের আয়োজন করাকে যেন সহজভাবে নিতে পারছেনা।
পত্রিকার অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত একটি কার্টুন বা ব্যঙ্গচিত্রে দেখা যায়, সাত জন ‘দাড়িওয়ালা ও রাগান্বিত লোক ‘কাতার’ লেখা জার্সি পরে আছে। তারা হাতে ছুরি, মেশিনগান, রকেট লাঞ্চার ইত্যাদি অস্ত্র নিয়ে ফুটবলের পেছনে দৌড়াচ্ছে। কার্টুনে থাকা একজনের বেল্টে বিস্ফোরকও বাধা রয়েছে। কেউ কেউ স্কি মাস্ক পরে আছে। সাত জনের মধ্যে পাঁচজন নীল জোব্বা আর দু’জন কালো প্যান্ট-শার্ট পরে আছে। কার্টুনে কাতারকে ‘স্বৈরতান্ত্রিক আমিরাত’ হিসেবে চিত্রিত করে বলা হয়েছে, এই দেশে মানবাধিকার বলতে কিছু নেই, বরং নারীদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আইন কার্যকর রয়েছে।
এ ধরনের কার্টুনের মাধ্যমে এটাই বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে, আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের লোকজন ‘অসভ্য’। এধরণের অবমাননাকর কার্টুন প্রকাশের পর কাতারে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। দেশটির আমির শেখ তামিম বিন হামাদ অল সানি বিশ^কাপ সামনে রেখে তার দেশের বিরুদ্ধে নজীরবিহীন অপপ্রচার চালানোর তীব্র সমালোচনা করেছেন।
ফরাসি পত্রিকার এধরণের কার্টুন বা ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশের কারণও অবশ্য রয়েছে। ফিফা বিশ্বকাপের ৯২ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজন করতে যাচ্ছে আরব-মুসলিম দেশ কাতার। আগের সকল রেকর্ড ভেঙে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে বিশ্বকাপের আয়োজন করতে যাচ্ছে দেশটি। বিশ্বকাপ চলাকালে ইসলামের শিক্ষা ও পরিচিতি তুলে ধরতে প্যাভিলিয়ন চালু করেছে দেশটির আওকাফ ও ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
বিশ্বকাপের সময় নানা দেশ থেকে আসা লোকজনের কাছে ইসলামের পরিচয় তুলে ধরার জন্য এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্যাভিলিয়নে বিভিন্ন ভাষায় মুদ্রিত ইসলাম ও আরব সংস্কৃতির পরিচিতিমূলক বই বিতরণ করা হবে। দর্শকদের সাথে তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলার জন্য থাকবেন ওই ভাষার দোভাষী। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি বা ভিআর প্রযুক্তির মাধ্যমে দেখানো হবে পবিত্র কাবাঘর, হাজরে আসওয়াদসহ মক্কা ও মদিনার ঐতিহাসিক ইসলামি স্থাপনা।
আরব ও ইসলামি স্থাপত্যশৈলীকে ধারণ করে প্রস্তুত করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন ৮টি স্টেডিয়াম। রাজধানী দোহাসহ বিভিন্ন স্থানে সাঁটানো হয়েছে মহানবী সা:- এর হাদিস সম্বলিত ম্যুরাল। সামাজিক শিষ্টাচার নিয়ে মহানবী সা:-এর প্রজ্ঞাপূর্ণ বাণী লেখা হয়েছে আরবি ও ইংরেজি ভাষায়। অর্থপূর্ণ হাদিসগুলো চলার পথে দর্শক ও পাঠকদের মনে তৈরি করবে আলাদা আবেদন। েসামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব ছবি ব্যাপক প্রশংসিত হচ্ছে। কিন্তু ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী ফরাসী পত্রিকা লে কানার্ড এনচান ইসলামের এই প্রচার করাকে কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না। সেকারণ্ েকাতারকে তারা একটি অসভ্য দেশ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে তাদের কার্টুনে।
কাতার বিশ^কাপ ফুটবলের ষ্টেডিয়াম গুলোর প্যাভিলিয়ন নির্মানের দায়িত্ব পেয়েছে ফরাসি কোম্পানি ভিন্সি কন্সষ্ট্রাকশন। প্রতিষ্ঠানটি কাতার সরকারের নির্দেশনার আলোকে প্যাভিলিয়ন গুলোতে ইসলামের বিভিন্ন নিদর্শন ফুটিয়ে তুলেছে। সম্ভবত: এ কারণেই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মানব পাচার ও শ্রমিকদের সাথে দুর্ববহারের অভিযোগে ফ্রান্সের আদালতে মামলা ঠুকে দেয়া হয়েছে। ভিন্সি কন্সষ্ট্রাকশন অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ফ্রান্সের মিডিয়ার ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী এবং বর্ণবাদী মানসিকতা নতুন কিছু নয়। অনেক আগে থেকেই ফরাসী সংবাদপত্রগুলোতে ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী সংবাদ ও কার্টুন প্রকাশ করা হচ্ছে। এমনকি মহানবী (সা.) কে নিয়েও ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করা হয়েছে। কাতারকে নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করা তারই সর্বশেষ উদাহরণ। ফরাসীরা নিজেদেরকে শিক্ষিত, সভ্য ও মানবতাবাদী একটি জনগোষ্ঠি হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে আসছে সব সময়ই।
ইউরোপের অন্যান্য দেশের উগ্রপন্থি ও কট্টর জাতীয়তাবাদীদের মধ্যেও একই ধরণের মনোভাব দেখা যায়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকারের সাম্প্রতিক ‘নব্য-ইউরোকেন্দ্রিকতা’ এসব দেশে উগ্র ডানপন্থিদের দ্রুত উত্থানে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। উদাহরণ হিসেবে ইতালি ও সুইডেনের কথা বলা যায়। এই দুটি দেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনে উগ্র ডানপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে। ধারনা করা হচ্ছে আগামী দিনগুলোতে ইউরোপের অন্যান্য দেশেও উগ্র ডানপন্থি ও ইসলামবিদ্বেষী দলগুলো ক্ষমতায় আসবে। ইউরোপ আবারো এগিয়ে যাচ্ছে ফ্যাসিবাদী প্রবণতার দিকে ।
ইতিহাসের বেশ কিছু কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সাথে ইউরোপের নাম জড়িয়ে আছে। উপনিবেশবাদ, ফ্যাসিবাদ ও দাস বাণিজ্যসহ অনেক ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্ম হয়েছে এই ইউরোপের মাটিতেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আগ্রাসন চালিয়ে দখলের পর নিজেদের কলোনী বা উপনিবেশ তৈরি করেছিল ইউরোপের দেশগুলোই। ইউরোপের মাটিতে আবারো উগ্রপন্থাই ক্রমশ: জোরালো হয়ে উঠছে।