সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ২০১৫ সালে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর নানা ইস্যুতে এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের সাথে সৌদি আরবের বিরোধ বাড়তে থাকে। কিন্তু দেশটি এখন সেই অধ্যায়ের সমাপ্তি টেনে নতুন অধ্যায়ের, নতুন যুগের সূচনা করতে চায়। সৌদি সরকারের ‘ভিশন ২০৩০’-এর আওতায় নেওয়া পররাষ্ট্রনীতির আলোকে আঞ্চলিক সব দেশের সাথে বিরোধ মিটিয়ে ফেলার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে রিয়াদ। এই নীতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে- সব ধরনের সংঘাত-বৈরিতার উর্ধ্বে উঠে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা অর্জন ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার করা। সেই প্রেক্ষাপট সামনে রেখেই ইরানের পর সিরিয়ার সাথেও সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিয়েছে রিয়াদ। এছাড়া তুরস্কের সাথেও সম্পর্কের উন্নতি চায় দেশটি।
ইস্তাম্বুলে ২০১৮ সালে সৌদি কনস্যুলেটে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যার ঘটনায় তুরস্কের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। শুরু হয় রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক যুদ্ধ। দুই দেশই এখন এই লড়াইয়ের ইতি টানতে আগ্রহী। গত মার্চ মাসে তুর্কি সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মজুদ রেখেছে সৌদি সরকার। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান যদি আগামী মাসের নির্বাচনে বিজয়ী হন তাহলে সৌদির এই বিনিয়োগ তার জন্য একটি মূল্যবান রাজনৈতিক পুঁজি হিসেবে কাজ করবে।
সিরিয়ার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগের অংশ হিসেবে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান গত ১৮ এপ্রিল দামেস্ক গিয়ে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তার এই সফর সিরিয়ার দশকব্যাপী আঞ্চলিক নিঃসঙ্গতা ঘোচানোর পথে সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু এক বছর আগেও সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সিরিয়া সফরের কথা কল্পনাও করা যেত না।
সম্প্রতি চীনের উদ্যোগে মধ্যপ্রাচ্যের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক পুনরায় স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় ওই অঞ্চলে সম্প্রীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার অনুকুল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় রিয়াদের সাথে দামেস্কের সম্পর্ক সহজ হওয়ার পথ খুলেছে। এরপর জর্ডানের রাজধানী আম্মানে আরব লীগের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এক বৈঠকে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক হয়। এই সম্মেলনে সিরিয়াকে শুধু আরব লীগে ফেরানো নয়, সিরিয়ার সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করা এবং সিরিয়া থেকে সব বিদেশি সেনা সরে যাওয়ার আহবান জানানো হয়।
২০১১ সালে সিরিয়ার সরকারবিরোধী বিক্ষোভাকারীদের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ দমনাভিযান চালানোর পর দামেস্কের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে রিয়াদ। বাশার আল আসাদের ওই দমনাভিযান পরে দশকব্যাপী গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। এর পরই আরব লীগে সিরিয়ার সদস্যপদ স্থগিত করা হয়। সৌদি আরবসহ বেশ কয়েকটি উপসাগরীয় দেশ বাশার আল আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে লড়াইয়ে নামা বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিতে শুরু করে।
প্রেসিডেন্ট বাশার তার প্রধান মিত্র ইরান ও রাশিয়ার সহায়তায় সিরিয়ার অধিকাংশ এলাকায় নিজের নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। ফলে তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর আরব দেশগুলোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এসব দেশ এখন সিরিয়ার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আগ্রহী। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী দামেস্কে যান। ২০১১ সালের পর দামেস্কে সৌদি আরবের কোন শীর্ষ কূটনীতিকের প্রথম সফর এটি।
সৌদি আরবের রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, বাশার আল আসাদের সঙ্গে প্রিন্স ফয়সালের বৈঠকে সিরিয়ার সঙ্ঘাতের রাজনৈতিক সমাধান এবং দেশটিকে ‘এর আরব প্রতিবেশীদের’ মধ্যে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য যেসব পদক্ষেপ দরকার তা নিয়ে আলোচনা হয়। চলতি মাসে রিয়াদে আরব লীগের শীর্ষ সম্মেলন হওয়ার কথা রয়েছে। আরব লিগের শীর্ষ সম্মেলনে বাশার আল আসাদকে আমন্ত্রণ জানাতে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল দামেস্ক যেতে পারেন।
ইরান, সিরিয়া ও তুরস্কসহ এই অঞ্চলের সব দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান আরব অঞ্চলকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবমুক্ত করতে চান। তিনি জানেন, ইরানের সাথে ছায়াযুদ্ধ ও ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের সাথে সামরিক সংঘাতের অবসান না হলে তার উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক প্রকল্পগুলো বাধাগ্রস্ত হবে। সেজন্যই তিনি ইরান ও হুতিদের সাথে সমঝোতা করে শান্তির পথে হাটছেন।
অলফোর সিরিয়া মিডিয়া নেটওয়ার্কের পরিচালক আয়মান আল নূর মনে করেন, উপসাগরীয় দেশগুলো এবং তুরস্কের মধ্যে নতুন একটি ভাবনা কাজ করছে। তারা নিজেদেরকে এমন একটি অবস্থানে নিয়ে যেতে চাইছে যাতে করে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশে^র প্রভাবমুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে সবকিছু করা যায়। এমন পদক্ষেপের মাধ্যমে এই দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে একটি বিচ্ছিন্ন অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে করেন আয়মান আল নূর। তিনি লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য নিউ আরবকে বলেছেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থ নীতিই এর জন্য দায়ী। ওয়াশিংটন এই অঞ্চলে তাদের সব মিত্র দেশকেই অবহেলা করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর মধ্যপ্রাচ্যের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে ২০১৯ সালে নির্বাচনী প্রচারণার সময়ই তিনি সৌদি আরবকে একটি দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে নেয়ার পর দ্রুততার সাথে তিনি ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহী গোষ্ঠিকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকা থেকে বাদ দেন। এমনকি ইয়েমেনের যুদ্ধের ব্যাপারে সৌদি আরবের সাথে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ও সীমিত করে দেন বাইডেন। বাইডেনের এসব পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সৌদি আরবকে সন্দিহান করে তুলে।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কারণে সৌদি আরব ও আরব আমিরাতসহ উপসাগরীয় দেশগুলো রাশিয়া ও চীনের দিকে ঝুকে পড়ে। তার সুস্পষ্ট প্রভাব দেখা যায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে। এই অঞ্চলের দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে গিয়ে ইউক্রেনকে সমর্থনের পরিবর্তে পরোক্ষভাবে রাশিয়ার দিকে চলে গেছে।
ইরানের পর সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগেরও বিরোধিতা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর কারণ হিসেবে ওয়াশিংটন সংঘাতের সময় বাশার সরকারের বর্বরতার কথা উল্লেখ করে সিরিয়ায় রাজনৈতিক সমাধান হওয়া প্রয়োজন বলেও জানিয়েছে বাইডেন প্রশাসন।
সিরিয়া ও সৌদির মধ্যকার সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়ে সাংবাদিকরা মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের একজন মুখপাত্রের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সিরিয়ার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে। বাইডেন প্রশাসন এ অঞ্চলের কোনো দেশকে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে উৎসাহিত করবে না বলেও জানান ওই মুখপাত্র।
অলফোর সিরিয়া মিডিয়া নেটওয়ার্কের পরিচালক আয়মান আল নূর মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বাইডেন প্রশাসনের গড়িমসি ও কালক্ষেপন যুক্তরাষ্ট্র্রকে একঘরে বা বিচ্ছিন্নতার পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এদিক দিয়ে ট্রাম্প অনেকটাই অগ্রসর ছিলেন বলে মনে করেন আয়মান আল নূর।
তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের যে কোন জটিল ইস্যুতেও দ্রুততার সাথে সিদ্ধান্ত নিতেন ট্রাম্প। পরবর্তীতে কি ঘটবে বা ঘটতে পারে তা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাতেন না তিনি। ফলে ট্রাম্পের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আরব দেশগুলোর সম্পর্কের উন্নতি ঘটেছিল। কিন্তু বাইডেন সেই সম্পর্ককে অবণতির দিকে ঠেলে দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের এই দুটি প্রশাসনের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যটা অনেক বেশি বলে মন্তব্য করেন আয়মান নূর।
সৌদি সরকার ২০১৩ সাল থেকেই সিরিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের পথে হাটছিল। এর কারণ হচ্ছে, ২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে সৌদি আরব ও আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশ প্রেসিডেন্ট বাশার বিরোধীদের সমর্থন দিতে শুরু করে। ইরানের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক রাখার কারণে এসব দেশ প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে চাইছিল। এসময় সৌদি আরব জইশ আল ইসলাম নামে একটি সংগঠনকে সহায়তা দেয়।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০১৩ সালে সিরিয়ায় সরকারি বাহিনীর অবস্থানে বিমান হামলা চালানো বন্ধ করার নির্দেশ দেন। সিরিয়ার পূর্ব ঘোতা এলাকায় মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে রাসায়নিক বোমা হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে। এরপরই ওবামা মার্কিন বিমান হামলা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেন।
জো বাইডেন সেসময় ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ওবামার সিদ্ধান্তের পরই সৌদি আরব বুঝতে পারে যে, পশ্চিমা বিমান হামলা চালানো ছাড়া প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরানো সম্ভব হবে না। এরপর ২০১৩ সাল থেকেই সৌদি সরকার সিরিয়ার সাথে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা শুরু করে।
বাদশাহ সালমান ও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ক্ষমতায় আসার পর এই চেষ্টা আরো জোরালো হয়ে ওঠে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তে এশিয়ার প্রভাবশালী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদারে পূর্বমুখী কূটনীতির উপর জোর দেন। বিশেষ করে চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন ছিল সৌদি সরকারের মূল লক্ষ্য। চীনও সেই সুযোগ গ্রহণ করে মধ্যপ্রাচ্যে তার কৌশলগত অংশিদার ইরানের সাথে সৌদির সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়ে সফল হয়েছে। এখন সিরিয়ার সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন হলে তা যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ‘ভিশন ২০৩০’-কে এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে।