নির্বাচনের পর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানকে নিয়ে সুর একেবারে বদলে ফেলেছে পশ্চিমা মিডিয়া। তারা এখন নিজেদের মুখ রক্ষার জন্য এরদোয়ানের এই সাফল্যের প্রশংসা করতে কার্পণ্য করছে না। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরদোয়ান যে এভাবে ঘুরে দাঁড়াবেন, তা কল্পনাতেও ছিল না পশ্চিমা বিশ্বের মিডিয়ার।
পশ্চিমা বিশে^র মিডিয়া নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই প্রচারণা চালিয়ে আসছিল, ১৪ মে-র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তুরস্কের রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে এরদোয়ানের বিদায় নিশ্চিত হয়ে যাবে। অবসান ঘটবে এরদোয়ান যুগের। কিন্তু ভোট গণণা শুরুর কয়েক ঘণ্টা পর যখন এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, পশ্চিমাদের সমর্থিত প্রার্থী কামাল কিলিচদারোগলু-র চেয়ে এরদোয়ান অনেক ভোটে এগিয়ে আছেন, তখন থেকেই পশ্চিমা মিডিয়ার সুর বদলাতে থাকে। নির্বাচনে এরদোয়ানের প্রায় ৫০ শতাংশ ভোট পাওয়াকে তারা ‘বিস্ময়’ হিসেবেই বর্ণণা করেছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে এরদোয়ান যে রানঅফ বা দ্বিতীয় রাউন্ডে নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন, তা ছিল পশ্চিমাদের কল্পনারও অতীত।
গত ফেব্রুয়ারি মাসের ৬ তারিখে তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রদেশগুলোতে শক্তিশালী ভূমিকম্পে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত এবং ধ্বংস হয়েছে হাজার হাজার ঘরবাড়ি ও স্থাপনা। বাস্তচ্যুত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। ভয়াবহ এই ভূমিকম্পের তিন মাস পর গত ১৪ মে তুরস্কের ১৩তম প্রেসিডেন্ট এবং পার্লামেন্টের ৬০০ সদস্য নির্বাচন করতে ভোট দিয়েছেন প্রায় ৬ কোটি ভোটার।
এই নির্বাচনে বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান, তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কামাল কিলিচদারোগলু ও অন্য দুজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তারা বিরামহীনভাবে প্রচারণা চালিয়েছেন সারাদেশে। এই প্রচারণায় তারা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিকে সচল করা এবং ভূমিকম্প-বিধ্বস্ত এলাকার পুনর্গঠনসহ নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ভোটারদেরকে। নির্বাচনের কয়েকদিন আগে অবশ্য একজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ান।
নির্বাচনি প্রচারণাকালে পশ্চিমা মিডিয়া প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের বিরুদ্ধে ও প্রধান বিরোধী দলীয় প্রার্থী কামাল কিলিচদারোগলু-র পক্ষে অব্যাহতভাবে নানা ধরনের প্রচারণা চালায়। ব্রিটিশ সাপ্তাহিক দ্য ইকোনমিস্ট এরদোয়ানের বিরুদ্ধে কোমর বেঁেধ মাঠে নেমেছিল। পত্রিকাটি নির্বাচনের ১০ দিন আগে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে খুবই নেতিবাচক একটি কাভারস্টোরি প্রকাশ করে।
দ্য ইকোনমিস্টের কভার পেজের হেডিং দেয়া হয়েছিল ‘দ্য মোস্ট ইম্পর্টেন্ট ইলেকশন অব ২০২৩’। এর মধ্যে ‘সেভ ডেমোক্রেসি’ ও ‘এরদোয়ান মাস্ট গো’ শিরোনামে আরো দুটি এরদোয়ানবিরোধী খবর ছাপা হয়। তবে এরদোয়ানের মুখপাত্র ইব্রাহিম কালিন এক টুইট বার্তায় ভোটারদেরকে ইকোনমিস্টের এ ধরনের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচনে এরদোয়ানের পরাজয় তুরস্কে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবে। একইসাথে এরদোয়ানের আমলে পশ্চিমাদের সাথে তুরস্কের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তাও দূর হয়ে যাবে। এর আগে পত্রিকাটি এরদোয়ানকে নিয়ে ‘আম্পায়ার’ ও ‘ডিক্টেটরশিপ’ নামে আরও দুটি কভারস্টোরি করেছিল।
ইকোনোমিস্টের এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশে পত্রিকাটির ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। এর প্রতিবাদ জানিয়ে গত ৫ মে এক টুইটবার্তায় এরদোয়ান বলেছেন, তুরস্কের রাজনীতিতে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ বরদাশত করা হবে না। তিনি বলেন, ব্রিটিশ এ গণমাধ্যম সরাসরি তুরস্কের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে, এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
তুরস্কের নির্বাচন সামনে রেখে পশ্চিমা গণমাধ্যম প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের বিরুদ্ধে এমন প্রচারণা চালিয়েছে বিগত কয়েক মাস ধরে। এসব প্রচারণায় তুরস্কের ভোটার, সরকারি কর্মকর্তা ও সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদেরকে নানাভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়। একে পার্টির নেতাদের অভিযোগ এসব প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে তুরস্কের সাধারণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়।
এতে ক্ষোভ প্রকাশ করে গত ২৭ জানুয়ারি পশ্চিমা গণমাধ্যমকে একহাত নিয়েছেন তুরস্কের ক্ষমতাসীন দল একে পার্টির মুখপাত্র ওমর। এক টুইটবার্তায় তিনি লিখেছেন, তারা যা করছে, তাকে সাংবাদিকতা বলা যায় না। এসব নিশ্চিতভাবে অপপ্রচার। তিনি বলেন, তুরস্কের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে মিথ্যা তথ্য প্রচার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে এসব গণমাধ্যম।
তারা দাবি করেন, জার্মানির ‘স্ট্রার্ন’ ম্যাগাজিন ও যুক্তরাজ্যের ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে নিয়ে বেশ কয়েকটি নিবন্ধ ও বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এগুলোতে এরদোয়ানকে হেয় করার পাশাপাশি ভুলভাবে প্রচার করা হয়েছে।
ইকোনমিস্ট পত্রিকার এক নিবন্ধে এরদোয়ানের ওপর বেশ কয়েকটি দোষ চাপানো হয়। এতে বলা হয়, তুরস্কে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন এরদোয়ান। এই অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে জানান একে পার্টির মুখপাত্র ওমর। পশ্চিমা মিডিয়ায় আরও বলা হয় যে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থীর বিজয় হবে পশ্চিমা বিশে^র জন্য ভূরাজনৈতিক দিক থেকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। দ্য ইকোনমিস্টের এসব বিশেষ প্রতিবেদন নিয়ে কয়েকটি পাল্টা নিবন্ধ প্রকাশ করেছে তুরস্কের সরকার সমর্থক গণমাধ্যম ডেইলি সাবাহ।
পশ্চিমা গণমাধ্যমের এরদোয়ান-বিরোধী কঠোর অবস্থানের পরও ১৪ মে-র নির্বাচনে এরদোয়ানের ৪৯ দশমিক ৫১ শতাংশ ভোট পাওয়া বিস্মিত করেছে পশ্চিমা বিশ্ব ও গণমাধ্যমকে। এখন তারা সুর পাল্টাতে বাধ্য হচ্ছে। খোদ ইকোনমিস্টকে এখন মুখ লুকানোর জন্য বলতে হচ্ছে, ‘এটা এখন স্পষ্ট- দ্বিতীয় রাউন্ডের ভোটে এরদোয়ানই ফেভারিট।’
পত্রিকাটিতে আরও বলা হয় যে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৪৫ শতাংশ ভোট পাওয়া বিরোধী প্রার্থী কামাল কিলিচদারোগলু-র নেতৃত্বাধীন ৬ দলীয় জোটের পার্লামেন্ট নির্বাচনের ফলাফল ধারণার চেয়েও অনেক খারাপ হয়েছে। কামাল কিলিচদারোগলু-র নেতৃত্বাধীন ৬ দলীয় জোট নেশন অ্যালায়েন্স পার্লামেন্ট নির্বাচনে ৩৫ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পেয়েছে। পার্লামেন্টের ৬০০টি আসনের মধ্যে ২১৩টি পেয়েছে তারা। ফলে তারা প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের নেতৃত্বাধীন জোট পিপলস অ্যালায়েন্সের কাছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। পিপলস অ্যালায়েন্সের আসন ৩২২টি। তারা ভোট পেয়েছে ৪৯ দশমিক ১ শতাংশ।
১৪ মে-র নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক ভোটার উপস্থিতির কথা উল্লেখ করে ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘তুর্কি জনগণ গণতন্ত্রকে পরিত্যাগ করেনি। ভোট কেন্দ্রে ৮৮ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি যে কোন মানদণ্ডে সর্বোচ্চ বলে ম্যাগাজিনটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এতে আরও উল্লেখ করা হয়, এই নির্বাচন তুরস্ক ও তার পররাষ্ট্রনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে রাশিয়ার সাথে তুরস্কের সম্পর্কের ক্ষেত্রে।
কেবল ইকোনমিস্ট নয়, পশ্চিমা বিশ^ বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপের অনেক মিডিয়াও তুরস্কের নির্বাচন নিয়ে তাদের আগের অবস্থান বদলে ফেলেছে। ফ্রান্স, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডের গণমাধ্যমও এখন বলছে, ‘এরদোয়ানই ফেবারিট।’ ২৮ মে-র দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে তিনিই জিতবেন। জার্মাানির ফাজ এক প্রতিবেদনে লিখেছে, দুই সপ্তাহের মধ্যে রান অফ ভোট হলে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টই জিতবেন।
পশ্চিমা মিডিয়ায় এখন বলা হচ্ছে, একে পার্টি যেহেতু পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে, তাই সংগত কারণেই দেশে স্থিতিশীল পরিবেশের স্বার্থে ভোটাররা সেই দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকেই ভোট দেবেন। পার্লামেন্টে যার দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই এমন প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার কথা চিন্তা করবেন না ভোটাররা। ফ্রান্স টুয়েন্টি ফোরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তৃতীয় স্থান পাওয়া প্রার্থী সিনান ওগানের সমর্থকদের ভোট আগামী ২৮ তারিখে এরদোয়ানের বাক্সে যাবে। কাজেই দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের বিজয় যে নিশ্চিত, তা বলাই যায়।
জার্মান সংবাদপত্র দিয়ে ওয়েল্ট এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচনে এরদোয়ানের প্রায় ৫০ শতাংশ ভোট পাওয়া ‘একটি বিস্ময়কর সাফল্য।’ সংখ্যাগরিষ্ঠ তুর্কি তাকে ‘উদ্ধারকর্তা’ মনে করে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। সুইস সংবাদপত্র এনজেডজেড স্বীকার করেছে যে, এরদোয়ান ২ কোটি ৬০ লাখ ভোটারের আস্থা অর্জন করেছেন। বিশেষ করে ভুমিকম্প কবলিত এলাকায় তার বিপুল ভোট পাওয়া একটি বড় ঘটনা। পার্লামেন্টে সংগরিষ্ঠতা পাওয়া তার হাতকে আরও শক্তিশালী করেছে বলেও এতে বলা হয়।
ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় এক বছরের মধ্যে অন্তত ৩ লাখ ১৯ হাজার বাড়ি নির্মাণ করে সেগুলোর চাবি গৃহহীনদের হাতে তুলে দেওয়ার অঙ্গিকার করেছেন এরদোয়ান। তার এই অঙ্গিকারকে মানুষ বিশ^াস করে তাকে ভোট দিয়েছেন। কারণ, এরইমধ্যে শত শত বাড়ি নির্মাণ করে সেগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে গৃহহীনদের কাছে।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমাদের মাথা ঘামানো ও তার বিরুদ্ধে প্রচারনা চালানোর নিন্দা জানিয়ে একে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের নগ্ন হস্তক্ষেপ বলে মন্তব্য করেছেন। সব কর্তৃত্ববাদী শাসকরা অবশ্য এভাবে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে থাকেন। পশ্চিমাদের উদ্দেশে এরদোয়ান বলেছেন, ‘আপনারা আমার দেশের ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারবেন না। তুরস্কের জনগণই ঠিক করবে, তারা কোন পথে অগ্রসর হবে।